আলোর সাথে আচমকাই পরিচয় হয়ে যায় রাতুলের বাসে। সেদিন রাতুল কলেজ যায়নি। কলেজ স্ট্রিট থেকে কয়েকটা পুরনো বই কিনে বাসে ওঠে শ্যামবাজার পাঁচ মাথায় আসার জন্য, সেখান থেকে তিরিশ বি অথবা এগারো এ বাস ধরে পৌঁছাবে বাড়ি। হেঁদুয়ার মোড়ে এসে দেখতে পায় বাসের জানলা দিয়ে, এগারো এ নম্বর বাস দাঁড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি হুড়োহুড়ি করে নেমে দৌড়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকা এগারো এ বাস। বেশি ভীড় না থাকলেও খালি নেই বসার জায়গা, লেডিস সিট প্রায় খালি। দোতালায় সিট খালি আছে কিনা দেখার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই, শুনতে পায় – ” শুনছেন, রাতুল-দা। আপনি এখানে এসে বসুন। ”
রাতুল একটি মেয়েলি গলার আওয়াজ শুনে ঘুরে তাকায়, স্কুলের ড্রেস পরিহিত একটি মেয়ে তাকে হাতের ইশারা করে ডাকছে। চেনা-চেনা লাগছে, কোথায় দেখেছে ঠিক খেয়াল করতে পারছে না। সামনে এগিয়ে দাঁড়াতেই, মেয়েটি বলে, ” আপনি আমার পাশে বসে পড়ুন, পুরোটাই খালি। ”
” যদি কোনো মহিলা ওঠে ? ”
” আমি রোজ স্কুল থেকে এই-সময় ফিরি, বাস পুরো খালি থাকে। পুরো পাঁচজনের সিটটাই খালি। আপনি আমার পাশে বসুন। ”
রাতুল একটু ইতস্তত করে বসে পড়ে। ” তোমাকে চেনা-চেনা লাগলেও ঠিক বুঝতে পারছি না, তুমি কি আমাদের পুলিশ কলোনীতে থাকো ? তুমি আমার নাম জানলে কি করে ? ”
” আপনাকে পাড়ার সবাই চেনে। আপনি হায়ার সেকেন্ডারিতে আমাদের এতবড়ো পুলিশ কলোনীতে সবচেয়ে বেশি নাম্বার পেয়েছেন, ম্যাথসে অনার্স মার্কস পেয়েছেন, ফিজিক্সে দু নম্বরের জন্য মিস করেছেন। আপনাকে চিনবো না ! মোট ছয়জন এবার আমাদের পাড়া থেকে পরীক্ষা দিয়েছিলো। আপনি তো কারুর সাথে মেশেন না, সবসময় গম্ভীর থাকেন। চিনবেন কি করে আমাদের ? আমার নাম আলো, খাতায়-কলমে অপর্ণা। আজ আমার খুব আনন্দ, বন্ধুদের কাছে বিরাট ঘ্যাম নেবো। রাতুল-দা আমার পাশে বসে বাসে করে একসাথে এসেছে, কথা বলেছে। ”
( রাতুল হায়ার সেকেন্ডারির লাস্ট ব্যাচ। ওই বছর থেকেই মাধ্যমিক পরীক্ষাও প্রথম ব্যাচ চালু হয়েছিল, তার দু’বছর পর থেকে উচ্চ মাধ্যমিক। )
” তুমি আমার রেজাল্ট এতো ডিটেইলে জানলে কি করে ? ”
” আপনি প্রত্যেক সাবজেক্টে কত পেয়েছেন, সবাই জানে। আপনার মা তো সবাইকে গর্ব করে বলেছেন। কিন্তু আপনি খুব গম্ভীর, মনে হয় আপনি খুব অহংকারী। ”
রাতুল সামনের দিকে তাকিয়ে বলে, ” তুমি শুনেছ অথবা জানো কিনা জানি না, আমরা আগে নৈহাটীতে থাকতাম। আমি যখন ক্লাশ ইলেভেনে পড়ি বাবা ট্রান্সফার হয়ে এখানে এসেছেন। আমি নৈহাটী স্কুল যেখানে পড়তাম সেখান থেকেই পরীক্ষা দিই। আমি সপ্তাহের তিনদিন রোজ ভোরে বেরিয়ে লোকাল ট্রেনে নৈহাটী যেতাম ইংলিশ-বাংলা টিউশন নিতে। তারপর আবার ট্রেনে ফিরে, বাড়ি এসে – চান করে, খেয়ে স্কুলে ছুটতাম। স্কুলের দু’ঘন্টা পরে থাকতো ম্যাথস-ফিজিক্সের টিউশন। মাস্টারমশাই থাকতেন গরিফাতে, নৈহাটী থেকে আধা ঘন্টা লাগতো বাসে করে যেতে। আমি আর বাড়ি ফিরতাম না, একবারে টিউশন সেরে অনেক রাতে বাড়ি ফিরতাম। এটা একটা কারণ, আমার সাথে প্রথম থেকেই দমদমে আসার পর কারুর সাথে পরিচয় হয়নি। তাছাড়া আমি একটু মুখচোরা, সহজে মিশতে পারি না কারুর সাথে। তবে হায়ার সেকেন্ডারি রেজাল্টের পর, যারা আমার সাথে পরীক্ষা দিয়েছিলো – তারা নিজেরা এসে আমার সাথে আলাপ করে।”
” আপনি বেশ কষ্ট করেছেন বোঝা যাচ্ছে। ”
দু-জনেই চুপচাপ বসে আছে অনেকক্ষণ। বাস টালা ট্যাঙ্ক পেরিয়ে প্রায় চিড়িয়ামোড়ের কাছে চলে এসেছে।
” আপনি কি মেয়েদের দিকে তাকান না ! ”
রাতুল হঠাৎ ভ্যাবাচেকা খেয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে দেখে, মুখে একটা দুষ্টুমি ভরা মিষ্টি হাসি।
দুষ্টুমি ভরা হাসিটা বজায় রেখে পরের প্রশ্ন, ” আপনি বোধহয় মেয়েদের সাথে বেশি কথাও বলতে চান না ! ভালো রেজাল্ট করেছেন বলাতে, আপনার দেখছি বেশ অহংকার ! ”
” না না তা নয়। আমি তো তোমাকে বলেছি, আমি একটু মুখচোরা। একটা গ্রাম্যতার ভাব আমার মধ্যে হয়তো জড়িয়ে আছে। বেশি কথা চট করে বলতে পারি না। ”
বলতে বলতেই বাস রেডিও কলোনী স্টপে চলে আসে, পরের স্টপে ওদের নামতে হবে।
হঠাৎ রাতুলকে চমকিয়ে, আলো ওর হাত ধরে রেডিও কলোনী স্টপে নেমে পড়ে।
” এখানে কেন নামলে ? আমাদের পরের স্টপে নামলে কম হাটতে হতো। ”
” ইচ্ছা করেই নেমেছি, আপনার সাথে কথা বলবো তাই। আপনার এই মুখচোরা, লাজুক ভাবটা কাটানোর জন্য।”
রাস্তা পেরিয়ে, আলো বলতে থাকে, ” শুনুন রাতুলদা, আমাদের বিল্ডিংয়ে ডালিয়া বলে একটা মেয়ে থাকে। দেখতে খুব ফর্সা, ভালো দেখতে বলে খুব অহংকারী। ও আপনার সাথে আলাপ করার জন্য পাগল। আজকে আমি তো সবাইকে বলবো বেশ রেলা নিয়ে – আপনার সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। ডালিয়া হিংসায় জ্বলে যাবে। আপনার সাথে কথা বলার জন্য খুব চেষ্টা করবে, আপনি একদম পাত্তা দেবেন না। বুঝেছেন তো ঠিক করে। ”
রাতুল বুঝতে পারে, মেয়েটা একটু ফচকে – ফাজিল হলেও, মনের দিক থেকে অনেকটাই শিশু।
রাতুল এবার ভালোকরে তাকিয়ে দেখে আলোকে। একটু রোগার দিকে হলেও ভারী মিঠে চেহারাখানা। প্রথমে নজরে পড়ে না, একটু তাকিয়ে থাকলে বোঝা যায় ওর সৌন্দর্যটা।
ওরা ওদের পুলিশ কলোনীর গেট দিয়ে ঢুকে পড়েছে। বুঝতে পারছে সবাই ওদের দিকে তাকাচ্ছে। আলোর হাসিতে ভরা মুখ। আলোর বাবা ইন্সপেক্টর, ওদের বাড়িটা একদম গেটের কাছে, রাতুলের বিল্ডিং প্রায় কলোনীর শেষ প্রান্তে।
রাতুল ওদের বাড়ির দিকে এগোতে গেলেই, আলো বোলে ওঠে, ” আপনি কোথায় যাচ্ছেন ? আপনি আমাদের বাড়ি চলুন, মায়ের সাথে আলাপ করবেন। আর আমাকে এতো বড় সুযোগটা হাতছাড়া করাবেন নাকি ! এই প্রথম আমাদের কলোনীতে আপনার সাথে কেউ হেঁটে যাচ্ছে, সবাই জ্বলেপুড়ে যাবে। ডালিয়া দেখতে পেলে খুব মজা হয়।”
রাতুলকে প্রায় হাত ধরে, কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে – নিয়ে যায় ওদের বাড়ি। তখন প্রায় বিকেল চারটে বাজে।
মাসিমাকে দেখলেই বোঝা যায়, একদম সাধা-সিধে মানুষ। রাতুল মাসিমাকে প্রণাম করার পরে, আলো হৈ হৈ করে বলে, ” দেখো কাকে ধরে এনেছি। ”
মাসিমা তটস্থ হয়ে রাতুলকে বসিয়ে কি করবেন বুঝে পান না। সবসময়ের একটা কাজের লোক বাড়িতে থাকে বলে মনে হয়। পরে রাতুল জানতে পারে, কাজের লোকের নাম ছায়া। ওনাদের গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছেন, এখানেই থাকে।
” কি খাবে বলো ?” মাসিমা জিজ্ঞেস করেন রাতুলকে। আলো বোধহয় স্কুলের ড্রেস ছাড়তে গেছে।
” না, না – আপনাকে এতো ব্যাস্ত হতে হবে না। আলো জোর করে আমাকে ধরে আনে। আমি এখন বাড়ি যাই। ”
” তুমি আলোকে ভালোকরে চেনো না, প্রথম আলাপ তো। একদম বাচ্চাদের মতো। তুমি চলে গেলে, বকে আমার মাথা খেয়ে দেবে। আলোর জন্য পরোটা-তরকারি করছে ছায়া। তোমারও নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে, ওর সাথে পরোটা-তরকারি খাও। ”
খেতে-খেতে মাসিমা জানতে চান রাতুলের বাড়ির কথা, কে কে আছে – কি করে।
বলেন, ” আমার মেয়েটা পড়াশোনায় ভালো হলেও, একদম অংকে ইন্টারেস্ট নেই। খুব ভালো মার্কস পায় অন্য সব সাবজেক্টে, কিন্তু অংক আর সায়েন্স সাবজেক্টে কোনোরকমে পাস করে। বলে, অংক ভালো লাগে না – আর্টস নিয়ে পড়বে। কিন্তু মাধ্যমিক’টা তো পাস করতে হবে, পরের বছর। তোমার যদি সময় হয়, ওকে একটু অংক আর সায়েন্স সাবজেক্ট’টা দেখিয়ে দেবে। তুমি পড়াশুনায় এতো ভালো, তাই বলছি। আলোর বাবা সন্ধেবেলায় ফিরবেন। তুমি যদি তখন একটু এসে ওনার সাথে কথা বলে নাও। ”
রাতুল দেখতে পাচ্ছে, আলোর মুখ আলোতে একদম ঝলমল করছে। যতটা না রাতুলের কাছে পড়ার জন্য, তার চেয়ে অনেক বেশি – ওর বন্ধুদের কাছে ঘ্যাম নিতে পারবে আজ বিকেলে।
” ঠিক আছে আমি আসবো আটটা নাগাদ। ” বলে রাতুল বেরিয়ে আসে।
আলোর বাবা রাশভারী টাইপের দেখতে হলেও ( মনে হয় রাতুলের ওটা হয়তো ওনার চাকরির পদমর্যাদার খাতিরে ), পরে রাতুল দেখেছে উনি খুব হাসি-খুশি, মজা প্রিয় মানুষ।
মেসোমশাইয়ের সাথে ঠিক হয়, সপ্তাহে তিনদিন সন্ধেবেলায় এসে আলোকে দেখিয়ে দেবে অংক আর সায়েন্স সাবজেক্ট।
টাকা-পয়সার কথা উঠলেই, রাতুল বলে, ” না, না – কিছু দিতে হবে না। আমি এমনিই দেখিয়ে দেব, যাতে আলোর ইন্টারেস্ট আসে অংকের প্রতি। ”
মেসোমশাই সাথে সাথে বলেন, ” সেটা হবে না। কিছু মনে করো না, পারিশ্রমিক না পেলে – কমিট্মেন্ট থাকে না। তুমি হয়তো মন দিয়েই পড়াবে, কিন্তু কিছুদিন পরে তোমার মনে হতেই পারে – কেন ফাল্তু বেগার খাটছি। তখনিই তুমি না চাইলেও মন থেকে, তোমার অজান্তেই – তোমার শেখানোতে একটু ঢিলা আপনা-আপনিই পরে যাবে। আর এটাও ভেবো না, আমি তোমাকে পারিশ্রমিক দেওয়া মানে তোমার থেকে কিছু এক্সপেক্ট করছি। আমি আমার মেয়েকে জানি, অংকে ওর একদম ইন্টারেস্ট নেই ছোট বয়স থেকেই। তুমি চেষ্টা করবে – তার দামই তোমাকে আমি দেব। আর তাছাড়া তোমার নিশ্চয়ই কিছু হাতখরচ লাগে এখন, কলেজে পড়ছো, বাবার থেকে হাতখরচ নেবে না। তোমাকে আমি একশো টাকা করে দেব। পরের সপ্তাহ থেকে তাহলে শুরু করে ফেলো, পারবে ? ”
একশো টাকা ঐ-সময়ে অনেক টাকা। কিন্তু রাতুলের সবচেয়ে ভালো লেগেছিলো মেসোমশাইয়ের কথাগুলো।
রাতুল শুরু করে আলোকে পড়ানোর। প্রথমদিন তো কিছুই পড়ানো গেলো না, শুধু গল্প আর গল্প। ওর বন্ধুদের সবার মুখ একদম চিমশে হয়ে গেছে, আর ডালিয়ার মুখ মনে করে ওর আনন্দে ঘুমই হয়নি এই-কয়দিন নাকি।
