Home Literature Stories প্রেসের কবিতা

প্রেসের কবিতা

0

টিং টং
ঐ এলো বুঝি ইস্তীরীওয়ালা।
রোজ গেঞ্জি জাঙ্গিয়া পরে দশ মিনিট পায়চারি করার পর বাবু জামা কাপড় গুলো দিয়ে যায়। একেক সময় মনে হয় কোনদিন না এই ভাবেই আধ লেংটা হয়ে অফিস যেতে হয়। এমনিতেও বস্ তার ঝাঁঝালো বাক্য বাণে রোজ সেই অবস্থাই করে আজকাল। আরে ম্যাগাজিনের জন্য পদের লেখা না পেলে আমার কি দোষ। আমি এডিটর, লেখক তো নয়।
মুখে দুটো খিস্তি দিয়ে হাতে জামাপ্যান্টগুলো নিয়ে দরজা বন্ধ করে জলদি ঘরে ঢুকে এলাম। বৌ ঝগড়া করে বাপের বাড়ি চলে যাবার পরের থেকেই পাড়ার বৌদিদের আমার প্রতি উতসাহ বেশ টের পাই। শত্রু শিবিরে শেষে খবর না যায় যে স্ত্রীর অবর্তমানে ইস্তীরীওয়ালা কে বিকিনি পরে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছি।
এমনি হয় না আবার নেকড়া জড়ানো। ইস্তীরীকরা জামা প্যান্ট দুটো আবার খবরের কাগজে মুড়ে সুতো দিয়ে বাঁধা। এক হ্যাচকায় ছিঁড়ে ফেললাম কাগজটাকে। হাতে ছেঁড়া খবরের কাগজে দেখি পেনসিলে কিছু লেখা। যদিও ঘড়ির কাটাগুলো পেছনে কাঠি করছে তবুও চেষ্টা করে পড়লাম কি লেখা। দুটি লাইন –
“কামড়ে ছিলাম আঁকড়ে মাটি
দাঁতের গোড়ায় শিকড় গজাল অগোচরেই”।
মা লক্ষ্মীর ঘষা কাঁচের প্রতিচ্ছবি হল আমার বৌ। কিন্ত সে চলে যেতেই যেন আমার চারিদিকের সব এলোমেলো হয়ে গেছে। হাত পুড়িয়ে রান্না করে হৃদয়জালানো কাব্য হাগা সম্ভব না। সব সাহিত্য আর আতলামি বাসন মাজার সিংকে আর ঘর মোছার ন্যাতায় শ্বাসকষ্টে ফেনা তুলে উবে যায়। সেদিন লেট ঢুকেই বসের মুখে। চেম্বারে ডেকে নিয়ে কি ঝাড়টাই না দিল। আমি বললাম ভাল লেখাই তো পাওয়া যাচ্ছে না। ভুল করলাম, ষাঁড়কে লাল কাপড় দিয়ে সর্দির নাক মুছতে যাওযার মতন। হুলিয়া জারি হল, ভাল লেখা না পেলে আমাকেই লিখতে হবে। পূজা বার্ষিকীর যেহেতু আর বেশি দিন নেই। আমি কাঁচুমাচু হয়ে চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলাম এই আদেশ নিয়ে যে দিনের শেষে দুলাইন ওনাকে বানিয়ে শুনিয়ে যেতেই হবে।
আজ আবার দেরি। না ইস্তীরীওয়ালা কাল খিস্তি খেয়ে আজ সময় মতন জামা কাপড় দিয়ে গেছে। কিন্তু শালা কাঁচা জাঙ্গিয়া খুঁজে পাচ্ছি না। কাল কোনমতে বেঁচেছি ওই দুই যাচ্ছেতাই লাইন শুনিয়ে বসকে। ওই মাটি কামড়ে দাঁতে শেকড়। বাপের জন্মে এমন পচা চোলাই খাওয়া লাইন শুনিনি। কিন্ত চোলাইখোর বসটার বেশ পছন্দ হল মনে হয়। নাকি ওর কাল বাড়ি যাওযার তারা ছিল। কিন্ত আজ আবার লেট হলে আমার পেছনে শেকড় গজিয়ে দেবে। তাড়াহুড়োতে আর কিছু মাথায় এলো না। আজ নয় ডিরেক্ট প্যান্ট পরেই চলে যাই। মহিলাদের একটু এড়িয়ে চলতে হবে এইতো। আজ দেখি জামার প্যাকিং খবরের কাগজের ওপরেই আবার কিছু লেখা। চারটি লাইন –
“তোর বুকের টিলা দুটি পাহাড় বানিয়ে
তার নিচে আমি নিজেকে করেছি দাফন
চূড়ায় লেখা কালো গোলাকার এপিটাফ
বুঝলে তোর সাদা রক্ত করবে আস্ফালন”
আমি আজ আবার লেট। কিন্তু বাঙ্গলা রোমে যখন ওফিস আর বাঙ্গালী রোমান যখন বস তাই আজ না পালিয়ে ওফিসে ঢুকেই বসের কেবিনে ডিরেক্ট ঢুকে গেলাম। বস নিজের ভুরু হরধনুর থেকে কৌণিক সাড়ে পাঁচ ডিগ্রী বেশি বেঁকিয়ে কালকের পুরো কবিতা শুনতে চাইল। আমি বললাম যে ওটা তো আছেই কিন্তু আজ আরেকটা লিখেছি। বস অনুমতি দিতে বেশ কাব্যিক ভাবে সকালের ঝাড়া চার লাইন শুনিয়ে দিলাম। সকালে লাইন গুলো না বুঝলেও এখন নিজের গলা দিয়ে কথা গুলো বেরোতে আরেকজন গলা তুলে দাঁড়িয়ে গেলো। আমি এমন বেগতিক জীবনেও হই নি। না আহ্লাদিত বসের আদেশে বাকি কবিতা শোনাতে পারছি না উঠে দাঁড়াতে পারছি। আজ বুঝলাম কেন ছোট থেকে মা জাঙ্গিয়া পরতে বলত।
বস হেব্বি খুশি আমার ওপরে। আমি বলেছি আমাদের মেগাজীনের পূজা সংখার জন্য অন্য আর কবির লেখা চাই না। যে কটা হেভী ওয়েট কবির পাওয়া গেছে পুঁজি করে বাকিটা আমি ছদ্মনামে চালিয়ে দেব। বস এতো খুশি যে মাইনে ডবল করে দেবে বলেছে। আর ওফিসের পিয়ন মাধ্যমে বৌয়ের কাছে খবরও চলে গেছে। তাই আজ রাতে সাত দিন পরে মোবাইলে লিখিত বার্তার শুকনো প্রতূত্তোর পেলাম। আমার দারা তো কিছুই হবে না। যতদিন পেনসিলে লেখা উড়ো কবিতাগুলো পাওয়া যায়। পূজার এখনো তিন মাস বাকি। ততদিন নয় বেঁচে থাকি। নাহলে সন্ন্যাস তো আছেই।
পরেরদিন এলার্ম লাগিয়ে খুব ভোরে উঠলাম। প্রথম দরজার ঘন্টি দুধওয়ালার, দ্বিতীয়টা পেপার, তৃতীয় হল ইস্ত্রি ওয়ালার। বৌ না থাকলে জেনারেল নলেজ যে এতো বেড়ে যায় তা আমার দেশের শ্রেষ্ট মন্ত্রীর থেকে বোঝা উচিত ছিল। ধরলাম চেপে মালটাকে। পেপারে লেখে কে? সে যানে না। কোথা থেকে কেনে। বলল যে ঠিক নেই। যে কাবারি পায়। ছেড়ে দিলাম এই দেখে যে আজও কয়েক লাইনের আমার মুক্তির পথ লেখা আছে।
“সময় আমার বিপ্লব, বন্দুকের গলা টিপে
মেরে ফেলবে ভেবে ছিল..
কিন্তু যানে না আরেকটা নল এখনো আছে
সেই কলকে আমার কলজে টানতে না পারে
কিন্তু হাত এখনো মশলা পিস্তে ভোলে নি..”
বস বলল এটা কিন্তু একটু অতিরঞ্জিত বামপন্থী। তাতে আমার বাপের কি? কিন্তু বস কিন্তু মনে মনে বেশ খুশি। আমিও খুশি।
এভাবে বেশ কিছু দিন চলল। এই দিন দশেক। রোজ নতুন লাইন ইস্তীরীর কাগজে। আমিও বসকে রোজ খুশি করে দি একদম..
ঠিক পূজা বার্ষিকীর মেটিরিয়ল ফাইনাল করার দুদিন বাকি। কিছুদিন ধরে ইস্তীরীর কাগজে লেখাগুলো আর পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে সে মাল আবার একটা বাচ্চা ডেলিভারি বয় রেখেছে। তাই সরবরাহের অভাবে নিজেই গিয়ে চড়াও হলাম তার দোকানে। ও সীকার করল যে শেষের কয়েক মাস সে এক দাদুর দারওযানের থেকে পেপার ফ্রীতে পেত। কিন্তু কে দিত বলা বারন ছিল কিন্তু সে দাদু গত শনিবার মারা গেছেন। আমি সেই দাদুর হদিশ নিয়ে দৌড়ে গেলাম সেই গ্রাউন্ড ফ্লোরের ফ্লাটের দরজায়। বন্ধ দরজায় নেমপ্লেট মশকরা করছে DR. RONIT DUT লেখা দেখিয়ে। বহুতল ফ্লাটের দারোয়ানের থেকে জানতে পারলাম যে এক পাগল বুড়ো থাকত এই ঘরে। ছেলে খুব বড়লোক বিদেশে থাকে। বিপত্নীক বাপের জন্য দুবেলা আয়া রেখে দিয়ে ছিল। সে বুড়ো নাকি কবিতা লেখে। সারা ঘরময় দেওয়াল ভরিয়ে রাখত হাবিযাবি লিখে। ঘর থেকে বেড়ানোই বারণ ছিল। বেরোলেই যেখানে যা পারত লিখে দেওয়াল নষ্ট করত। আমি অনেক আকুতি করলাম ওর ঘরে একবার ঢোকা যায়? সে বলল যে তার কাছে একটা চাবি আছে কিন্তু সে খুলতে পারবে না। আমি জিগ্গাসা করতে সে বলল যে তার অনুমতি নেই আর রনীতবাবু বাবা মারা যাবার পরের দিন এসেই ঘরের সমস্ত জিনিস বেঁচে ঘর রং করিয়েছে, ফ্লাটটা বেঁচে দাওযার জন্য। আমি মুড ওফ করে চলে আসছিলাম। হঠাত সেই লোকটি পেছন থেকে ডেকে বলল “জানেন দাদাবাবু ওই পাগলা দাদু আমায় সপ্তাহের পুরনো খবর কাগজ দিয়ে বলতেন যে ওর রক্ত মাংসের ছেলে কুলাঙ্গার হতে পারে কিন্তু ওর বাকি বাচ্চারা ওকে একদিন সম্মান দেবেই। হয়ত কবিতা নামের ওর একটা মেয়ে ছিল।”
আমি মন খারাপ করে বাড়ি ফিরছিলাম। হঠাত রাস্তায় দেখি বৌ। হয়ত বাড়ি ফিরছে। আমি মুখ লুকিয়ে সামনের দোকানে ঢুকে পড়লাম। এই সাংঘাতিক বৌ আগে প্রেমিকা হয়ে কত সহস্র বাদ্যযন্ত্রর ওর্কেস্ট্রা বাজাতে পারত বুকে। এখন শুধু দামামা বাজাতে পারে। তাই হাতের সামনে সেই দোকানে ঢুকে যা পেলাম তা দিয়ে মুখ ঢেকে রাখলাম। মুদির দোকানি হবে আর এটা নিশ্চই আমার বৌয়ের ভুট্টার মাকে মাসি বলি ধরনের কর্ণ ফেলেক্স। বৌয়ের কাঁলো মেঘ কাটিয়ে যেটা হাতে দেখলাম সেটা কি বুঝতে পারছেন! পাড়ার কাবারীর দোকানের ময়লা শেলফে রাখা একটা ডায়রী! রণদীপ দত্ত লেখা প্রথম পাতায়। সে কে ? যার তিন নম্বর ভরা পাতার শুরুতে লেখা দুটো লাইন –
“কামড়ে ছিলাম আঁকড়ে মাটি
দাঁতের গোড়ায় শিকড় গজাল অগোচরেই”।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
wpDiscuz
0
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x
Exit mobile version