Home Literature Stories মাখা সন্দেশ

মাখা সন্দেশ

0

রোজকার ব্যস্ত শহুরে জীবনে ভোরের আকাশ দেখার সুযোগ কজনেরই বা হয়? আমার ক্ষেত্রেও সুযোগটা হঠাৎ করেই এসে গেল। বেশ কিছুদিন ধরে রাতে ঘুম আসছিল না। এরকমই এক রাতের শেষে ভাবলাম বেরিয়ে পড়া যাক। বাবা মার ঘুম না ভাঙিয়ে চুপিসারে কোলাপসিবল গেটের চাবি নিয়ে সোজা নেমে গেলাম সিঁড়ি দিয়ে। তালাটা বেশ পুরানো হয়েছে। সহজে খোলা গেলেও সহজে বন্ধ করা গেল না। সময় নষ্ট হচ্ছে দেখে তালা না দিয়েই বেরিয়ে গেলাম। ভাবলাম বেশি দূর তো যাব না, তাই গেটে তালা না দিলেও অসুবিধা নেই। কিন্তু বাইরের দিগন্তবিস্তৃত পথ আমাকে সহজে ফিরতে দিল না। চার দেওয়ালে বন্দী জীবন যদি হঠাৎ করে মুক্তি পেয়ে যায়, তাহলে তাকে আর পায় কে ! আমাদের বাড়ির সামনেই দুপাশে দুটো পুকুর, দলে দলে পানকৌড়ি ভেসে চলেছে সেখানে। আমি মেন গেট খুলে বেরোতেই কতগুলো প্যাঁকপ্যাঁকে হাঁস ঘিরে ধরল আমায়। তারা যেন সমবেত কণ্ঠে জানতে চাইল, “কী ব্যাপার? আজ সূর্য কোন দিকে উঠেছে? সকাল নটার  আগে যার ঘুম ভাঙে না, তার আজ হঠাৎ এই কাকভোরে চড়ে বেড়ানোর শখ হল কেন?” স্মিত হেসে মনে মনে বললাম, “ভোর চারটের আগে যার ঘুম আসে না, তার তো সকাল নটার আগে ঘুম ভাঙার কথাও নয়। মানুষের জীবনে ঘুম বড় দুর্লভ জিনিস। তোরা আর কি বুঝবি!” এসব ভাবতে ভাবতেই এগিয়ে চললাম হাঁসের দলকে পিছনে ফেলে।

মেন রোড ধরে স্টেডিয়াম পৌঁছতে বেশ অনেকটা সময় লেগে গেল। সেখানে পৌঁছে দেখলাম, এই কাকভোরেই ফুটবল খেলা আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। এছাড়াও হাঁটতে বেরিয়েছেন প্রচুর সংখ্যক মানুষ, যাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই বয়স্ক। বাড়ি ফেরার কথা মনে হতেই খেয়াল হল মেন রোড ধরে ফিরতে গেলে অনেকটা দেরি হয়ে যাবে, কোনো শর্টকাট নিলে ভালো হয়। ফোনে গুগল ম্যাপ খুলে হাঁটতে শুরু করলাম সেই পথ ধরে। তিব্বতি বাবার মঠ পেরোতেই সবকিছু যেন একটু একটু করে চেনা চেনা মনে হতে লাগল। আরও কয়েক পা এগোতেই বুঝলাম আর গুগল ম্যাপের দরকার নেই। যে চীনেপুকুর, ওর ঘাট থেকে বেশ কিছুটা এগিয়ে গেলেই পড়বে একটা লাল রঙের গেট, আর তার পাশেই একটা দোতলা বাড়ি। অবশ্য লাল রংটা নাও থাকতে পারে, তবে বাড়িটা থাকবে আশা করি। দশ বছর পর আবার সেই বাড়িটার সামনে দাঁড়াব, একথা ভেবেই বুকের ভিতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। এক পা এক পা করে যত এগোতে লাগলাম, হৃদস্পন্দনের গতি ততই তীব্র হতে লাগল। যে বাড়িটার সাথে আমার জীবনের রত্নখচিত সাতটা বছর জড়িয়ে আছে, সেই বাড়িটাকে যে আমি এতদিন ভুলে ছিলাম, এটা ভেবেই আমার অবাক লাগছিল।   

আরও কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বাড়িটাকে দেখতে পেলাম বটে, তবে ঠিক আগের মত করে নয়।শেষের কবিতাএখন বদলে গিয়ে হয়েছেদোয়েল এপার্টমেন্ট সেই লাল  ইঁটের দেওয়াল বা মাধবীলতার ঝোপ কোনটাই আর নেই। লোকমুখে শুনেছিলাম মাস্টারমশাই মারা গেছেন বছর খানেক আগে। তাঁর স্ত্রী   মেয়ে এখানে আর এখন থাকেন না। বেশিক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। হাত পা কেমন যেন অবশ হয়ে আসছিল। আবার হাঁটতে শুরু করলাম। কিন্তু যে চিলেকোঠার ঘরে অতীতের রাশি রাশি স্মৃতি বন্দী হয়ে থাকে, তার দরজা একবার খুলে গেলে তাতে ফের আগল লাগানো কি এতই সহজ? বোধহয় নয়।

মাস্টারমশাইয়ের মেয়ের নাম ছিল কুচি। কুচির যখন তিন মাস বয়স, তখন মাস্টারমশাই ওকে প্রথম দোতলার পড়ার ঘরে নিয়ে আসেন। ধীরে ধীরে কুচিও আমাদের সহপাঠী হয়ে ওঠে। আমরা যখন নর্মদা নদীর গতিপথ কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল মুখস্থ করতাম, তখন আমাদের পাশে বসেই বর্ণপরিচয় পড়ত। আমাদের সবার সাথে ওর বন্ধুত্ব থাকলেও ওর দ্বারা সবচেয়ে বেশি অত্যাচারিত আমিই হতাম। ছুটির পর মাঝে মাঝেই ওর সাথে খেলার জন্য আমি থেকে যেতাম আর ওর মা আমাকে কিছু না কিছু খেতে দিতেন। ফলের জেলি মাখানো পাঁউরুটি দেখলেই জোলি জোলিবলে ছুটে আসত আর আমার ভাগের পাঁউরুটির জেলি চেটে চেটে খেয়ে নিত। ক্রিম বিস্কুট এর ক্রিম বা সীতাভোগের নিকুতিকোনটারই নিস্তার ছিল না ওর হাত থেকে। আমার জ্যামিতি বক্সটা ছিল ওর কাছে গুপ্তধনের খনির মতো। সেই সময়কার কোনো খাতা যদি এখনও আমার বাড়িতে থেকে থাকে, তাহলে তাতে নিঃসন্দেহে ওর কোন না কোন কীর্তির সন্ধান পাওয়া যাবে। আমার প্রতি একটা অদ্ভুত অধিকার বোধ তৈরি হয়েছিল ওর। আমার যাওয়ার সময় হয়ে গেলেই ওর মায়ের কোলে মুখ গুঁজে ডুকরে ডুকরে কাঁদত। কয়েকদিন ওদের বাড়ি না গেলে এত কান্নাকাটি করত যে ওর মা আমাদের বাড়িতে ফোন করে আমাকে ডেকে পাঠাতে বাধ্য হতেন। আর ওর সাথে খেলার সময়ে যদি ভুল করেও কেউ আমাকে ডাকতে চলে আসত, তবে তার উপর ভয়ানক রেগে যেত। তবে সব থেকে বেশি যার উপর রেগে যেত, তার নাম হল জিলিপি।

জিলিপির আসল নাম হল অনির্বাণ। রথের মেলায় আমাদের মধ্যে জিলিপি খাওয়ার প্রতিযোগিতায় ওকে কেউ হারাতে পারত না। সেই কারণেই আমরা সবাই ওকেজিলিপিবলে ডাকতাম। জিলিপির যখন তিন বছর বয়স, তখন ওর বাবা মা কোনো এক দুর্ঘটনায় মারা যান। মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি থেকে মাত্র হাত দশেক দূরেই ছিল ওর মামার বাড়ি, সেখানেই থাকত। ওকে পড়ানোর জন্য মাস্টারমশাই কোন বেতন নিতেন না। প্রতিদিন সকালে আশেপাশের বাড়িগুলোতে সাইকেলে চড়ে খবরের কাগজ বিলি করত। রাধাগোবিন্দ আশ্রম থেকে একটু এগিয়ে একটা বাঁক ঘোরার আগেই প্রতিদিন ওর সাইকেলের ক্রিং ক্রিং শব্দ কানে আসত আমার। কোনোদিন যদি সেই শব্দ শুনতে না পেতাম বা বাঁকের মুখে অন্য কাউকে সাইকেল চালিয়ে আসতে দেখতাম, তবে বুঝে নিতাম যে আমার দেরি হয়ে গেছে। ওখান থেকেই দৌড় লাগাতাম মাস্টারমশাইয়ের বাড়ির দিকে।

চীনেপুকুর থেকে মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি হয়ে আরও কিছুটা এগোলেই পড়ত শিমুলতলার মাঠ। একটা বিশাল শিমুল গাছের নীচে বসে হোমওয়ার্ক করতাম আমরা। জিলিপি আমাকে বাংলা পড়াত আর আমি ওকে অঙ্ক। খুব ভালো বাঁশি বাজাতে পারত। শিমুলতলায় বসে প্রায়ই আমাদের বাঁশি বাজিয়ে শোনাত। চীনেপুকুরের জলে ছিপ ফেলে মাছ ধরতাম আমরা। কুচিও থাকত আমাদের সাথে, ওর মা হাজার বারণ  করলেও শুনত না। মাখা সন্দেশ জিলিপির খুব প্রিয় ছিল। আমি প্রায়ই ওকে আমার ঠাম্মির হাতে বানানো মাখা সন্দেশ এনে খাওয়াতাম, তাই আমাকেমাখা সন্দেশবলে ডাকত। শিক্ষক দিবসে মাস্টারমশাইকে দেওয়ার জন্য আমি কার্ড বানাতাম আর তাতে কবিতা লিখত। মাস্টারমশাই আমাদের থেকে কোন উপহার নিতেন না। তবে আমাদের দেওয়া কার্ড গুলো উনি সস্নেহে দোতলার পড়ার ঘরের শোকেসে সাজিয়ে রাখতেন। বর্ষাকালে যখন রাস্তায় জল জমে যাওয়ার কারণে পড়তে যেতে পারতাম না, কাগজে জিলিপির নাম লিখে নৌকো বানিয়ে বৃষ্টির জলে ভাসিয়ে দিতাম আমি। জিলিপি বলত সে নৌকো নাকি ওর কাছে পৌঁছত। সেটা যে আদৌ সম্ভব নয়, তা বোঝার ক্ষমতা তখন আমার ছিল না। একটু বড় হওয়ার পর বুঝতে পারলেও মানতে চাইতাম না। আমার সর্বদাই মনে হত যে কোন অলীক শক্তিবলে আমার পাঠানো নৌকো ঠিক ওর কাছে পৌঁছে যাবে। পাছে আমার ধারণা মিথ্যে প্রমাণিত হয়, সেই ভয়ে আমি নৌকো গুলো ওর কাছে দেখতেও চাইতাম না। ওর মুখের কথাকেই সত্যি বলে মেনে নিতাম।

এভাবেই কবে যেন বড় হয়ে গেলাম আমরা ! মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে শেষ যেদিন আমরা মাস্টারমশাইয়ের কাছে পড়তে গেছিলাম, সেদিনের কথা আজও স্পষ্ট মনে আছে আমার। কুচির মা হাউহাউ করে কাঁদছিলেন। মাস্টারমশাইয়ের কঠিন চোখেও যে সেদিন জল ছিল, তা আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়নি। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার ছিল এই যে কুচি সেদিন এতটুকুও কাঁদেনি। জুলজুল করে চেয়েছিল আমাদের দিকে। আর জিলিপি? ওর থমথমে অন্ধকারাচ্ছন্ন মুখের দিকে তাকানোই যাচ্ছিল না ! সেদিন মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে জিলিপি একটুও দাঁড়ায়নি, হনহন করে সোজা হাঁটা দিয়েছিল ওর মামার বাড়ির দিকে।

মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার ঠিক দশ দিন পর আমার জন্মদিন উপলক্ষে আমাদের বাড়িতে একটা ছোটখাটো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। আমার মা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সকলকে নিমন্ত্রণ করে এসেছিলেন। অনেক দিন পর কুচি আর জিলিপির সঙ্গে দেখা হবে, এটা ভেবেই আমি আনন্দে আটখানা হয়ে গেছিলাম। সকলে এসেছিল কিন্তু জিলিপি আসেনি। আমি সারাটা দিন ওর পথ চেয়ে বসেছিলাম, কিন্তু আসেনি।সেদিনের পর আর কক্ষনও কোনোদিনও জিলিপির সাথে আমার দেখা হয়নি। এরপরেও বেশ কয়েক বছর ধরে বর্ষাকাল এলেই বৃষ্টির জমা জলে আমি জিলিপির নাম লেখা কাগজের নৌকো ভাসাতাম। তারপর একসময় জিলিপির কথা আমি ভুলেও গেলাম। হয়তো কোনোদিন মনেও পড়ত না যদি না আজ আমার নিয়তি আমাকে সেই চীনেপুকুরের সামনে এনে দাঁড় করাত, যার জলে চোখ রাখলে হয়তো এখনো আমি আমার ফেলে আসা অতীতের প্রতিবিম্ব দেখতে পাব !

শিমুলতলার মাঠের সামনে এসে দেখলাম তার ভোল বদলে গিয়েছে। শিমুলতলার মাঠ এখনসবুজতীর্থ শিশু উদ্যান তবে শিমুল গাছটা এখনো আছে। পাঁচিল ঘেরা সুসজ্জিত পার্কের তালাবন্ধ গেটের গ্রীলের ফাঁক দিয়ে অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলাম শিমুল গাছটার দিকে। অস্পষ্ট জলছবির মতো চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা দৃশ্য। একটা হৃষ্টপুষ্ট কাঠবিড়ালির পিছনে দৌড়ে চলেছে জিলিপি, জিলিপির পিছনে আমি আর আমার পিছনে কুচি। হঠাৎ যেন একটা সাইকেলের ক্রিং ক্রিং শব্দে ঘোর কাটল আমার। পরক্ষণেই বুকের ভিতর দপ করে একটা আশার আলো জ্বলে উঠল। জিলিপির সাইকেলের বেল নয়তো? সাইকেলের শব্দটা আমার দিকেই এগিয়ে আসছিল, তবুও অশান্ত পায়ে আমি কিছুটা এগিয়ে গেলাম। মনে একসাথে হাজারো প্রশ্ন দলা পাকিয়ে উঠছিল। এতদিন পর চিনতে পারবে তো আমাকে? পাশ কাটিয়ে চলে যাবে না তো? কেন আসেনি সেদিন আমাদের বাড়িতে? আমার জন্মদিন জানা সত্ত্বেও?  আজ সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে ওকে।

কিন্তু না, ওটা জিলিপির সাইকেলের বেল ছিল না। দশএগারো বছরের একটা বাচ্চা ছেলে সাইকেলে চড়ে বাড়িতে বাড়িতে দৈনিক সংবাদপত্র বিলি করে বেড়াচ্ছিল। আমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে একটা বাড়ির দোতলার ঝুল বারান্দায় ঠিক জিলিপির মতো করেই কাগজের রোলটা ছুঁড়ে দিল ও। আমি নিজের হতাশ মনকে সামলে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়াব, ঠিক এমন সময়েই পিছন থেকে খুব চেনা একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো আমার কানে। সে বলছিল, “ছোটু, একটু দাঁড়া তো। কথা আছে আমার তোর সাথে।পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম সবুজ পাঞ্জাবি পরা বছর ছাব্বিশের এক যুবক হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে আসছে আমারই দিকে। একি ! জিলিপি না ? হ্যাঁ, জিলিপিই তো ! জিলিপি আমাকে খেয়াল করল না, পাশ কাটিয়ে চলে গেল। যখন বাচ্চা ছেলেটির সাথে কথা বলতে ব্যস্ত, আমিই তখন ওকে গিয়ে ডাকলাম। ওর মুখ দেখে মনে হল এত বছর পর আমাকে দেখে খুশি হবে না অবাক হবে, সেটাই বুঝতে পারছে না।

বিস্ময়ের ঘোরটা কাটিয়ে উঠে জিলিপি ছোটুকে বলল, “তুই এখন যা, আমি পরে তোর সাথে কথা বলে নেব।আর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “চল, শিমুলতলায় গিয়ে বসি।

— “শিমুলতলা? শিমুলতলায় কী করে যাব শুনি ? পার্কের গেটে তো এখনো তালা দেওয়া।আমি হকচকিয়ে গিয়ে বললাম। 

— “তুই আয় আমার সাথে, আয়। হেসে উত্তর দিল। জিলিপির সাথে পার্কের পিছন দিকটায় গিয়ে দেখি শিমুল গাছটার ঠিক পিছনে আরও একটা গেট রয়েছে এবং সেটাতে তালা দেওয়া নেই। শিমুল গাছটার নীচে  একটা বেঞ্চের উপর বসলাম আমরা। কয়েক মুহূর্ত সব চুপচাপ। দশ বছরের নীরবতা ভঙ্গ করা কি এতই সহজ? সময়ের সাথে সাথে মনের দূরত্বটাও যে বেড়ে গেছে অনেক।

— “তুই তো আমাকে চিনতেই পারিস নি !” খানিকটা অভিমানের সুরেই বললাম আমি।

— “কী করে চিনব শুনি? দশ বছর পর মাখা সন্দেশ যদি রসগোল্লা হয়ে ফিরে আসে, তাহলে কি চেনার কথা?” ব্যস, আর যায় কোথায় ! তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলাম আমি ! ওর কানে হ্যাঁচকা টান দিয়ে বললামআমি রসগোল্লা? আমি রসগোল্লা? তুই কী? তুই দানাদার। তুই সরভাজা। তুই কালোজাম। তুই ….”

— “ব্যস, হয়ে গেল তো ? হয়ে গেল ? বাঙালি হয়ে মিষ্টির নাম ভুলে যাচ্ছিস তুই ? রাবড়ি, রসমালাই, মৌচাক, লবঙ্গ লতিকা, মিহিদানা

— “ব্যস, ব্যস, ব্যস, অনেক হয়েছে। আর মিষ্টির দোকান দিতে হবে না আপনাকে।

— “না, না, দোকান দিতে হলে তো আমি মিষ্টির দোকানই দেব। দশ বছর ধরে মাখা সন্দেশ খাওয়া হয়নি আমার, একি কম কষ্টের ?”

— “আর আমি ? আমি যে দশ বছর ধরে জিলিপি খাইনি ? রথের মেলাতেই যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি ? কেন যাসনি তুই সেদিন আমার জন্মদিনে ? বল, এক্ষুনি বল।আমি ততক্ষণে জিলিপিকে মারতে আরম্ভ করেছি। চিৎকার করতে করতে বলল, “আরে, বলতে দিলে তো বলব।

— “বল, এক্ষুনি বল।আমি ওর ঘাড়টা চেপে ধরে রেখেছিলাম এতক্ষণ। ছেড়ে দিতেই নিজের ঘাড়ে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “বাবা কি জোর রে তোর গায়ে ! ক্যান্সার নিয়ে রিসার্চের পাশাপাশি কি ক্যারাটে কুংফু এসব করছিস নাকি ?”

— “এক মিনিট। তুই কী করে জানলি যে আমি ক্যান্সার নিয়ে রিসার্চ করছি ?” আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম।

— “তুই তো বিখ্যাত মানুষ। আমাদের এলাকায় সবাই তোর নাম জানে।

— “আর তুই ? তুই কী করিস এখন ?”

— “আমার ছোটখাটো একটা পাবলিশিং কোম্পানি আছে। যেসব লেখক বা লেখিকারা এখনো বিখ্যাত হতে পারেননি, আমি তাদের লেখা প্রকাশের সুযোগ করে দিই। এই আর কি!” কিছুক্ষণ আবার সব চুপচাপ। ফের আমিই নীরবতা ভঙ্গ করলাম। অধৈর্য হয়ে বললাম, “তুই বলবি কি বলবি না ? কেন যাসনি সেদিন আমাদের বাড়ি ?”

এরপর যা বলল, তা কতকটা এইরকম। সেদিন আমার জন্মদিনের উপহার কেনার জন্য ওর মামীমার কাছে কিছু টাকা চেয়েছিল। ওর মামা তখন কাজের সূত্রে বাইরে ছিলেন। ওর মামীমা ওকে টাকা তো দেনই নি, উলটে ওকে চড় মেরেছিলেন। এরপরেও আমার জন্য কার্ড বানিয়েছিল, তাতে কবিতাও লিখেছিল। খবরের কাগজ বিলি করে যেটুকু পেত, তার প্রায় সবটাই ওর মামীমাকেই দিয়ে দিত। ওর কাছে প্রায় কিছুই থাকত না। অনেক খুঁজে ওর একটা জামার পকেট থেকে একটা পাঁচ টাকার কয়েন পেয়েছিল। ভেবেছিল সেই কয়েনটা দিয়ে আমার জন্য একটা ছোট্ট ক্যাডবেরি কিনবে। কিন্তু এত কিছুর পর বেশ বেলা হয়ে গিয়েছিল। কাছাকাছি দোকানগুলো সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ক্যাডবেরি কেনার জন্যে ওকে বেশ খানিকটা দূরে যেতে হয়েছিল। দেরী হয়ে গিয়েছিল বলে সেখান থেকে ক্যাডবেরি কিনেই কোনদিকে না তাকিয়ে আমাদের বাড়ির দিকে দৌড়তে শুরু করে। ঠিক এমন সময়েই পিছন থেকে একটা গাড়ি এসে ওকে ধাক্কা দেয়। বেশ কিছুদিন যমে মানুষে টানাটানির পর অবশেষে বেঁচে যায়।   

সব শোনার পর আমার মুখ থেকে কোন কথাই সরছিল না। এত কিছু ঘটে গেছিল সেদিন অথচ আমি কিছুই জানতে পারিনি। অথবা হয়তো জানার চেষ্টাই করিনি। সত্যিই তো, আমার তো উচিত ছিল ওর খোঁজ নেওয়া। জিলিপি আমার জন্মদিনে ইচ্ছে করে আসবে না, এটা হতেই পারে না। কিন্তু এই কথাটা আমি সেদিন একবারের জন্যেও ভেবে দেখিনি। হাসপাতালের বেডে শুয়ে দিনের পর দিন আমার জন্যে অপেক্ষা করেছে। কিন্তু আমি ওর সামনে একবারের জন্যেও  গিয়ে দাঁড়াইনি। শেষ পর্যন্ত ধরেই নিয়েছিল যে আমি ওকে ভুলে গিয়েছি। তাই সুস্থ হওয়ার পরে আমার সাথে দেখা করার চেষ্টাও করেনি। 

আমাকে বাকরুদ্ধ হয়ে বসে থাকতে দেখে জিলিপি আমার একটা গাল টিপে দিয়ে বলল, “থাক, অনেক হয়েছে। আর পানতুয়ার মতো মুখ করে বসে থাকতে হবে না আপনাকে। বাড়ি যাবি না তুই? দেরী হয়ে যাচ্ছে তো।

— “আমার জন্মদিনের উপহার না নিয়ে আমি কোথাও যাব না।কিছুটা নির্লজ্জের মতোই বলে উঠলাম আমি। আমার কথা শুনে বেশ খানিকক্ষণ ধরে হো হো করে হাসল। সে হাসি যেন আর থামেই না। ওর হাসি দেখে আমার আবার ছোটোবেলার জিলিপির কথা মনে পড়ে গেল। ছোটোবেলাতেও জিলিপি ঠিক এভাবেই হেসে গড়াগড়ি খেত। হাসির দমক সামলে নিয়ে জিলিপি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “আজ সত্যিই হবে না রে। আজ আমাকে একবার অফিসে যেতেই হবে। আজ একটা নতুন ম্যাগাজিন লঞ্চ হওয়ার কথা আছে। আমাকে ওখানে থাকতেই হবে।একটু থেমে ফের বলল, “তুই এক কাজ কর। তুই এখন বাড়ি যা। কাল সকালে ঠিক এই সময়ে তোর উপহার তুই পেয়ে যাবি।

— “মানে? কাল সকালে তুই আমার বাড়িতে আসবি?” আমি আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম। কিছু বলল না, শুধু একটা রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল ওর ঠোঁটের কোণে।

সারা রাত ধরে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ল। যত সময় যেতে লাগল, বৃষ্টির তোড় যেন কমার বদলে আরও বাড়তে লাগল। এরকম চলতে থাকলে জিলিপি কী করে আসবে ? চিন্তায় ভাবনায় আমার রাতের ঘুম উড়ে গেল। দিনের আলো ফুটতেই আমি বাইরে এসে দেখলাম রাস্তায় এক হাঁটু জল। তখনও অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ে চলেছে। আমি বিষণ্ণ মনে কাগজের নৌকো বানাতে আরম্ভ করলাম। অনেক বছর পর ফের সেই ছোটোবেলার মতো নৌকোয় জিলিপির নাম লিখে ভাসিয়ে দিলাম রাস্তায় জমে থাকা বৃষ্টির জলে। নৌকোটা ভাসতে ভাসতে একটা ছোটো সাইকেলের সামনে গিয়ে আটকে গেল। একটা ছোটো ছেলে সাইকেল নিয়ে আমার দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। একি! ছোটু না? সে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “দিদি, তোমার নামই বাহিরি সেন তো ? স্যার তোমার জন্যে একটা জিনিস পাঠিয়েছেন।

— “স্যার মানে?” আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম। আমি তখনও জানতাম না। ছোটুর কাছ থেকেই জেনেছিলাম যে জিলিপি ওকে এবং ওর মতো বেশ কিছু বাচ্চাকে পড়ায়। কিন্তু তার জন্যে কোন টাকা পয়সা নেয় না ওদের থেকে।স্যারবলতে আসলে জিলিপির কথাই বলতে চেয়েছিল।

— “কী জিনিস?” আমি জানতে চাইলাম। ছোটু এবার ওর রেনকোটের ভিতর থেকে ব্রাউন পেপারে মোড়া বইয়ের মতো আকৃতির একটা জিনিস বের করে আমাকে দিল। আমি ওকে বাড়ির ভিতরে আসতে বললেও এলো না। বলল এখনো বেশ কিছু বাড়িতে খবরের কাগজ বিলি করা বাকি আছে। আমি ওকে দেখে শুনে ধীরে সুস্থে সাইকেল চালাতে বলে জিনিসটা নিয়ে দোতলায় উঠে এলাম। জিলিপি নিজে না এসে ছোটুকে পাঠিয়েছে বলে বেশ কিছুক্ষণ ঠোঁট ফুলিয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে বসে থাকলাম আমি। কিন্তু ব্রাউন পেপারে মোড়া জিনিসটা আসলে ঠিক কী, সেটা না দেখা পর্যন্ত শান্তিও পাচ্ছিলাম না। তাই শেষ পর্যন্ত কৌতূহলী হয়ে খুলেই ফেললাম তার গায়ের বাদামি আবরণ। ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো একটা সদ্য প্রকাশিত বাংলা পত্রিকা, যার নামমাখা সন্দেশএবং সম্পাদকের নাম অনির্বাণ চৌধুরী।

5 5 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
wpDiscuz
0
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x
Exit mobile version