কোড নেম প্রমিথিউস

এই আক্রমণের জন্য ওরা কেউই তৈরি ছিল না। গুণ্ডাগুলোর মধ্যে দেখলাম, দুজন ধরাশায়ী হয়েছে। বাকিরাও কভার নিয়েছে গাছের আড়ালে।

কিন্তু, ভাগ্য বিরূপ। আমাদের কাছে বেশি গুলি ছিল না। ওদের সঙ্গত দিতে আমি আর বর্ণালী হাতের কাছে যা নুড়িপাথর ছিল, ছুঁড়ে মারা শুরু করলাম ওদের দিকে। আর ঠিক তখনই ওদের তরফ থেকে যে জিনিসটা আমাদের দিকে ধেয়ে এল, সেটার জন্য আমরা তৈরি ছিলাম না।

একটা ছোট লম্বাটে বোমা। আমাদের কাছে এসে সেটা ফাটতেই একটা তীব্র আলোয় চারদিক একাকার হয়ে গেল। কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না চোখে। ওর মধ্যেই শুনতে পেলাম, সমুদ্র চিৎকার করে বলল, “ফ্ল্যাশব্যাং। কেউ নড়িস না, বা ছোটার চেষ্টা করিস না। তাহলে নিচে গিয়ে পড়লে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।“

ওর কথা শেষ হতে না হতেই, চারপাশ থেকে শক্ত হাতের বাঁধনে বাঁধা পড়লাম আমরা। একজন আমার তলপেটে সপাটে একটা ঘুষি চালাল। ব্যাথায় কুঁকড়ে গেলাম আমি। মুখ দিয়ে একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এল। কিন্তু তখনও চোখে ধাঁধা দেখছিলাম। আলোর রেশ কাটতে দেখলাম, আমরা সবাই বন্দী।

হাইনরিখ আমাদের দিকে একবার তাকাল ভাল করে। মুখে তার ক্রূর হাসি। তারপর তার হাতের ইশারায় নিমেশের মধ্যেই হাইনরিখের পোষা গুণ্ডারা এসে আমাদের পিস্তলদুটো কেড়ে নিল।

হাইনরিখ মুখে একটা চুকচুক শব্দ করে বলল, “ছিঃ সেন, বাচ্চাদের হাতে পিস্তল ধরিয়ে দিয়েছ? এসব কি তোমাকে মানায়? যাকগে, একটু পরেই তো তোমরা ইজিয়ান সাগরের হাঙরদের খাবার হবে।  এত সব ভেবে কি আর লাভ হবে?“

সমুদ্র চিৎকার করে উঠল, “বাস্টার্ড। সাহস থাকলে খালি হাতে আয় সামনে।“

হাইনরিখ সমুদ্রের চিৎকারটাকে গ্রাহ্যের মধ্যেই আনল না। একবার সে নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকাল। তারপর বলল, “চল, তোমাদের সময় শেষ হয়ে এসেছে। হাঙরগুলো অনেকক্ষণ অভুক্ত আছে। ভগবানকে ডেকে নাও তোমরা, কেমন?”

শিউরে উঠল সবাই। গুণ্ডাগুলো সবাইকে ধরে নিয়ে আনল লাইট হাউসের সামনের খোলা মাঠটায়। পেছনে দেড়শ ফুট খাড়া পাহাড়, আর তার নিচেই ইজিয়ান সাগর গর্জে উঠছে রাগে।

পাঁচজন বন্দুকধারী বন্দুক তাক করে দাঁড়াল আমাদের দিকে। হয় গুলিতে প্রাণ দিতে হবে, নয় সামনে এই নীল সমুদ্রের বিষাক্ত ঢেউ আর উঁচিয়ে থাকা পাথরগুলোর মধ্যেই প্রাণ দিয়ে আসতে হবে।

সমুদ্র অস্ফুটে বলে উঠল, “এই শেষ তাহলে?”

ক্রিস দেখলাম, একমনে যীশুকে ডাকছে। বর্ণালী স্থানুর মত দাঁড়িয়ে আছে। স্যার একদৃষ্টে চেয়ে আছেন হাইনরিখের দিকে।

আমার তখন কি মনে হচ্ছিল, বলে বোঝাতে পারব না। একদিকে উত্তাল সমুদ্র, অন্যদিকে সামনেই রাইফেলের নলগুলো সোজা উঁচিয়ে রয়েছে আমাদের দিকে। ঝোড়ো হাওয়ায় চারদিকে উথালপাথাল চলছে।

এই অবস্থাতেই মরতে হবে?

নাহ। এখনই কিছু করা দরকার।

আমি চিৎকার করে উঠলাম। “হাইনরিখ, স্যুটকেসটা খুলে আদৌ দেখেচ তার মধ্যে কি আছে?”

এই প্রথম তার মুখের ভাবটা পরিবর্তিত হল। আত্মবিশ্বাস ক্রমে সংশয়ের রূপ নিল। সঙ্গে সঙ্গেই সে খুলে ফেলল স্যুটকেসটা। আর খুলতেই একটা ছোট পট করে কিছু একটা ফাটার শব্দ হল।

তারপরেই একটা আর্তনাদ করে উঠল হাইনরিখ। কারন তাড়াহুড়োয় খুলতে গিয়ে সে আমাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে দিয়েছে। আসলে স্যুটকেসটার মধ্যে কায়দা করে একটা কাঁচের বোতল ফিট করা ছিল, যেটা পুরোটাই ভর্তি ছিল ঘন সালফিউরিক অ্যাসিডে। যেই খুলতে যাবে কেসটা, সঙ্গে সঙ্গেই বোতলটা ফেটে যাবে।  আর কড়া সালফিউরিক অ্যাসিড ছিটকে পড়বে পাথরটার ওপর। আর দেখতে হবে না। যত লেখাই থাকুক না কেন, সব অ্যাসিডের ক্রিয়ায় নষ্ট হয়ে যাবে।

দেখলাম, এর মধ্যেই হাইনরিখের হাতের আঙুলগুলো টকটকে লাল হয়ে গেছে। অ্যাসিডের আক্রমণে তার হাতের আঙুলগুলো আর স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে সে। সেই অবস্থাতেও অন্ধ রাগে সে চিৎকার করে উঠল, “আর দেরি নয়। কিল দেম।“

তার পরের ঘটনাগুলোর জন্য বোধহয় কেউই তৈরি ছিল না।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দুটো বড় সাইজের পাথর উড়ে এল বন্দুকবাজদের দিকে। কম করে হলেও পাথরগুলো কুড়ি-তিরিশ কেজি ওজনের। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখলাম, পাঁচজন ধরাশায়ী। পাথরের আঘাতে কারওরই ওঠার ক্ষমতা নেই। যেখানে পাথর গিয়ে লেগেছে তাদের, সেখানে হাড়গোড় যা ছিল, সব গুঁড়িয়ে দিয়েছে।

বাকিরা এবার পাথরগুলো যেদিকে উড়ে এসেছিল, সেদিকে লক্ষ্য করে এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে লাগল। তার জবাবে আরও বড় বড় তিন চারটে পাথর উড়ে এল তাদের দিকে।

দুজন আরও ধরাশায়ী হল। বাকিরাও কেউ অনাহত ছিল না। আর তারপরেই একজন বেরিয়ে এল জঙ্গলের ভেতর থেকে। লাইটহাউসের আলোয় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যুবতীর মুখ চোখ। হাওয়ায় উড়ছিল তার কালো চুল। ডিপ ব্লু রঙের টপ আর কালো জিনস পরিহিত মেয়েটি এগিয়ে আসছে খালি হাতে। কিন্তু তার চোখে সেই শান্ত, প্রাণচঞ্চল ভাব আর নেই। তার জায়গায় বিতৃষ্ণা আর ঘৃণা জায়গা নিয়েছে।

ঝিনুক ব্যঙ্গের হাসি হাসল শুধু। তারপর বলল, “মিস মি?”

সাত

এই অলৌকিক ক্ষমতার চাক্ষুষ প্রমাণ পেয়ে গিয়েছিলাম চোখের সামনেই। তবু বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। কোনও মানুষ এতটা শক্তি ধারন করতে পারে, বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হচ্ছিল।

বলা বাহুল্য, ঝিনুকের এই অসম্ভব ক্ষমতা দেখে বাকি গুন্ডাগুলো ভয়ে কাঁপছিল। এখন তাকে সামনে আসতে দেখে আরও ভয় পেয়ে গুলি চালাতে শুরু করল।

কিন্তু ঝিনুক আবার অসাধ্যসাধন করল। ঐ গুলি চালানোর মধ্যেই সে চূড়ান্ত অ্যাক্রোব্যাটিক মুভমেন্টে বুলেটগুলোকে এড়িয়ে গেল কান ঘেঁষে। তারপর লম্বা লম্বা পায়ে মুহূর্তের মধ্যেই পৌঁছে গেল ঐ তিনজনের কাছে। বন্দুকবাজগুলোও থমকে গিয়েছিল ওর এই অস্বাভাবিক ক্ষিপ্রতায়। আর তারপরই ঝিনুক বিদ্যুতের গতিতে হাত পা চালাতে লাগল। পাঁচ সেকেন্ডও গেল না। তিনজনেই লুটিয়ে পড়ল মাটির ওপর।

তারপর ঝিনুক এগিয়ে এসে আমাদের প্রত্যেকের হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিল একটানে। স্যার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঝিনুককে জড়িয়ে ধরলেন বাঁধনহারা উচ্ছাসে।

ঝিনুকও জড়িয়ে ধরল স্যারকে। আমরা সাক্ষী রইলাম এক মধুর মিলনের।

“কোথায় ছিলি মা? এতক্ষন আসতে সময় নিলি? জানিস না, আমার শরীর খারাপ। এতটা টেনশন দেয় কেউ নিজের বাবাকে?” স্যার ঝিনুকের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন। আমরা বাক্রুদ্ধ তখন, যে ইস্পাতকঠিন মানুষটা এত খারাপ সময়ের মধ্যেও ভেঙ্গে পড়েননি, যার মুখে এক রহস্যময় হাসি সারাক্ষণই লেগে থাকতে দেখেছি কলেজে পড়ার সময় থেকে, আজ তাঁর চোখে জল।

“বাবা।” ঝিনুক অস্ফুটে বলে উঠল।

আমি খানিক পড়ে গলা ঝেড়ে কাশলাম। তখন ঝিনুক, স্যারকে ছেড়ে দিয়ে সবার সামনে এসে দাঁড়াল।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কি করে জানলে আমরা এখানে আছি, ঝিনুক?”

ঝিনুক পরিষ্কার বাংলায় বলল, “ঐ কিডন্যাপারদের থেকে পালানোর পর আমি এদিক সেদিক ঘুরছিলাম খাবারের আশায়। ওরা খেতেও দেয়নি এই কয়েকদিন ভালো করে। তারপর একটা বেকারি থেকে খাবার চুরি করে পালালাম। পালিয়ে পালিয়ে ঘুরলাম থিবার রাস্তাঘাটে।

পরে রাস্তার লোকজনদের জিজ্ঞেস করে জানলাম কিডন্যাপাররা মারা গিয়েছে। তখন থিবা থেকে হেঁটেই বাড়ি ফিরলাম। কিন্তু যখন বাড়ি ঢুকছিলাম, দেখলাম, বাড়ির মধ্যে উত্তেজিতভাবে আলোচনা চলছে। আমি বাড়ির পেছনেই দাঁড়িয়ে শুনছিলাম তোমাদের কথা। তোমাদের আলোচনা কানে আসতেই বুঝলাম কি ব্যাপার। তাই তোমাদের পিছু নিলাম।

 

~ কোড নেম: প্রমিথিউস (পর্ব ১৮) ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleকোড নেম: প্রমিথিউস (পর্ব ১৭)
Next articleকোড নেম: প্রমিথিউস (পর্ব ১৯)
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments