Home Literature Stories লড়াই

লড়াই

0

আজ সপ্তাহখানেক ধরে উদয়রামপুরের পাটকল বন্ধ থাকার পর ,মালিকপক্ষ শেষমেশ শ্রমিকদের সব  দাবি মেনে নিয়ে কল টা পুনরায় চালু করার সিদ্ধান্ত নিল। প্রায় শ’খানেক শ্রমিক আবার নতুন করে বাঁচার পথ দেখতে পেল।এবার থেকে অনায়াসে তাদের ঘরে ভাতের হাঁড়ি চড়বে,ছেলেমেয়েরা দুবেলা দুমুঠো পেট পুড়ে খাবে, সংসারে অভাব অভিযোগ থাকবেনা, এই আশায় কারখানার পাশের ধারের বস্তিটায় আনন্দের জোয়ার ওঠে।দেখতে দেখতে সব কিছু আবার স্বাভাবিক হতে লাগল।সপ্তাহ গেল।হপ্তার দিন এল।সবাই আবার টাকা হাতে পেল।শ্রমিকদের মুখে হাসি ফুটল।অনেকদিন পর সবাই আবার আনন্দে মুখে দুমুঠো ভাত তুলবে।

শংকর ও আজ খোশমেজাজে বাজারহাট করে নিয়ে বাড়িতে ঢুকল।মেয়ের জন্য জামা কিনে এনেছে।খাবার কিনে এনেছে।দুটো টাকা তাদের পরিবারে ও আনন্দ নিয়ে এল।প্রায় সপ্তাহখানেক ধরে শ্রমিকদের সব দাবি নিয়ে মালিকপক্ষের সাথে লড়াই করে যে পুনরায় কল চালু করাতে পেরেছে,আবার সব শ্রমিক যে কাজ ফিরে পেয়েছে,এর জন্য এক তৃপ্তি কাজ করছে তার মনের ভিতর।শংকর , কলের শ্রমিক সংগঠনের একজন জনদরদি নেতা।সব শ্রমিকদের কাছে সে ভগবান তুল্য আপদে, বিপদে, অসময়ে, দুর্দিনে, চিরকালই  সে শ্রমিকদের পাশে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে।পুলিশের হাতে বারদুয়েক মার ও খেয়েছে। তবুও কোনোদিন নিজের স্বার্থের কথা ভেবে সে পিছুপা হয়নি।এইভাবেই সে শ্রমিকদের সাথে কাঁধে কাধঁ মিলিয়ে লড়াই করে এসেছে।

কলের পিছনে খাল ধারের বস্তির শেষ সীমান্তের টিনের ছাউনি দেওয়া ঘরটাতে বউ আর মেয়েকে নিয়ে কোনওরকমে থাকত শংকর।বর্ষার সময় ফুটো টিন দিয়ে বিছানায় জল পড়ত,খালের জল ঢুকতো ঘরে,এই ভাবে কষ্টেসৃষ্টে বর্ষার দিনগুলো কাটাতে হত ইস্টনাম জপে।শংকর সৎ ,নিষ্ঠাবান্,দয়ালু নামেই পরিচিত বস্তির লোকের কাছে। সারা সপ্তাহ ধরে খেটে সে যে কটা টাকা হাতে পায় তাতে সংসার কোনোমতে টেনেটুনে চললেও অভাববোধটা থেকেই যায়।আগে শংকরের বউ ও বাবুদের বাড়ি কাজ করে যে কটা পয়সা পেত তা দিয়ে শংকরের ঘাড়ের বোঝাটা অনেক টা কমাত।এটে অনেকটা সুবিধা হত।কিন্তু ইদানীং বউ এর হাঁপানির ব্যামো টা বেড়ে যাওয়ায় শংকর আর তাকে কাজে যেতে দিতে চায়না।বস্তির নিতাই বদ্যির কাছে ওষুধ খেলেও তা রোগের কাজে লাগে না।বরং অবস্থা দিন দিন খারাপ হতেই থাকে।

এই আশ্বিন এলে ,ওদের একমাএ মেয়ে ঊষা ন’য়ে পা দেবে।খুবই দুরন্ত গোছের মেয়ে।সারা বস্তি অতিষ্ট করে রাখে। কাকভোরে বস্তির ঐ ছোট্ট ঘরটা আলো করে এসেছিল বলে বউ শখ করে নাম রেখেছিল ঊষা।প্রথম যখন শুনেছিল যে তাদের মেয়ে হয়েছে তখন শংকর অসন্তুষ্ট হয়েছিল।মেয়ে যে তাদের মতো বাবা মায়ের ঘাড়ে বোঝা হয়ে থাকবে।না পারবে ভাল ভাবে মানুষ করতে না পারবে ভালো ঘরে বিয়ে দিতে।তাই সে বরাবর ই চাইত যে তাদের ছেলে হোক। এই নিয়ে বস্তির সন্তোষী মার কাছে মানত ও করেছিল।শংকর ভেবেছিল ছেলে বড় না হতে হতে তার হাত ধরা হয়ে যাবে ক্ষন।কাজ করবে।সংসারে দুটো পয়সা বাড়লে তাদের ও ভালোভাবে চলে যাবে।কিন্তু সে সুখ জুটল না কপালে।ঊষা ও দিন দিন বড় হতে লাগল ,নিমেষেই সে তার বাবার মধ্যমণি হয়ে উঠল।ঊষা দুষ্টু হলেও ,ছেলেবেলা থেকে পড়াশোনার প্রতি তার একটা আগ্রহ জন্মেছিল।তাই দেখে তার বাবা বস্তির পাশে প্রাইমারি ইস্কুল টাতে তাকে ভর্তি করিয়ে দেয়।সেখানে সে ফাস্ট্ হতে লাগল।ইস্কুলের হেডমাস্টার তো ঊষার প্রশংসায় পন্চমুখ।মেয়ের এরুপ পড়াশোনা দেখে শংকর ও বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠে ,যতই  কষ্ট হোক মেয়েকে সে উচ্চশিক্ষিত করবেই।তারা স্বপ্ন দেখে ,তাদের মেয়ে পড়াশোনা শেষ করে শহরে যাবে ,চাকরি করবে,তাদের পাশে এসে একদিন দাঁড়াবে , তাদের অবস্থার উন্নতি হবে তারপর কোনও এক শহুরে রাজকুমারের সাথে দিনক্ষণ দেখে ওদের চারহাত এক করে দেবে।

কিন্তু চারপাশের সমাজ তাদের এহেন স্বপ্নকে ভাল চোখে দেখেনা।এই তো সেদিন পাশেরবাড়ির ফুলু কাকীমা সকাল সকাল আচ্ছা করে কথা শুনিয়ে দিল ঊষার মাকে।বলে বসল-“গরীবদের অয়তো বড় স্বপ্ন দেখতে নেই রে।ও একটা মেয়ে হয়ে এখান ওখান কাজ কইরে বেড়াইবে ,এইটা কি ভালো দেখায় গিয়ে!পাঁইচজনে কী বইলবে!ও বড়ো হতি হতি ঘরের কাজ  শিইখে ওর বে দে ।তোদেরও ঘাঢ়ে বোঝা কইমবে আর বুড়ো বয়সে তোদের ও হাড় জুইড়োবে।এইসব পোড়া মিনসে স্বপ্নটপ্ন  দেখাইনিস ওইকে। “শংকরের বউ  এর এ কথা সহ্য হল না।সারাদিন সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে  সন্ধ্যে হল।উনুনে ভাতের হাঁড়ি চড়াল।ভাতের গন্ধে ঘরটা ভোঁ ভোঁ করতে লাগল। শংকর কল থেকে ফিরে হাতপা ধুয়ে ঘরে ঢুকল।বউ থাকতে না পেরে তৎখনাৎ সকালের  সব কথা শংকরকে খুলে বলে। সে ও যায় রেগে।সে আরও দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়,যে করেই হোক মেয়েকে দশজনের মধ্যে একজন করে তুলতে হবে।শুধুমাএ আর্থিক অনটনের জন্য সে তার মেয়েকে পিছিয়ে আসতে দিতে পারেনা।যখন সময় হবে তখন এমনিতেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।ভগবানের উপর বিশ্বাস রাখে তারা।যখন রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে তারা শুয়ে পড়ে তক্তাপোশের উপর ছেঁড়াকাঁথায় ,তখন বাবার পাশে শুইয়ে  ঊষা, ছাদের টিনের ফুটো দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আকাশছোঁয়ার স্বপ্ন দেখে আর বাবা নতুন ভোরের প্রহর গুনতে থাকে।।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
wpDiscuz
0
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x
Exit mobile version