” আপনার প্রথম উপার্জন কিন্তু আমার দৌলতে, খাওয়াতে হবে কিন্তু। ”
রাতুল বলে, ” নিশ্চয়ই খাওয়াবো, যদি তুমি সত্তরের উপর অংকে মার্কস পাও। ”
” আপনি খুব কিপ্চুস আছেন, বলে দিতে পারতেন খাওয়াবেন না। আমরা দুজনেই জানি, আমি অত মার্কস কোনোদিন অংকে পাবো না।”
রাতুলের একটু জেদ চেপে যায়। নিজের মনে একটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে ফেলে।
” আমার একার দ্বারা সম্ভব হবে না। তবে তুমি যদি আমাকে সাহায্য করো, তাহলে হয়তো হতে পারে। ”
” কি করতে হবে আমাকে ? ” আলো জানতে চায়।
” আমি যখন পড়াবো, কিছু বোঝাবো – মন দিয়ে শুনতে হবে। তখন কোনো গল্প করা চলবে না। নিজেকে চেষ্টা করতে হবে অংককে ভালোবাসার। তোমার সাথে এ-কয়দিন কথা বলে বুঝেছি – তুমি বুদ্ধিমান। হয়তো তোমার অংকে একটা ভীতি আছে, যেটা বেশিরভাগ লোকের থাকে – ভীতিটাকে কাটানোর চেষ্টা করতে হবে – আমি সবরকম সাহায্য করবো। ”
” কিন্তু একটা শর্তে। প্রথম দশ মিনিট আপনাকে আমার দু’দিনের জমানো সব মজার ঘটনা শুনতে হবে। তারপর আমি সিরিয়াস, ঠিক আছে। ”
রাতুল ওর পুরোনো মার্কশীট দেখে, সব সাবজেক্টে সত্তরের ঘরে মার্কস – শুধু অংক আর সায়েন্স সাবজেক্টে চল্লিশের ঘরে। মাথা এমনিতে পরিষ্কার। কিন্তু অংকে একটা ভীতি রয়েছে। ধীরে ধীরে প্রথমে ভীতি কাটানোর চেষ্টা করে। কিছু ইজি ট্রিক শেখায় উত্তর মেলানোর জন্য। এতো অল্প সময়ে বেসিক থেকে শেখানো যাবে না। সব চ্যাপ্টার করায় না। ষাট-সত্তর মার্কস পাওয়ার মতো করে কিছু চ্যাপ্টার বেছে নেয়, সেখান থেকেই প্র্যাকটিস করায়। ফিজিক্সেও শেখায় কিছু ট্রিক – ফর্মূলা মনে রাখার, ইউনিট কনভার্সন – প্রবলেম সল্ভ করার। টেস্ট পরীক্ষাতে ষাটের উপর মার্কস পায়। রাতুল তখন প্রায় প্রতিদিনই যেত পড়াতে। মাধ্যমিক পরীক্ষা ভালোই হয় জানায়। মাসিমা – মেসোমশাই দুজনেই বেশ খুশি।
এর মধ্যে রাতুলের দিল্লিতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যাওয়া ফাইনাল। কয়েকদিন পরেই দিল্লি যেতে হবে ভর্তির জন্য। আলোদের বাড়িতে জানিয়ে আসে। জানতে পারে কিছুদিনের মধ্যেই মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোবে।
পূজোর সময় এসে জানতে পারে, ভালো রেজাল্ট করেছে। অংক আর সায়েন্স – দুটো সাবজেক্টেই সত্তরের উপর পেয়েছে। আর্টস নিয়ে ভর্তি হয়েছে।
এরপর রাতুল যতবার গরম অথবা শীতের ছুটিতে এসেছে, বাড়িতে গিয়ে একবার দেখা করা অথবা রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটু কথা বলা – ব্যাস, এই-পর্যন্তই।
—— o ——
রাতুল যখন সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে, শীতের দশ / বারো দিনের ছুটিতে বাড়ি আসে। তখন আলো ক্লাশ টুয়েলভ-এ পড়ে। ওদের বাড়িতে গিয়ে জানতে পারে – ওরা কয়েকদিনের জন্য গ্রামের বাড়িতে যাবে। আলো খুব জোরাজুরি করতে থাকে যাওয়ার জন্য।
রাতুল বলে, ” আমার ফেরার টিকিট কাটা হয়ে গেছে। আমি অতদিন থাকতে পারবো না। ”
” ঠিক আছে, আপনি একদিন থেকে চলে আসবেন। তারও দু’দিন পরে আপনার ফেরার টিকিট। অসুবিধার কি আছে। ”
মাসিমা-মেসোমশাইও অনুরোধ করেন যাওয়ার জন্য।
লোকাল ট্রেনে ক্যানিং স্টেশনে নেমে, টুকটুকে চড়ে ফেরিঘাট, তারপরে ভট্ভটিতে মাতলা নদী পেরিয়ে উদ্দিষ্ট গাঁয়ের ঘাটে পৌঁছানো। ছায়াকে দু’দিন আগে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বাড়ি-ঘর পরিষ্কার করে রাখার জন্য। ভট্ভটিতে চড়ে মাতলা নদী ক্রস করার সময় রাতুলের অনুভব হয় – যদি না আসতো, তাহলে একটা স্বর্গীয় দৃশ্য দেখা থেকে বঞ্চিত হতো। আলো একটা সুন্দর বাসন্তী রঙের সালোয়ার – কামিজ পড়েছে, শীতের নরম রোদে বেশ মিষ্টি লাগছে দেখতে।
মেসোমশাই বলেন, ” এখানে বর্ষার সময় নৌকো, ভট্ভটি প্রায় বন্ধ থাকে। বৃষ্টি, ঝড়ের, বাতাসের তান্ডবে তখন কেউ বেরোতে সাহস পায় না। ”
ঘাটে পাথরের চাতাল ফেলা। ইট দিয়ে সিঁড়ির ধাপ তৈরী করা। সাবধানে শরীরের ভারসাম্য বজায় রেখে উঠতে হয়। বেশ ঠান্ডা, একটু মেঘলা আকাশ। উপরে উঠেই একটা সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ চোখে পড়ে। বিশাল ব্যাপ্ত চরাচর যেন কোল পেতে আছে। বাতাস এসে সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, খেলা করছে, চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে। দেখতে পায় সবুজ গাছ-পালার সমারোহ, ছোট – ছোট কুটির, খড়ের ছাদ – মাটির দেওয়াল। আর বেশ কিছুটা দূরে আব্ছা দেখা যায় একটা টালির ছাদের বাড়ি, সামনে টিনের ছাদ – বোধহয় বাইরের বারান্দার উপর, পাকা দেওয়াল। আলো আঙ্গুল দিয়ে দেখায়, ওটা আমাদের বাড়ি, খুব সুন্দর না !
