কোড নেম প্রমিথিউস

স্যার খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন, তারপর উত্তরটা দিলেন শান্তভাবেই, “কারন আমার মেয়ে একটা অ্যাকসিডেন্টে মারা যায়। আমার স্ত্রীও তার পরপরই চলে যান। তাই দুঃখ ভুলতে ওকে আমি দত্তক নিই।“

আমি তখন প্রশ্ন করলাম। “আচ্ছা স্যার, এই কাজটা কে করেছে, আপনার কি কোনও ধারনা আছে? ভাল করে ভেবে বলুন, আপনার কি এমন কেউ শত্রু আছে, যে আপনার খুব বড় একটা সর্বনাশ করতে চায়?”

যেটা এতক্ষণ দেখিনি, সেটা এখন দেখলাম। স্যারের চোখেমুখে একটা ছাইচাপা আগুনের বহ্নি। চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, ঠোঁট কাঁপছে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালেন যেন। তারপর বললেন, “আছে একজন। কিন্তু সে জানিনা এখন কোথায় আছে, বা কি অবস্থায় আছে। শেষ জানতাম, সে জার্মানিতে একটা জেলে পচছে, গুপ্তচরবৃত্তি আর খুনের অভিযোগে। শেষ শুনেছিলাম, যে সে জেল ভেঙে বেরিয়েছে। তারপর আর তার কোনও খবর নেই আমার কাছে। যদি আমার কেউ ক্ষতি করতে চায়, তাহলে সেই পারে করতে।“

“কে স্যার? কে এই কাজটা করেছে?” আমরা সমস্বরে জিজ্ঞেস করলাম।

“বলছি, সব বলছি।“ স্যার বললেন, “অনেকদিন এগুলো কাউকে বলা হয়নি। আজ বলে একটু হালকা হই।“

তারপর স্যার বলা শুরু করলেন, আমরা শুনতে থাকলাম সেই দুঃখের কাহিনি।

“ছাত্রাবস্থা থেকেই আমার উৎসাহ ছিল জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রতি। আমাকে যেন চুম্বকের মত টানত, ডি.এন.এর প্রত্যেকটা প্যাঁচ, আর আর.এন.এর প্রত্যেকটা স্ট্র্যান্ড। আমি ঠিক করেছিলাম, গ্র্যাজুয়েশনের পর আমি মাস্টার্স করব জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে। কিন্তু অর্থাভাবে আমার আর হয়ে উঠছিল না। কিন্তু, ভগবান সদয় ছিলেন, একটা স্কলারশিপ পেয়ে গেলাম গ্র্যাজুয়েট হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। চলে এলাম ইংল্যান্ডে। কেমব্রিজে পেয়ে গেলাম গবেষণার কাজ। আর সেখানেই প্রথম লোকটার সাথে আলাপ।

লোকটার নাম হাইনরিখ। বড়লোক বাপের ছেলে, জার্মানিতে কোন এক দুর্গের মালিক ওরা বংশানুক্রমে। ঘটনাচক্রে লোকটা আমার ল্যাব পার্টনারের কাজ করত। কেন জানি না, লোকটাকে আমার প্রথম থেকে খুব একটা সুবিধার লাগতো না। কিন্তু কি করে যে আমার আর ওর মধ্যে মিল হল, আমি নিজেও জানি না।

ওর সাথে সাথেই আমার প্রথম রিসার্চ পেপারগুলো বেরিয়েছিল। সবই কমবেশি জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর ওপর। মোটামুটি রেকগনিশনও পেলাম। দু- একটা ইন্টারন্যাশনাল পেপারে নামও বেরোল। কিন্তু সেটাই বোধহয় আমার জীবনের সবথেকে বড় শনি ছিল, আমি বুঝতে পারিনি। হাইনরিখের ন্যাক ছিল সাইবারনেটিক অর্গানিজমের ওপর, তোমরা যাকে সাইবর্গ বল। আমি এদিকে কেমব্রিজে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে তখনও কাজ চালাচ্ছি জেনেটিক এনহ্যান্সমেন্টের ওপর। তো, এরকমই এক বিকেলে আমাদের মধ্যে কথা হচ্ছিল, কিভাবে মানুষের গড় আয়ু বাড়ানো যায় নিয়ে। হঠাৎই কথা প্রসঙ্গে উঠে আসে রিজেনারেশনের কথা। আর সেখান থেকেই আমাদের কাজ শুরু হয়।“

স্যার তারপর একটু থামলেন, তারপর বললেন, “আসলে আমাদের দুজনের অ্যাপ্রোচ ছিল আলাদা। আমার ইচ্ছে ছিল যেকোনোরকম ভাবে জিনগতভাবে মানুষের জিনকে উন্নত করে দেওয়া যাতে, মানুষ এই সমস্ত নন কমিউনিকেবল ডিজিজের প্রতি রেজিস্টান্ট হয়, যাতে গড় আয়ুটা আরও বাড়তে পারে। অথবা কোনও ভাবে যে কোশগুলো আমাদের শরীরে প্রতিনিয়ত মরে যাচ্ছে, সেগুলো যদি কোনোভাবে আবার রিজেনারেট করে যায়, তাহলে সে প্র্যাক্টিক্যালি তার বাতিল অঙ্গগুলিকে নিজে নিজেই রিপেয়ার করতে পারবে। অন্যদিকে হাইনরিখের ধারণা ছিল, যে যে অঙ্গগুলো আমাদের শরীরে তার কর্মক্ষমতা হারাচ্ছে, সেগুলোকে যন্ত্রমানবের মত, রোবোটিক পার্টস দিয়ে পাল্টে দিলে মানুষ অনেক বেশি দিন কর্মক্ষম থাকবে।

বুঝতেই পারছ, আমাদের দুজনের চিন্তাভাবনা ছিল উত্তর আর দক্ষিন মেরুর মত। পুরোপুরি বিপরীতমুখী, কিন্তু দুজনের একে অন্যের প্রতি আকর্ষণ তীব্র। তাই কাজটা করা নিয়ে আমরা একে অন্যের সাথে কাজ করতে মুখিয়ে ছিলাম।“

স্যার তারপরই যেন চিন্তায় হারিয়ে গেলেন। দেখলাম, শূন্যে তাকিয়ে কি যেন ভাবছেন। একবার অস্ফুটে যেন বলতে শুনলাম, “কিন্তু প্রমিথিউস…”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “স্যার, কি প্রমিথিউসের কথা বলছিলেন আপনি?”

স্যার যেন হেসেই উড়িয়ে দিলেন ব্যাপারটাকে। বললেন, “নাহ, আসলে একটা গবেষণার কথা ভাবছিলাম। আসলে তো কাজের মোহ ছাড়তে পারিনি। এই বয়সেও ল্যাবে ঘণ্টা চারেক না কাটালে ঠিক রাতে ঘুম হয় না। বাকি সময়টা তো বিভিন্ন জার্নালে লেখালেখি আর পড়াশোনাতেই বেরিয়ে যায়।“

বর্ণালী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনার নিজস্ব ল্যাব আছে?”

স্যার স্মিত হেসে বললেন, “অবশ্যই। এই বাড়িতেই আছে। অবশ্য তার জন্য কিছু আর. অ্যান্ড. ডি. করতে হয়েছে এই সুন্দর বাগানবাড়িটার ওপর। চল, বাকি কথা ল্যাবেই হবে। এমনিও বিকেল হয়ে এল। সন্ধ্যে হতে বেশি দেরি নেই। অবশ্য ভারতীয় সময় আর গ্রিসের সময় তো মেলে না। কাজেই আমার আর তোমার সন্ধ্যে পুরো আলাদা।“

দেখলাম, স্যারের কথাই ঠিক। সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা বাজে, আমার হাতঘড়িতে, যেটা আমার বাড়ির পাশে থাকা শিয়ালদা স্টেশনের টাইমের সাথে মেলানো। আর স্যারের বড় দেওয়ালঘড়িতে বাজে বিকেল পাঁচটা।

বাক্যব্যয় না করে তিনজন স্যারকে অনুসরণ করলাম। স্যার উঠে গিয়ে দেওয়ালের একপাশে একটা সুইচ টিপলেন। আমরা দেখলাম, লাইব্রেরির বইয়ের র‍্যাক গুলো সরে গিয়ে একটা বড় দরজাকে জায়গা করে দিল। দরজাটা খুলতেই  দেখতে পেলাম, একটা লম্বা প্যাসেজওয়ে। তার শেষ মাথায় থাকা দরজাটার সামনে দাঁড়াতেই সামনে একটা প্যানেল ফুটে উঠল। সেখানে স্যার চোখ রাখতেই একটা লাল আলো এসে পড়ল স্যারের বাম চোখের ওপর। বুঝলাম, এটা একটা রেটিনা স্ক্যান। তারপরই নীল আলোটা সাদা হয়ে যেতেই দরজাটা খুলে গেল। আমরা ভেতরে ঢুকলাম।

ঢুকে যা যা দেখলাম, তার বিস্তারিত বর্ণনায় যাব না। একটা আধুনিক গবেষণাগার কিরকম হতে পারে, স্যারের ল্যাব দেখলে বোঝা যায়। কি নেই সেখানে, মাইক্রোস্কোপ, স্লাইড, চার্টস, বুন্সেন বার্নার, আগার জেল, ফ্লাস্ক, টেস্টটিউব, অটোক্লেভ, দুটো থার্মাল সাইক্লার( স্যার বললেন, ওগুলো পি.সি.আর), ব্যুরেট, পিপেট, মিক্সার, ফ্রিজ, সেন্ট্রিফিউজ মেশিন… কি নেই তাতে? ল্যাবের এক কোণে প্রচুর প্রচুর প্রাণীর ফর্মালিন স্পেসিমেন। কয়েকটাকে চিনতে পারলাম, অনেকগুলোই অজানা ঠেকল। তবে সবথেকে চমকটা বোধহয় অপেক্ষা করছিল। দু তিনটে অ্যাকোরিয়াম। তাতে ঘুরছে কিছু সাদা রঙের জীব। টিকটিকির মত দেখতে, কিন্ত বড়, আর গলার পাশে লাল রঙের ছটা ফুলকা গোছের কিছু বেরিয়ে আছে। সমুদ্রের সাথে কুইজ করার সুবাদে এই প্রাণীগুলোকে আমি চিনতাম। কিন্তু এগুলোর বিশেষত্ব কি সেটা জানতাম না। স্যার দেখলাম লক্ষ্য করছেন, যে আমরা ঐ জীবগুলোকে অনেক মনোযোগ দিয়ে দেখছি বলে।

“কি হল, ঐগুলোর কথা আসবে পরে। আগে আগের কথাগুলো বলে নিই।“ স্যার হাত নেড়ে ডাকলেন আমাদের। আমরা এগিয়ে এলাম স্যারের কাছে।

দেখি, স্যার দাঁড়িয়ে আছেন একটা ছবির সামনে। ছবিটা ওনার ল্যাবে ঢুকেই, ল্যাবের দরজার একদম সামনেই টাঙানো। একজন বলিষ্ঠ পুরুষের ছবি যে চেন দিয়ে বাঁধা রয়েছে একটা পাথরের ওপর। একটা ঈগল উড়ে এসে বসছে তার পেটের কাছে, ঠিক যেখানে লিভার থাকে। লিভারটাকে সে ঠুকরে খাবে বোধহয়।

আমি চিনতে পারিনি কিন্তু সমুদ্র ক্যারেক্টারটাকে চিনতে পেরেছিল, কারন লক্ষ্য করলাম ওর চোখের দৃষ্টিই পুরো পাল্টে গেছে ছবিটাকে দেখে।

 

~ কোড নেম: প্রমিথিউস (পর্ব ৫) ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleকোড নেম: প্রমিথিউস (পর্ব ৪)
Next articleকোড নেম: প্রমিথিউস (পর্ব ৬)
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments