Home Literature Stories স্বাধীনতার হীনতায়

স্বাধীনতার হীনতায়

0
স্বাধীনতার হীনতায়

নিতান্ত ছাপোসা ঘরের মেয়ে হয়েও বর্ণালী কে কোনদিন কিছুর অভাব হতে দেয় নি তার বাবা অচেতন গাঙ্গুলী আর মা বিমলা দেবী। এক জন সামান্য সরকারী স্কূল মাস্টার হওয়া সত্বেও মেয়েকে ভাল জায়গা থেকে পড়া শোনা শিখিয়ে সে আজ তার মধ্যে স্বাধীনচেত্বার বীজ বপন করেছে অনায়াসে।তাই আজ বর্ণালী একাধারএ এই অচেতন বাবু আর বিমলা দেবীর মেয়ে এবং তার থেকে ছেলে হয়ে উঠেছে ধীরে ধীরে। কিন্তু এই স্বাধীন চেতা মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে এনারা দুজনেই বেশ ফাঁপরে পরেন। একে মেয়ে স্বাধীন চেতা তার ওপর উচ্চশিক্ষিতা এবং কর্মরতা সুন্দরী মেয়ের জন্যে উপযুক্ত পাত্র খুঁজতে এমনিতেই বেশ সমস্যায় পরতে হয় বাপ মা দুজন কেই। একে পাত্র পেতে সমস্যা অন্যদিকে মেয়ে কিছুতেই বিয়ে করতে রাজি না, এরকম একটা পরিস্থিতি তে অচেতন বাবুর মৃত্যু হলে অবস্থা আরো কঠিন হয়,।এখন বর্ণালীরর শেষ সিদ্ধান্ত সে আর কিছুতেই বিয়ে করে তার স্বাধীনতা হারাতে পারবে না। আর স্বশুর বাড়ি যতই ভালো হোক তার চাকরীর মাইনের টাকা গুলো এতদিন জা মাকে দিয়ে এসেছে সেগুলো বিয়ের পরেও দেওয়া যাবে বলে মনে হয় না ভেবেই আরো সে বিয়ে থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চায়. কিন্ত জন্ম মৃত্যু আর বিয়ে যেহেতু বিধাতার হাতে কাজেই সেখানে মানুষের ইচ্ছা অনিচ্ছা খুব একটা কাজ করে না। বর্ণালীর ক্ষেত্রে ও সেই একি ঘটনা ঘটে,তাকেও এক প্রকার জোড় করে বিয়ের পিঁড়িতে বসান সকলে, বিয়ের কার্য সম্পন্ন হয়। যদিও এখানে পাত্র পক্ষ রাজী হয়েছে বর্ণালীর তিনটে শর্ত মেনে নিতে। এক তার চাকরী করা বন্ধ করান চলবে না, অন্যদিকে তার মাইনের সমস্তটাকা যাতে মা পায় সে ব্যাপারে অনুমতি প্রদান করতে হবে। আর তৃতীয় হলো তাকে কেবল মাত্র ঘরের কাজ করেই শান্ত থাকতে জেন না বলা হয়। পাত্র পক্ষ সকলের সম্মুখে সে শর্ত গুলি মানলেও বিয়ের পর বর্ণালী শ্বশুড় বাড়ি গেলে শ্বাশুড়ি মা এবন্দ বাবা সবাই ওর বিরুদ্ধে একজোট হয়ে দাঁড়ায়। এমন কি বর্ণালীর মা ও জানিয়ে দেয় যে বর্ণালীর রোজগারের টাকা জেন সে তাকে না পাঠায়। তার উচিত শ্বশুড় বাড়িরর মন জুগিয়ে চলা মায়ের না, প্রথম এরকম ভাবেই কাটাচ্ছিল বরণালী।যদিও চাকরী তাকে ছাড়তে হয় নি কিন্তু মাইনের টাকা এসেই তাকে শ্বাশুড়ির হাতে তুলে দিতে হয় ফলে তার আর মাকে সাহায্য করা হয় না। যদিও মা আর টাকা নেবে না বলে জানালেও তার কর্তব্য অনুযায়ী টাকাটা বর্ণালী তার মাকে দেবে স্থির করে এই কথা শুনেও শ্বাশুড়ি সমেত সবাই রেগে আগুন হয়ে ওঠে। যদিও বর্ণালীর স্বামী স্বপন আপন ভোলা মানুষ তাই সংসারের সুখ দুখ কোন কিছুর মধ্যেই সে থাকে না এমন কি বর্ণালীর থেকেও একটা দুরত্ব বজায় রাখে সর্বদা; .বর্ণালী আসার পর সে বর্ণালীর সাথে সেরকম ভাবে কোন কথাই বলে নি। এবং এরকম অসহায় অবস্থার মধ্যে দিয়েই বর্ণালীর প্রায় দু বছর কাটে। এখন তার একটি পুত্র সন্তান আছে। তাকে নিয়েই জীবন কাটে তার। এছাড়া অফিস তাকে ছাড়তে হলেও অফিস তাকে ছাড়েনি বাড়িতে বসেই তার কাজ করতে হয়ু,কিন্তু তাও শ্বশুড় শ্বাশুড়ি আর স্বামী স্বপনের মাঝে পরে বর্ণালী কেমন জেন একা একা অনুভব করে, একান্ত নিজের বলে সেরকম কাউকেই সে খুঁজে পায় না সে বাড়িতে। সারাটাদিন যন্ত্রের মতো অফিসের আর বাড়ির কাজ করে করে সে ক্লান্ত হয়ে ও রাতে ঘুমতে পারে না। একাকীত্ব আর নিঃস্বঙ্গতা জেন গ্রাস করতে শুরু করে তাকে। স্বপনের নিজের জগত নিয়ে এত ব্যাস্ত হতে শুরু করে যে বর্ণালীর সঙ্গে আলে কালে দু একটা কথা বার্তা হলেও তাতে বর্ণালীর মনের কথা খুব একটা থাকে না। এরি মধ্যে ছোট থেকে স্বাধীন চেতা বর্ণালী কেমন জেন তলিয়ে যেতে শুরু করে দিনের পর দিন।

এরি মধ্যে বর্ণালীর অফিসের এক সিনিয়ারের সাথে বর্ণালীর সোস্যাল নেট ওয়ার্ক দিয়ে ফের আলাপ হয় এবং তারা একে অপরের ওপর অনেকটাই ডিপেন্ডেন্ট হয়ে ওঠে, এখন বর্ণালীর বেশির ভাগ সময় জুড়েই ও থাকে যদিও প্রেম বা ভালোবাসা নামক কিছু ওদের মধ্যে তৈরী হয় নি ঠিকি কিন্তু বিশ্বাস আর ভরসাকে ভর করে এক অসম বয়সী বন্ধুত্বের রূপ সে সম্পর্ক এবং অচিরেই তা রূপ নেয় বিবাহ বহির্ভূত একটি প্রেমের সম্পর্কে আর অন্যদিক থেকে ক্রমশ একাকীত্ব আর নিঃসংতার ভারে নুইয়ে পরা বর্ণালী বেশ চাঙ্গা হয়ে ওঠে। এখন তার একটাই বাসনা নিজের ছেলেটাকে ভাল ভাবে মানুষ করার। কিন্তু সে ব্যাপারেও সে যতটা সাহায্য বা গাইডেন্স তার অফিস কলিগ অরিজিতের থেকে পায় তার কানা কড়ি ও সে তার স্বামীর থেকে পায় না। শুধু তাই না এক এক করে সব ব্যাপারেই বর্ণালী কে ধীরে ধীরে অরিজিতের ওপরে ডিপেন্ডেন্ট হয়ে পরতে হয়, অন্যদিকে নিজের সংসার মেয়ে থাকা সত্তেও নিছক বন্ধুত্ব স্থাপনের লক্ষ্যে যে সমপর্কের দিকে এগিয়ে ছিল অরিজিত সে ও এখন অনেক টাই বেশি নিজের সংসার আর মেয়ের থেকে বর্ণালীকে নিয়ে বেশি মত্ত থাকে। তার স্ত্রীর চোখেও সে ব্যাপারটি ধরা পরায় একদিন অশান্তি বেশ চরমে ওঠে স্ত্রী আত্মহত্যার চেষ্টা করে, কাজেই অবস্থার সামাল দিতে অরিজিত কে সকলের সামনে স্বীকার করতেই হয় যে তার সাথে বর্ণালীর আর কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু সকলের অলক্ষে ওদের দুজনের সম্পর্ক চলতে থাকে। সংসার জিবনে কোন ঠাসা হয়ে পড়া বর্ণালীর কাছে অরিজিত ছিল এক দন্ডের মতো যাকে আঁকড়ে ধরে সে তার জীবনের গতিতে ফিরতে চেয়েছিল আর অরিজিতের তরফ থেকে একটা শক্ত হাত পেয়ে সে জেন সমস্ত কিছুকে ভুলে তা নিয়েই মেতে থাকতে শুরু করলো। জা নজর এড়ালো না বর্ণালীর শ্বশুড় বাড়ির লোকেদের। তারা বুঝতে পারলো এই সাধারণ গৃহ বধূ হয়ে নিজের সংসারে কোনঠাসা হয়ে থাকা বর্ণালীর জীবনে পরিবর্তনের গতি লেগেছে, কিন্তু কে তাকে এই গতি প্রদান করলো তা নিয়ে তার তখোন ছিল সংশয়ের মধ্যে। স্বপন ও বেশ বুঝতে পারছিল আজ বিয়ের এত গুলো বছর পর বর্ণালীর এরূপ পরিবর্তনের পেছনের রহস্য। কিন্তু সমাধান করার মতো কোন হদিশ সে পাচ্ছিল না। এরি মধ্যে বর্ণালী আর অরিজিতের সম্পর্ক একদিন সকলের সামনে এলো,শ্বশুড় বাড়ি থেকে বর্ণালী কে নানা ভাবে দোষারোপ করতে শুরু করলে বর্ণালী পরিষ্কার ভাবে সকল কে জানিয়ে দেয় তার আর অরিজিতের সম্পর্কের কথা নিজের স্বামী এবং শ্বশুড় শ্বাশুড়ি কে। এবং তার পরেই স্বাভাবিক ভাবেই সে নিজের ছেলের হাত ধরে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ফিরে এলো তার বাপের বাড়ি তে কিন্তু সেখানে ও তাকে পেতে হলো লাঞ্ছনা আর গঞ্ছনা, নিজের মায়ের কাছ থেকে ও এতটুকু সহানুভুতি না পেয়ে তাকে সেখান থেকেও বিতারিত হতে হলো কিছুদিনের মধ্যেই।

এখন সে একটি আলাদা ফ্ল্যাটে তার নিজের ছেলে কে নিয়ে বাস করে। আর অরিজিত মাঝে মাঝে এখানে এসে তাদের সাথে থেকে চলে যায়,নিজের সমস্ত কিছু অরিজিতের সাথে সম্পর্ক রাখার জন্য গেছে জেনেও সে কিন্তু অরিজিত কে কোনদিন তার নিজের সংসার ছাড়তে বলে নি। বরং তাকে বরাবর তার নিজের সংসারের প্রতি আরো দায়িত্ব নিতে শিখিয়েছে সে, আর বর্ণালীর এই অমায়িক স্বার্থ ত্যাগেই ধীরে ধীরে মজে যেতে শুরু করে অরিজিত আরো বেশি করে। এই করে প্রায় দশ টা বছর পার করে ওরা। এখন বর্ণালীর ছেলে ঋতম কলেজে পড়ে অন্যদিকে অরিজিতের মেয়ে কস্তুরি ও স্কুলের গন্ডি পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়। বর্ণালির মনের মধ্যে এখন এই শান্তি বিরাজিত যে নিজের মত বাঁচতে চেয়ে সে কোন ভুল করেনি তাতে তার আপন জনেরা হারিয়েছে ঠিকি কিন্তু তার সাথে তার স্বাধীন চেতা মনটাকে সে আরো শক্ত করতে শিখেছে। এরিমধ্যে সে খবর পায় ঋতমের সাথে এক মেয়ের সম্পর্কের কথা,যদিও ছেলের সাথে সে বরাবর বেশ সহজ সম্পর্ক রেখে এসেছে সে কিন্তু এক্ষেত্রে সে আর ঋতমের সাথে সহজ হতে পারে না। কারণ ঋতম যে মেয়েটির সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে সে অরিজিতের মেয়ে কস্তুরী। কাজেই অরিজিতের সাথে ওর সম্পর্কের পর ঋতমের সাথে কস্তুরির সম্পর্ক যে কিছুতেই হতে পারে না তা সে আগে থেকে বুঝেই ঋতম কে সে পথ থেকে সরে আসতে বলে কিন্তু ঋতম তার মায়ের কথা শুনলেও কস্তুরির থেকে আলাদা হতে পারে না। অন্যদিকে অরিজিত কে সমস্তটা জানায় বর্ণালী, এবং নিজের সংসার এবং জীবনে ঝড় আসা রুখতে সে ও তার মেয়ে কে ঋতমের সাথে সম্পর্ক রাখতে বারন করে কিন্তু সে ক্ষেত্রে ওর মেয়েও সে কথা মানতে পারে না। এরি মধ্যে ঋতম আর কস্তুরির সম্পর্কের কথা জেনে যায় স্বপন আর অরিজিতের স্ত্রী। তারা নিজেদের মত করে এসে অরিজিত আর বর্ণালীর দিকে আঙ্গুল তাক করে তাদের জীবনের ধ্বংসের কারণ হিসাবে অরিজিত আর বর্ণালীকে দায়ি করতে থাকে। অন্যদিকে ঋতম আর কস্তুরি যখন ঠিক করে শত বাধা সত্তেও তারা বিয়ে করবে এবং সে মত তারা ব্যবস্থা নিতে শুরু করে তখন অরিজিতের স্ত্রী আর বরণালীর স্বামী অরিজিত আর বর্ণালীর সম্পর্কের কথা তাদের দুজন কে বলে দেয়। তাদের এই কাজের উদ্দেশ্য ছিল ছেলে মেয়েদের চোখে অরিজিৎ আর বর্ণালী কে এত নীচে নামিয়ে দেওয়া যাতে ওরা নিজেদের বাবা আর মা কে ঘেন্যা করতে শুরু করে। কিন্তু এক্ষেত্রে তার ফল হলো সম্পূর্ণ উলটো ওরা বোঝে বেচে থাকা কালীন ওদের দুজনের আর একসাথে থাকা সম্ভব না তাই তারা একসাথে মরবে বলে ঠিক করে। এবং সেই মতো ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করে, আর তাদের এই কর্মের জন্যে সমস্ত দায় তারা দিয়ে যায় অরিজিৎ আর বর্নালীকে এবং ওদের সম্পর্কের ওপর। নিজের মতো স্বাধীন ভাবে বাঁচতে চেয়ে যে সাহসী পথ বেচেছিল বর্ণালী যার জন্যে তাকে একে একে নিজের সমস্ত কিছুকে ছাড়তে হয়েছিল আজ সেই স্বাধীনতা তাকে চরম হীনতার এক জীবন উপহার দিল। নিজের ছেলে কে হারিয়ে সকলের চোখে ছোট হয়ে লজ্জায় দুঃখে কষ্টে সকলের আড়ালে চলে গেল বর্ণালী। তারপর তার খবর আর কেউ জানে না এমন কি অরিজিত ও না, কে জানে আজ আদেও সে বেঁচে আছে কি না? কেই বা নেবে তার খবর? সবাইতো তার থেকে মুখ ফিরিয়েইছে ওনেক আগেই।

~ স্বাধীনতার হীনতায় ~
Previous articleতাকে আমি চিনতাম না (part 1)
Next articleতাকে আমি চিনতাম না (last part)
আমি এক গৃহ বধু, বেশ কয়েক বছরের না না ছোট খাটো সাংসারিক অভিগত্যায় পরিপূর্ণ আমার এই সরল সাদা সিধা মগজ, কিন্তু এই আপাত দৃষ্টিতে দেখতে পাওয়া এক ঘেয়ে বোরিং একটা লাইফেও যে বেচে থাকার কত রসদ তা বোঝাতে এবং কিছুটা হলেও জীবনে একটু সৃজনশীল কিছুর বাতাস ভরতেই হাত পাখার কাছে হাত পাকাতে আসা... আসা করি আপনাদের সাথে আমার বেশ জমেও যাবে আলাপ্টা খুব তাড়াতাড়ি আমার লেখার মাধ্যমে... কেমন লাগলো, তা যদি দয়া করে জানান সকলে তাহলে সত্যি খুব ভালো লাগবে...
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
wpDiscuz
0
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x
Exit mobile version