” অপূর্ব, দারুণ। ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। ” রাতুল জানায়।
ঘাটে কয়েকজন দাঁড়িয়ে ছিল। মেসোমশাই কথা বলছিলেন ওদের সাথে। পড়ে রাতুল জানে, আফজল মিঞা আর তার লোকজন। তারাই এই বাড়ি, জমি – সব দেখাশুনা করে, চাষ করে।
বাড়ির সামনের উঠোনে কিছু নয়নতারা, গাঁদা, গোলাপ – এককোনায় শিউলির গাছ, আর এককোণে রক্তকরবী। একটা মানিকপ্লান্ট বারান্দার থাম জড়িয়ে উঁকি দিচ্ছে টিনের চালের দিকে। চারদিকে আনন্দ একেবারে উছলে পড়ছে। সামনের উঠোন যেন হেসে উঠেছে।
তিনটে ঘর, একটা একটু ছোট। পিছনে ঢালাও বারান্দা – উপরে টিনের শেড, একপাশে রান্নাঘর। ছায়াকে দেখতে পায় – রান্নাঘরে ব্যাস্ত।
পিছনে নিকানো উঠোন, মাঝে তুলসী মঞ্চ, উঠোনের শেষে একটা কুয়ো – সাথে জলের পাম্প। একটা সজনে গাছ – অজস্র কচি সজনে ঝুলে আছে বৃষ্টিধারার মতো। উঠোন পেরিয়ে কয়েকটা আম গাছ, পাশে ছোট করে একটা সবজির বাগান – বেগুন, কুমড়ো, লঙ্কা ফলে আছে। যতদূর চোখ যায় – দিগন্ত ব্যাপী ধানের ক্ষেত। কিছুদিন আগে ধান কাটা হয়েছে, মাঠে রয়ে গেছে খড়ের গোড়াগুলো। মাড়াই চলছে, পাশে ধানের গোলা। আফজল মিঞার লোক কাজ করে। পাশে খড়ের স্তূপ রাখা আছে, লুটোপুটি খাচ্ছে কয়েকটা বাচ্চা ছেলে মেয়ে, কি মিষ্টি তাদের হাসি।
মেসোমশাই পিছনের উঠোনে রাতুলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলেন, ” কেমন লাগছে রাতুল ? ”
” এক-কথায় আমি বাক্যহারা। আমার শৈশব কেটেছে গ্রাম-ঘেঁষা ছোট্ট টাউনে। আমি নিজেকে যেন আবার কানেক্ট করতে পারছি আমার শৈশবের সাথে, গ্রাম-বাংলার সৌন্দের্যের সাথে। ”
মেসোমশাই নরম গলায় বলতে থাকেন, ” এখানেই আমি মানুষ। বাবা স্কুলটা পাস করেছিলেন, তারপর চাষ-বাস নিয়েই এখানে থাকতেন। আমি একটু বড় হলে, কলকাতাতে পড়তে পাঠিয়ে দেন, মামার বাড়ি থেকে পড়েছি। কিশোর বয়সেই নৌকো বাওয়া, মাছের জাল ফেলা, হাল চাষ করা সব শিখেছি। জীবনটাকে সাপ্টে ধরতে হলে এসবও দরকার হয়। লাঙল চালালে মাটির সাথে একটা বোঝাপড়া হয়। ”
এরমধ্যে মাসিমা এসে দাঁড়ান। আলো কখন এসে পাশে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি রাতুল।
” বাপি এখানে আসলে একদম নস্টালজিক হয়ে যায়, রাতুল-দা। অনেক কাহিনী, অনেক গল্প শুনতে পাবেন বাপির থেকে। এবার বুজতে পারছেন, না আসলে কি মিস করতেন ! ”
আলোর মা এবার বলেন, ” তুমি ছেলেটাকে এবার একটু ফ্রেশ হতে দাও, সারাদিন আছে গল্প করার। আলো, তুই রাতুলকে নিয়ে গিয়ে একটু দেখিয়ে দে। ”
গরম মুড়ি, একটু তেল আর আদাকুচি দিয়ে মাখা, ওপরে বেশ কিছু বাদাম আর নারকেলের টুকরো – সঙ্গে ধূমায়িত চা। পিছনের বারান্দায় সবাই একসঙ্গে বসে খেতে খেতে গল্প হচ্ছিলো।
মেসোমশাই বলেন, ” এখানে ভোটের সময় ছাড়া বোধহয় কোনও মন্ত্রী বা এম এল এ আসেন না। এই গাঁয়ে একটা হাই স্কুল আছে, আমি ক্লাস ফোর পর্যন্ত্য পড়েছি এখানে। এই স্কুলের কয়েকজন মাস্টারমশাই রা এখানকার সর্বেসর্বা। তাঁরাই এই গাঁটাকে অনেক কষ্ট করে ধরে রেখেছেন। আমাদের মতো কয়েকজন চেষ্টা করি আর্থিক সাহায্য করতে, যতটা পারি। আমি ঠিক করেছি অবসর নেওয়ার পর এখানে এসে থাকবো। সেইজন্য মাঝে মাঝে এসে জমি, ঘরের দেখাশুনা করে যাই। ”
” হ্যাঁ বাপি, আমারও খুব ভালো লাগে এই গ্রামটা। আসলেই মনটা একদম ফূর্তিতে ভরে যায়। ” আলো বলে।
মেসোমশাই নরম স্বরে বলতে থাকেন, ” এখানকার ডাক্তার কে জানো ? এখানকার দেবুর মুদির দোকানের মধ্যে রতন বসে। ওর কাছে সর্দি, কাশি, জ্বর, পেট ব্যাথা – এই সব মামুলি অসুখের ওষুধ থাকে, ইঞ্জেকশনও দেয়। কলকাতায় একটা ফার্মাসিতে কয়েক বছর চাকরি করেছে, ওই পুঁজি আর ডাক্তারি বিদ্যা। গাঁয়ের লোক ওর থেকেই ওষুধ নেয়। মারাত্মক কিছু হলে ভট্ভটি করে শহরে নিয়ে যায়। সবচেয়ে অসুবিধা হয় বর্ষার সময়, তখন প্রায় সময়ই ভট্ভটি – নৌকো চলে না। আমি ভাবছি, এখানে অবসর নেওয়ার পরে এসে একটা ছোটোখাটো চিকিৎসালয় খোলার। একটাই প্রব্লেম আছে, ডাক্তার আর নার্স জোগাড় করা। নার্স হয়তো হয়ে যাবে, কিছু পড়াশুনা জানা এখানকার মেয়েদের কলকাতা পাঠিয়ে দেওয়া যেতে পারে ট্রেনিং-এর জন্য। আমি এখানকার মাস্টারমশাইদের সাথে কথা বলেছিলাম। ওনারা বলছেন, আমি আসলে পরেই সবাই মিলে একটা উদ্দ্যোগ নেয়া যাবে। ”
” বাপি তুমি এসব নিয়ে ভেবো না। শুরু একবার করলে সব এক-এক করে হয়ে যাবে। ক্যানিং অথবা গোসাবা থেকে ডাক্তার জোগাড় হয়ে যাবে। অনেক ভালো মানুষ আজও আছেন, তোমাদের উদ্দ্যোগ দেখে নিশ্চয়ই এগিয়ে আসবেন। আমি রাতুল-দা’কে নিয়ে একটু গ্রামটা ঘুরিয়ে দি। ”
” হ্যাঁ তাই করো, ওকে দেখিয়ে দাও গাঁ’টা। তবে সাপের থেকে একটু সাবধান। আগে অবশ্য অনেক সাপ ছিল, এখন বসত বাড়ছে – তাই আস্তে আস্তে নিকেশ হয়ে যাচ্ছে। তবে বেশিরভাগই এখন হেলে, ঢোড়া সাপ দেখা যায় – বিষহীন। ”
শীতের নরম রোদে কিছুটা ইট বাঁধানো কিছুটা খোয়াইয়ের রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছে দু’জন, রাতুল ও তার ক্ষণসময়ের ছাত্রী আলো। দেখতে পায় কয়েকটা মনোহারি, মুদির দোকান। খড়ের ছাদ। কিছু চায়ের দোকান – কয়েকটা পুরোনো বাঁশের খুঁটির উপর খড় অথবা তালপাতার ছাউনি। হেলে পড়া ধুলোমাখা নড়বড়ে বেঞ্চি, বসে আছে কিছু গাঁয়ের লোক। গনগনে আঁচের উত্তাপে হচ্ছে চা – সস্তা বিস্কুট চায়ে ডুবিয়ে – ছোট ছোট দুঃখব্যাথা, নিত্যদিনের নুন-তেল-হলুদের আলোচনায় মগ্ন। রাস্তার দু-পাশে দীর্ণ ছোট ছোট কুটির। গাছ-পালায় ভর্তি সবুজের সমারোহ। কয়েকটি শিশু খেলে বেড়াচ্ছে নিকানো উঠোনের প্রাঙ্গণে, মায়েরা ব্যাস্ত ঘর-কন্নার কাজে, পুরুষেরা চলেছে হেঁটে – সাইকেলে পণ্য-সামগ্রী নিয়ে।
