আধুনিক জীবনের স্রোত – তৃতীয় পর্ব : click here
আগের সংখ্যার পর—–
খাওয়া হয়ে গেলে ভাইপো অনুর home tutor এলো। কিন্তু ওঙ্কার খুবই অবাক হলো যে, ভাইপো খাতা-বই না নিয়ে ল্যাপটপ আর নেটকার্ড মোর্ডেম নিয়ে বসল পড়তে। স্যার বললেন,”নেট কানেকশন্ আছে তো ?” —-“হ্যাঁ—”
পরে পাশের ঘর থেকে পড়ার আওয়াজ আসছে,
–“বলোতো, মানুষ সারাদিনে ক’পা হাঁটে ?”
–“এক পা-ও না স্যার! কারন,মানুষ এখন morning walk টা-ও মোটোসাইকেলে করে।”
–“ঠিক বলেছ।”
ওঙ্কার পাখি দেখতে চিরকাল-ই ভালবাসে। সে মাকে বাইরের দিকের ডালে বসে থাকা সুন্দর পাখি-কে দেখিয়ে বলে “মা দেখ ! কি সুন্দর পাখিটা ডানা মিলেছে !”
–“বাজে কাজে সময় নষ্ট না করে নেটে কিছু শিখলে পারো তো !”
–“অ্যাঁ ! ও হ্যাঁ ”
আবার কিছুক্ষন পরে—
–“মা আজ রাত্রেই ভোজ-টা আছে না, কই দেখি কার্ডটা, দাও একবার মিলিয়ে নি।”
–“না,না ওতো বোধ হয় what’s app-এ পাঠিয়ে ছিল ! খুলে দেখে নে তোর বাবার একাউন্টে।”
বিকেলবেলায় পাড়ার মাঠে যেতেই নিজ শৈশবজীবন ভেসে এল ওঙ্কারের মনে। তার মনে আছে এই মাঠেই তারা খেলত প্লাস্টিক বলে, আর এখন ছোট ছোট ছেলেরা ওই মাঠেই খেলছে ডিউস্ বলে। বলে উঠল,”তোরা ডিউস্ বলে খেলিস ? আমিও নেমে পড়ি নাকি ! কোন্ দলে যাব ?”
–“বলি মোটিভ টা কি ? per day 300/-, Member ship 5000/- for one month only” বলে উঠল একটি বার-তেরো বয়সী লম্বা ছেলে। সে হতবম্ব হয়ে ঘরে ফিরে এল। বাবা বললেন,”একটা গাড়ি ডেকে দিবি ? ডাক্তারটা দেখিয়ে আসি !” যাই বলে চটি পরতে গেল ওঙ্কার।
বাবা বললেন,”আরে না,না রাস্তায় গেলে কি আর পাওয়া যায় ? সারা দিন দাঁড়ালেও পাবি না ! বুঝলি, Net-এ ডাকতে হয় ‘car’-Apps-এ।”
–“অ্যাঁ–এটাও—নে–টে”
কিছুক্ষন পরে দাদা ফোন করে বলল,”অনুকে ডাক্তার দেখানো হয়ে গেছে। ওখান থেকে আমরা মলে এসেছি ! cash-নিছে না, কার্ড-ও আনি নি”
–“কোথায় আছে বলো ! যাচ্ছি কার্ড টা নিয়ে।”বলল ওঙ্কার।
–“না।না তার দরকার নেই তুই ‘অনলাইনে প্যায়’ করে দে না”
–“কীভাবে ?”
–“ও তুই তো আবার ন্যাট-এর ‘ন’ বুঝিস না, ঠিকাছে আমি দেখে নিচ্ছি, রাখছি !”
ওঙ্কারের সারাদিন টা কেমন যেন অন্য পৃথিবী্তে বলে মনে হল।
রাত্রে সে বই না পড়ে ঘুমোতে পারে না। এটা সে জানে সু-অভ্যাস, তবে আধুনিক নেটের যুগে যে তা কি, তার পরিচয় সে এখনও পায় নি, তবে তাও সে ওই দিনেই পেল, রাত্রে ! রাত্রে শুতে যাওয়ার সময় সে তার মা-কে জিজ্ঞাসা করে ‘গল্পের বই গুলো কোথায় আছে, মা ?’—“গল্পের বই ? ও তো লোহাভাঙ্গা-টিনভাঙ্গার সঙ্গে বিকে দিয়েছি রে, কেন ? গল্প পড়বি তো ! নেটে PDF download করে নে ! যা চাইবি তাই পাবি !”
ওঙ্কার আনবরত অপ্রত্যাশিত এই ‘net’ শব্দটি শুনে হ্যরান হয়ে গেছে। দুরন্ত কলকাতায় থেকেও সে যা শোনেনি, তা এই গ্রামে এসে তাকে শুন্তে হচ্ছে। সে এই আধুনিক জীবনকে মেনে নিতে অক্ষম ও নারাজ। সে যেন এই দুরন্ত নেটের যুগে ক্লান্ত-শান্ত এক ধরাশায়ী পাখি। আর সেই পাখির ন্যায় সে জোরে আর্তনাদ করল,” India is now a developed country ! India is really a developed country ! India–”
হঠাৎ ওঙ্কারের সহপাঠী রণজয় তাকে এক মগ গরম জলে মকর-স্নান করিয়ে বলল,”কতক্ষন আর স্বপ্ন দেখবি রে গাধা ! সক্কাল সক্কাল চেঁচাচ্ছে, India is developed country ! India is now developed country, আরে বুদ্ধু India is developing country,আর তাছাড়া এবার যদি স্বপ্নলোক হইতে ইহলোকে প্রবেশ না করো, ঘরে ফেরার ট্রেন মিস করিবে, তাই শীঘ্র উঠে পড়ো।”
–“অ্যাঁ ! কবে, কোথায়, কখন, কীভাবে ??? হ্যাঁ, হ্যাঁ কোথায় যেন একটা যাবার কথা ? হ্যাঁ—-ঘরে যাব ! ঠিক ঠিক ! তবে কি এসব স্বপ্ন ! না,না,হতেই পারে না ! তবে কি কিছু……”
–“কিছু না— সম্পূর্ণ । সম্পূর্ণ ভুল দেখেছো ”
জানলা দিকে চেয়ে ওঙ্কার ঘুমো ঘুমো চোখে উদিত সূর্যের দিকে চেয়ে বলল,”এই তো সবুজে ঘেরা, পৃথিবী সূর্যের সোনালী রঙে রেঙে উঠেছে ! এই তো আমার পৃথিবী ! আমি কখনোই আধুনিক যুগের দুরন্ত পৃথিবী্র খাঁচার পাখি হতে চাই না।কখনোই না…”
তখনই এক delivery boy এসে দরজার সামনে বলল,”রবিন আছে ?”
–“না বলুন, মনে হয় বাথরুমে আছে।”
–“একটা জিনিস ছিল ! Snapdeal-এ order করেছিল , তো তুমি সই করে নিয়ে নাও, দিয়ে দেবে ওকে !”
–“আমি ? আচ্ছা ঠিকাছে।”
জিনিসটি নিয়ে সে খাটের উপর বসে বসে আপন মনে ভাবতে লাগল
–“স্বপ্ন হলেও সত্তি” (হবে)
সমাপ্ত