আর একটু গাঁয়ের দিকে ঢুকতেই, আলো বলে, ” রাতুল-দা গরম গরম জিলিপি খাবেন ? শালপাতার ঠোঙায় দেবে। দারুণ স্বাদ, মুচমুচে। খুব ভালো বানায় এই সামনের দোকানটাতে। ”
রাতুল জিলিপিতে কামড় দিয়েই বুঝতে পারলো – খুবই ভালো স্বাদ।
দোকানীটি বলে, ” বোনটি, তুমি তো মুখার্জী বাবুর মেয়ে – তাই না ? আজকে এলে ? গরম সিঙাড়া খাও, কড়াইশুঁটি আর ফুলকপি দিয়ে বানিয়ে রেখেছি – গরম গরম ভেজে দিচ্ছি এখুনি। ”
যদিও রাতুলের পেট ভর্তি, কিন্তু না করতে পারলো না।
আর কিছুক্ষণ হাঁটার পর, আলো জানতে চায়, ” আপনি সাঁতার জানেন, রাতুল-দা ? ”
” হ্যাঁ জানি। অনেক ছোট থাকতে দেশের বাড়ির পুকুরে শিখেছি। ”
” আমি জানি না। নৌকো’তে উঠতে ভয় করে। কিন্তু বেশ মজাও আছে, তাই না ? চলুন নৌকো করে একটু বেরিয়ে আসি। জলে পড়ে গেলে আপনি বাঁচাতে পারবেন না ? ”
ওরা অন্য একটা ঘাটে এসে দেখে, কয়েকটা ডিঙি নৌকো আছে। একটাতে রাতুলের বয়সী ছেলে বৈঠা নিয়ে বসে আছে। ঢেউয়ে এদিক-ওদিক হেলছে-দুলছে তার ছোট নৌকোটা। ঘন্টা খানেক ঘোরানোর জন্য পাঁচ টাকা চাইলো। আলো যতবার উঠতে যায়, নৌকোটা টাল খেয়ে সরে যায়। ছেলেটা তখন জলে নেমে নৌকোটা ধরে রইলো, তারপর আলো উঠতে পারে।
আলো বলে, ” সবসময় ফেরিঘাট থেকে ভট্ভটিতে আসি, এই প্রথম নৌকোতে চড়লাম। ”
নৌকোতে পাটাতন বলে কিছু নেই, দুটো কাঠ আড়াআড়ি পাতা আছে। মুখোমুখি বসলো দু’জনে। আলোর মুখে একটা ভয় মিশ্রিত হাসি।
” ভয় পেয়ো না। সহজে ডোবে না। ”
আলো খিলখিল করে ওর দুষ্টুমিভরা হাসি নিয়ে বলে, ” একটু ভয় পাওয়ার ভান করতে হয়, মশাই। তবেই না মজা। ”
মাঝি ছেলেটা চালাক। নতুন আর আনাড়ী দেখে বড় গাঙের দিকে নেয়নি। খালের ভিতর ঢুকে এগোতে লাগলো। খালের ভিতর দেখার বিশেষ কিছু নেই। কিছু বাড়িঘর, কুটির, আর বেশির ভাগই আগাছায় ভরা।
চুপচাপ বসে আছে দুজনেই অনেকক্ষণ। হঠাৎ আলো প্রশ্ন করে, ” আচ্ছা রাতুল-দা, আপনাদের ক্লাসে কজন মেয়ে পড়ে ? কারুর সাথে আলাপ আছে ? ”
” না, আমাদের ক্লাসে কোনো মেয়ে নেই। মেয়েরা এখনো মেকানিকাল নিয়ে পড়তে সাহস পায় না। ইলেকট্রনিক্স আর ইলেক্ট্রিক্যাল ব্রাঞ্চে বেশ কয়েকজন মেয়ে আছে। ”
” আপনার সাথে কোনো মেয়ের আলাপ হয়েছে ? ”
” না। আড়াইশো ছেলের ভিড়ে বোধহয় হাতে গোনা পাঁচ-ছয়জন পড়ে। অন্য ব্রাঞ্চে পড়ে, লম্বা লাইন ওদের পিছনে। আমাদের সুযোগ কোথায় ? ”
” খুব ভালো, আপনি মেকানিকাল ব্রাঞ্চ নিয়ে পড়ছেন। ”
” কেন ? ইলেকট্রিকাল – ইলেকট্রনিক্স নিয়ে পড়লে কি হতো ? যদিও মেকানিকাল আমার প্রথম চয়েস ছিল। ”
” আপনি প্রচন্ড সিধে-সাধা। ওদের পাল্লাতে পড়লে আপনার বাবার কষ্টের পাঠানো টাকায় আপনার মাস চলতো না। ”
হঠাৎ মাঝি ছেলেটা – ঘাট এসে গেছে – বলতেই দু’জনে উঠে পড়লো।
দুপুরের খাওয়া সেরে, যখন দুপুর গড়িয়ে বিকেলকে প্রায় জড়িয়ে ধরেছে – শীতের অলস রোদ্দুরে বাইরের একফালি বারান্দায় সবাই গা এলিয়ে বসেছিল। আদর-ভালোবাসা-মিঠে নরম রোদ্দুরে বুঁদ হয়ে থাকা সামনের উঠোনে উপচে পড়ছিলো ফুল-পাতা। উচ্চস্বরে শিস দিতে দিতে একটা অজানা পাখি উড়ে যাচ্ছিলো। কিছু উড়ন্ত প্রজাপতি গাছের পাতার ফাঁকে, মাঝে মাঝে কাঠবেড়ালীর দৌড় উঠোনের এদিক থেকে ওদিক।
মেসোমশাই বলেন, ” এই যে সোনালী রোদ, আকাশ, গাছপালা, নদী, ঘাট, প্রজাপতি, পাখি, পোকামাকড়, ক্ষেত দেখছো রাতুল – এরা সব যেন এক-একজন শিক্ষক – যেন পাঠশালা সাজিয়ে বসে আছে। বর্ষাতে এখানে প্রচুর জোঁক বেরোয় – ওদের থেকেও শেখার আছে, ওদের টেনাসিটি – আঁকড়ে ধরে থাকে, ছাড়তে চায় না। নদী আমাদের শেখায় পৃথিবীর দেখাশুনা করতে, অন্যের কথা শুনতে ধৈর্য্যভরে। সূর্য্যর থেকে আমরা শিখতে পারি অকাতরে সব কিছু বিলিয়ে দিতে অন্যের জন্য। আকাশ বোঝায় আমরা একা নই এই বিশ্বে। গাছ শেখায় নিজেকে স্ট্রং করতে, অন্যকে ভালোবাসতে। পিঁপড়ের ঐক্যতা আমরা সবাই জানি, আমাদের ফোকাসড থাকতেও শেখায়। পাখিদের থেকে শিখতে পারি প্রকৃতিকে ভালোবাসতে, নিজের খেয়াল রাখতে। ”
রাতুল অবাক হয়ে শোনে মেসোমশাইয়ের নিজের মতো করে এই প্রকৃতিকে জানার, উপলব্ধি করার। এই মুহূর্তে বোঝাই যায় না, উনি একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসার।
” তুমি পিছনে যে ক্ষেত দেখেছো ধান কাটা হয়ে গেছে, তার একটা রূপ সকালে দেখেছো। রাতে যখন চাঁদের জ্যোৎস্নার আলো পড়বে ওই ক্ষেতে, ঐ স্তূপীকৃত রাখা খড়ের উপর – ভাসিয়ে নিয়ে যাবে আলোয় ভরিয়ে – দেখবে আর এক অপরূপ দৃশ্য, এক অবর্ণনীয় রূপ। এটা বলে বোঝানো যাবে না, দু’চোখ ভরে নিজেকে উপলব্ধি করতে হবে। ”
আলো মিঠে রোদ্দুরের মতো মুচকি হেসে বলে, ” জানেন রাতুল-দা, এখানে বৃষ্টি যখন নেমে আসে তখন মন ভরে যায়। যদিও বর্ষাকালে এখানে আসা যায় না, আমরা একবার এসেছিলাম আশ্বিন মাসে। হঠাৎ করে বিকেলে আকাশ কালো করে বৃষ্টি। নদীর উপর মেঘলা আকাশের ছায়া পড়ে বৃষ্টির শব্দ শুনতে পাই টিনের চালে, মাটির কোষে কোষে, ঘাসে, গাছে। অপূর্ব দৃশ্য। এটা কলকাতার বৃষ্টিতে শান বাঁধানো শহরে পাওয়া যায় না – নোংরা শহরটা বৃষ্টির জলে আরো নোংরা হয়ে যায়, জল জমে যায়, ড্রেন বন্ধ হয়ে যায়, ট্রাফিক জ্যাম হয়ে যায়, প্যাচপ্যাচে কাদা। এখানকার মতো উপভোগ করা যায় না। ”
রাতুল বুঝতে পারে এবার, কেন আলোর লিটারেচারের প্রতি এতো ইন্টারেস্ট।
রাতুল বলে আলোকে, ” হয়তো তোমার ভিতরে একটা কৌতূহলী শিশু আছে। পৃথিবীটা সহজে পুরোনো হবে না। ”
” আপনি তো আমাকে বিরাট একটা কমপ্লিমেন্ট দিয়ে দিলেন। ”
রাতুল বাইরের ছোট ঘরটাতে শুয়েছে রাত্রে। অনেক রাত অবধি জানালার কাছে খাটের উপর বসে রইলো। বেশ শীত। ঠান্ডা বাতাসে হাড় অবধি কাঁপিয়ে দেয় – ওদের কলেজে যেমন ঠান্ডা পড়ে। তবু জানালা ছেড়ে উঠতে পারছে না। শুনলো তীব্র ঝিঁঝির শব্দ। দেখলো জোনাকির রঙে মিশে যাওয়া শিশিরের দানা, কুয়াশা শিউলির ডালে-পাতায়। কখন এক-সময় ঘুমিয়ে পড়েছে জানে না।
হঠাৎ মোরগের ডাকে ঘুম ভেঙে যায়, চোখ ঠিক করে পুরোপুরি খুলতে পারে না।
জানালা দিয়ে দেখতে পায় চাঁদের স্নিগ্ধ মৃত্যু। আকাশে আলোর আভা, ধীরে ধীরে রাতের তারাকে মুছে দিয়ে – অন্ধকার ঘুঁচিয়ে। মনে হয় এটাকেই ভোর বলে, যেমন ছোটবেলাতে দেশের বাড়িতে দেখতে পেতো। হালকা কুয়াশার মধ্যে দিয়ে ভোরের আলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। দূরে দেখতে পায় নদীর উপরে উঠে আসা সূর্য।
রাতুল ভাবতে থাকে, আলো কি ওর মনে এইভাবেই ভোরের সূর্যের মতো আলোর সঞ্চার করে – ঠিক বুঝতে পারে না। মাঝে মাঝে মনে হয় আলোর সঙ্গ বাতাসে যেন একটা আনন্দের বার্তা বয়ে নিয়ে আসে। না এটা ঠিক হচ্ছে না। ঠিক করে এখনই বেরিয়ে পরবে কলকাতার উদ্দেশে। যদিও ওর যাওয়ার কথা ছিল দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর।
সাথে সাথে রেডি হয়ে নেয়। ছায়া রান্নাঘরে কাজ করছে। জানতে পারে – শুধু মেসোমশাই অনেক ভোরে বেরিয়ে পড়েছেন আফজল মিঞার সাথে ক্ষেতের দিকে।
ছায়াকে ওর বেরিয়ে যাওয়ার কথা বলতে – ও বলে, ” আপনি এখন কি যাবেন, দাদাবাবু। এখনো মাসিমা, দিদিমণি ওঠেননি। আমাকে খুব বকাবকি করবেন। খালি মুখে যাবেন কি করে। চা পর্যন্ত্য খাননি। ”
” ঠিক আছে, তুমি এক গ্লাস জল আর দুটো বাতাসা দাও আমাকে। তুমি একটু ম্যানেজ করে নিও। বোলো, দাদাবাবুর হঠাৎ একটা কাজের কথা মনে পড়াতে বেরিয়ে গেছে। ”
ভট্ভটিতে বসে রাতুল ছেড়ে আসা ঘাট আর দূরে অস্পষ্ট ভাবে দেখতে পাওয়া বাড়িটার দিকে চেয়ে ছিল। একটু কি মায়া জন্মে গেল।
রাতুল বিকেলে বেরোতে পারতো। কিন্তু ওর নিজের সাথে একটা লড়াই দরকার হয়ে পড়েছে। আলোকে কেন এতো ভালো লাগতে শুরু করেছে ? কেন এতো বেশি ভালো লাগছে ? এটা কি ঠিক, হওয়া উচিত ?
ঠিক করলো – দু’দিন পরেই তো কলেজে চলে যাচ্ছে, এর মধ্যে ওরা ফিরছে না। এবার থেকে ওদের বাড়ি, ওকে এড়িয়ে চলতে হবে। চিন্তায় হানা দিলে – কলেজের পড়া, হোস্টেলের বন্ধুবান্ধব নিয়ে ব্যাস্ত থাকতে হবে। দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দিলে চলবে না। ওর ঘাটতিগুলোকেই প্রাধান্য দিতে হবে।
রাতুল হোস্টেলে যাওয়ার জন্য রেডি। কাল সকালে বেরিয়ে যাবে। বিকেলে মার সাথে গল্প করছে। শেষ মুহূর্তে মা নিমকি, নাড়ু বানিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। হঠাৎ দরজাতে কড়া নাড়ার আওয়াজ। দরজার বাইরে ছায়া দাঁড়িয়ে।
” তোমাদের তো আরো দু’দিন থাকার কথা ওখানে। ”
” আপনাকে এখুনি বাড়িতে আসতে বলেছেন দিদিমণির মা। ”
” ঠিক আছে, বোলো গিয়ে – আসছি। ”
রাতুল চুপচাপ বসে আছে দেখে, মা বলেন, ” তুই গেলি না ? তাড়াতাড়ি ঘুরে আয়, তার মধ্যে নিমকি গুলো রেডি হয়ে যাবে। ”
অগত্যা রাহুলকে বেরোতে হয়।
মাসিমা বলেন, ” তুমি হঠাৎ এরকম করে চলে আসলে কেন ? বলে তো আসবে। চা-টুকু পর্যন্ত্য না খেয়ে বেরিয়ে পড়েছো। আমাদের কি কোনো ভুল হয়েছে, কোনো আঘাত দিয়েছি তোমাকে ? মেয়ে তো ওর বাপিকে আজকে ফেরার জন্য পাগল করে দিয়েছে। নাহলে তোমার সাথে আর দেখা হবে না, তুমি কেন চলে আসলে জানা হবে না। ”
“না না, মাসিমা। বুঝতে পারছি আমার বিরাট অন্যায় হয়ে গেছে। আসলে মনটা একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিলো মার জন্য, তাছাড়া প্যাকিং পুরো বাকি ছিল। ”
এইসময় হঠাৎ আলো ঘর থেকে বেরিয়ে আসে, ” কি রাজ্যের প্যাকিং ছিল আপনার। কয়েকটা শার্ট আর প্যান্ট – এইতো নেবেন। তার জন্য দু’দিন ধরে প্যাকিং। আমি জানি, আপনি আমার উপর বোধহয় রেগে গিয়ে চলে এসেছেন। এ-রকম আর করবেন না। ”
কিছুক্ষণ থেকে একটু গল্প করে রাতুল চলে আসে। মেসোমশাইয়ের সাথে দেখা হয় না। উনি বাড়ি আসতে আসতেই অফিস থেকে ডেকে নিয়ে যায়, কোনো আর্জেন্ট কাজের জন্য। ওনার অফিস পুলিশ কলোনীর ভিতর ছিল, মাঝে মাঝে দরকার পড়লে লালবাজার যেতেন।
নেক্সট সামার ভ্যাকেশনে যখন আসে, জানতে পারে – আলোর বাবার বদলি হয়ে গেছে, কৃষ্ণনগরে।
রাতুল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
দু-এক বছর পরে, কথায়-কথায় দিদি হঠাৎ প্রশ্ন করে রাতুলকে, ” তুই যে একটা মেয়েকে টিউশন দিতিস, কি নাম যেন। ওরা এখন কোথায় ? ”
একটু স্তব্ধ হয়ে থাকে রাতুল। বুকের অন্তঃস্থলে থিতানো জলে একটু নাড়া পড়লো কি ?
মা বলেন, ” ওনারা চলে গেছেন এখান থেকে দু’বছর আগে। কৃষনগরে ট্রান্সফার হয়েছেন ভদ্রলোক। ”
—— o ——
” এটা ধরেছেন কবে থেকে ? এই গুণটা আপনার আছে, জানা ছিল না আগে ! ”
আচম্কা একটা গলার আওয়াজ শুনে চমকে যায়, চেনা চেনা লাগছে রাতুলের।
রাতুল ওর অফিসের কলিগদের সাথে শরৎ-সঙ্গম হলে সিনেমা দেখতে এসেছে, রোববার ছুটির দিনে। ইন্টারভ্যালের সময় একটা সিগারেট ধরিয়েছিল এককোণে দাঁড়িয়ে।
মুখ ঘুরিয়ে দেখে, সেই দুষ্টুমিভরা হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আলো। এই প্রথম যেন রাতুলের ইচ্ছা করে আলোর মুখ থেকে এই দুষ্টুমি ভরা সুন্দর হাসিটা খুঁটে তুলে নিতে। সাথে দাঁড়িয়ে আছে আর একটি মেয়ে, একটু ছোট হবে মনে হয় আলোর থেকে।
” পরিচয় করিয়ে দিই। রাতুল-দা, এ হচ্ছে মিমি – আমার মাসির মেয়ে। রাতুল-দা আমাকে মাধ্যমিকের সময় অংক করাতেন। মিমি তুই হলে ঢুকে যা, নইলে মাসি-মেসো চিন্তা করবেন। আমি রাতুল-দার সাথে একটু কথা বলে আসছি। অনেকদিন পর দেখা। ”
মিমি রাতুলকে ” হ্যাল্লো, হ্যাভ এ গুড টাইম। বাকি সিনেমাটা না দেখলেও চলবে। ” বলে চলে যায়।
” তোমার বোন কি ভাবলো বলো তো ? ”
” ও কোনো ব্যাপার নয়। মিমি আমার মতনই একটু ফাজিল-ফচকে আছে। আপনি তো আমার ফাজলামিতে অভ্যস্ত। আপনি কিন্তু বেশ রোগা হয়ে গেছেন ? কেউ মনে দাগা দিয়েছে নাকি ! ”
রাতুল ছিপছিপে সুন্দর মেয়েটার দিকে চেয়ে ভাবতে লাগলো, আলো কি ওকে নিয়ে মজা করছে নাকি ? আরও ফাজিল হয়েছে বোঝা যাচ্ছে !
” তুমি হঠাৎ এখানে ? ” রাতুলের প্রশ্ন আলোকে, কথা ঘোরাবার জন্য।
” মেসোর ভাইজ্যাগ স্টিল প্লান্টে কিছুদিন হলো পোস্টিং হয়েছে। কয়েকদিন ইউনিভার্সিটি ছুটি আছে, ঘুরতে এসেছি। আপনি কোথায় কাজ করেন ? আপনি তো আর আমাদের কোনো খোঁজই রাখলেন না। ভাবলেন, বেঁচে গেছি আলোর হাত থেকে। ”
” আমি পাস করে বি এন্ড আর এ চাকরি পাই, এখানে পোস্টিং হয়। বড় কাজ চলছে রিফাইনারিতে। এরপর ভাইজ্যাগ স্টিল প্লান্টে বোধহয় পোস্টিং হবে, ওখানেও একটা বড় কাজ পাওয়ার কথা চলছে।”
” তাহলে তো বেশ ভালোই আছেন দেখছি ! ”
” আলো, আমি গরমের ছুটিতে এসে জানতে পারি তোমরা কৃষ্ণনগর চলে গেছো। তোমাদের ঠিকানা জানতাম না। কিন্তু তুমি আমাদের বাড়িতে জানিয়ে যেতে পারতে। তাছাড়া, তুমি চাইলে আমার কলেজের ঠিকানায় চিঠি দিতে পারতে। ”
” হ্যাঁ পারতাম, আপনার কলেজ অথবা বাড়ির ঠিকানায় চিঠি দিতে। কিন্তু দিইনি ইচ্ছা করে। দেখছিলাম, আপনার কোনো টান আছে কিনা আমার প্রতি ! আপনি যদি মন থেকে চাইতেন আমার সাথে যোগাযোগ করার, তাহলে আপনি আপনাদের পুলিশ কলোনীর অফিস থেকে বাপির নতুন অফিসের ঠিকানা নিতে পারতেন। আমি কত আশা করে থাকতাম, আপনি চিঠি দিয়ে নয় – একদিন সোজাসুজি কৃষ্ণনগরে চলে আসবেন বাপির অফিসে অথবা আমাদের কোয়ার্টারে। ”
রাতুল আবার কথা ঘোরাবার জন্য জানতে চায়, ” তুমি এখন কি করছো ? ”
” আপনি আমাকে এতটা বোকা ভাববেন না ! আপনি কথা ঘোরাচ্ছেন। ঠিক আছে। আমি কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে বাংলাতে অনার্স নিয়ে পাস করে এখন কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স করছি। লেডিজ হোস্টেলে থাকি। ”
” মেসোমশাই মাসিমা ? ”
” বাপি অবসর নিয়ে এখন গ্রামে আছে দু’জনে। বাপি এখন চিকিৎসালয় খোলার জন্য খুব ব্যাস্ত, বেশ দৌড়োদৌড়ি করছে। আপনি কাল সকালে মেসোর বাড়ি চলে আসুন না ! মাসি-মেসোর সাথে আলাপ হয়ে যাবে। মেসো লাঞ্চ করতে বাড়ি আসে। আপনি দুপুরে ওখানেই খাবেন। একদিন ছুটি নিন, জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে। ”
” না আলো, কালকে হবে না। কালকে একটু ইম্পরট্যান্ট কাজ আছে। তুমি আছো তো এখন, দু’একদিনের মধ্যে ঠিক আসবো। ”
” বুঝেছি, আপনাকে আসতে হবে না। আমি কাল করমণ্ডল ট্রেনে ব্যাক করবো কলকাতা। ” আলোর মুখ ভার। বেশ বোঝা যাচ্ছে অভিমান হয়েছে।
” তোমাকে মুখ ভার করে থাকতে হবে না আর। আমি কাল স্টেশনে আসবো তোমার সাথে দেখা করতে। ”
” কথা দিলেন কিন্তু, একটু তাড়াতাড়ি আসবেন। ”
” কথা দিলাম, এবার চলো হলে ঢোকা যাক। নইলে কলিগরা আমার পিছনে লাগবে রাত্রে ! ”
—— o ——
সাইট থেকে বেরোতে বেশ দেরিই হয়ে গেলো।
কিছুদিন আগে – বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে, বাকি সবাই চলে গেছে। রাতুল সাইট থেকে অফিসে এসে দেখে, রেসিডেন্ট ম্যানেজার-এর ঘরে বেশ চিন্তাগ্রস্ত মুখে উনি আর ওনার ডেপুটি একটা ড্রয়িং টেবিলে রেখে বেশ আলোচনায় ব্যাস্ত। রাতুল উঁকি মেরে দেখে, যে কাজটা ও প্রায় অর্ধেক করে এসেছে এইমাত্র – ড্রইংটা সেই সংক্রান্ত। ওনারা জানান, এইমাত্র হেড অফিস থেকে ড্রয়িং রিভাইস করে এসেছে। রাতুল যতটা কাজ করে এসেছে, সব আবার ডিসম্যান্টল করে নতুন করে করতে হবে। রাতুল ড্রয়িং’টা দেখে একটু চিন্তা করে একটা সহজ সমাধান দেয় – যেটা আর্কিমিডিস প্রিন্সিপাল এর উপর বেস করে ছিল। এই প্রপোসালটা রেসিডেন্ট ম্যানেজার হেড অফিসে পাঠান। আজ তার এপ্রিসিয়েশন লেটার এবং রাহুলের নামে একটা চেক পাঠায় হেড অফিস থেকে। সবাই ধরে রাহুলকে খাওয়াতে। সেইজন্য দেরি হয়ে যায় বেরোতে।
স্টেশনে পৌঁছে এস-৬ কামরার কাছে এসে দেখে আলো দরজার কাছে দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন মুখে এদিক-ওদিক চাইছে। ট্রেন ছাড়তে বোধহয় মিনিট পনেরো বাকি আছে।
” তুমি কি বলোতো, আমি কখন মাসি-মেসোকে ফেরৎ পাঠিয়ে দিয়েছি। তোমার সাথে একটু আলাদা কথা বলবো বলে। মাসি প্রথমে যেতে চায় না। মিমি বুঝতে পেরে জোর করে নিয়ে গেছে। ”
” সরি, একটু ফেঁসে গিয়েছিলাম অফিসে। ” রাতুল খেয়াল করে, এই প্রথম বোধহয় আলো ‘ তুমি ‘ করে কথা বললো ওর সাথে।
” এবার কিন্তু চিঠি দেবে আমাকে। আগের মতো করবে না। আমিও দেব মশাই চিঠি তোমাকে। এবার পুজোতে আমি গ্রামে যাবো, তুমি কিন্তু নিশ্চয়ই আসবে গ্রামে। অজুহাত দেবে না যে ছুটি পাওনি, অনেক কাজের চাপ। ”
” ভেবো না, আমি ঠিক এবার পুজোতে যাবো তোমাদের গ্রামে। আমারও মন চাইছে আবার ঐ গ্রামে যেতে, মাসিমা-মেসোমশাইয়ের সাথে দেখা করতে। ”
হঠাৎ মৃদু একটা রহস্যময় হাসি হেসে আলো বলে, ” আচ্ছা আমাদের সম্পর্কটা কি – প্রেম ভালোবাসা না বন্ধুত্ব ? ”
রাতুল আনমনা হয়ে তাকিয়ে থাকে আলোর হাসির দিকে, বুঝতে পারে না কি উত্তর দেবে।
এবার ওর স্বভাবসিদ্ধ দুষ্টুমিভরা হাসি দিয়ে বলে, ” ভয় পেও না। আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বটাই আছে। কি, শুনে স্বস্তির শ্বাস ফেললে তো ! ”
রাতুল ক্ষণিকের জন্য ঘাবড়ে যায়। রাতুল তো চার বছর আগে যখন কলেজ থেকে বাড়ি এসে দেখে আলোরা চলে গেছে, ও তখন স্বস্তির নিঃশ্বাসই তো ফেলেছিলো।
নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ” হবে হয়তো ! তবে আমি তোমাকে বেশ পছন্দ করি, আর ভালোও লাগে তোমাকে। ”
” মশাই, সেটা আমারও লাগে। সেই কারণে তুমি যোগাযোগ না রাখলে আমার কষ্ট হয়। হয়তো প্রেম জিনিসটা বন্ধুত্বতার থেকে একটু বেশি কিছু, ঠিক বুঝতে পারি না সবসময়। তবে একটা জিনিস মনে হয়, যখন তুমি আমাকে অংক শেখাতে তখন থেকে – কত ছোট ছিলাম আমি তখন – আমার কত অহংকার হতো, গর্ব হতো – তুমি শুধু আমাকে পড়াও, আর কাউকে নয় – শুধু আমার সাথে কথা বলো পাড়ার মধ্যে – এটা আমার একটা গর্ব ছিলো, আজও আছে সেটা। ”
” এই – ট্রেন এখনই ছাড়বে, গার্ড সবুজ ফ্ল্যাগ ওড়াচ্ছে। উঠে পড়ো তাড়াতাড়ি। ”
” যোগাযোগ রাখবে কিন্তু। আর পুজোতে অবশ্যই আসবে। ”
ট্রেন চলতে শুরু করে। আস্তে আস্তে আবছা হয়ে যায় আলোর হাত নাড়া।
আরে, কথা বলতে বলতে আলোর হোস্টেলের ঠিকানাটাই নেওয়া হয়নি ! পুজোতে ওদের গ্রামের বাড়ি যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই রাতুলের। রাতুলকে যেতে হবে। জানতে হবে – যে প্রশ্নের মুখে আলো আজ তাকে দাঁড় করিয়ে গেলো – তার উত্তর। ওদের সম্পর্কটা আসলে কি ! শুধু বন্ধুত্ব, না তার থেকে বেশি কিছু !
আলো যখনিই আসে ওর জীবনে, একরাশ আলো নিয়ে আসে – আলোয় ভাসিয়ে ভরিয়ে দেয় সবকিছু। যেন আকাশে আলোর দুটি ডানা ধীরে ধীরে অন্ধকার ঘুঁচিয়ে সব তারাকে মুছে দিয়ে ভোরকে আমন্ত্রণ করে আনে। রাতুলের কানে গুনগুনিয়ে ওঠে রবিঠাকুরের গান –
” আলোয় আলোকময় করে হে এলে আলোর আলো।
আমার নয়ন হতে আঁধার মিলালো মিলালো ॥
সকল আকাশ সকল ধরা আনন্দে হাসিতে ভরা,
যে দিক-পানে নয়ন মেলি ভালো সবই ভালো ॥
তোমার আলো গাছের পাতায় নাচিয়ে তোলে প্রাণ।
তোমার আলো পাখির বাসায় জাগিয়ে তোলে গান।
তোমার আলো ভালোবেসে পড়েছে মোর গায়ে এসে,
হৃদয়ে মোর নির্মল হাত বুলালো বুলালো ॥ ”
—— o ——
নোট : গল্পটা ১৯৮০র আশেপাশে সময়ের। তখন ইন্টারনেট, মোবাইল ছিলো না। যোগাযোগের মাধ্যম চিঠি-পত্র দিয়েই ছিলো।