স্বপ্ন দেখে সেই শেষ কবে এক বুক নিশ্বাস নিয়েছিলাম তা বলতে ঢের স্মৃতি খরচা করার প্রয়োজন হয়ত নেই। স্তব্ধতায় বিলীন হতে চাওয়া ইচ্ছাকৃত উদাসীনতা তো সেই কবেই পরিহার করেছি। পাথুরে নাগরিকতা আর সমাজবোধ বেঁধে দিয়েছে তার দুঃখবিলাসী নদীভাঙনে বোধদয়ের কংক্রিটময় বাঁধ। প্রারম্ভটা গঙ্গোত্রি হিমবাহ থেকে নয়। তবুও উত্তাল স্রোতে আমার দুঃখনদী ছাপিয়ে গিয়েছে নিজ জীবনতটের প্রতিটি সমুজ্জ্বল কিনারা। নদীতীরটা আমার ভীষণ প্রিয় ছিল। অনেক স্বপ্নও ছিল একে ঘিরে। তবু কেন দীর্ঘ এ সময় তটটাকে ভেঙে চলেছিলাম দুঃখস্রোতের করাল গ্রাসে- এ প্রশ্নে বরাবরই নিরুত্তর আমার অগ্রমস্তিষ্ক। সেদিনও বহিঃকর্ণ ঘেষে গোধুলী বাতাসে উড়তে থাকা এক গুচ্ছ চুল আর সোনালি কালো হয়ে আসা নীল শাড়ির অবাধ্য আঁচলে পলক হারিয়েছিলাম আমি। আর সেদিনই প্রথম তুমি অসত্যের ধুম্রজালে আমাকে শুনিয়েছিলে তোমার দ্বিধাগ্রস্ত পাপবোধের অপারগ স্বীকারোক্তি। আমার হঠাৎ স্তব্ধ ধ্রুবক অনুভুতি ভেদ করে তোমার কপটতার আঁচড় উপহার দিয়েছিল আমার বাম অলিন্দে গাঢ় এক ক্ষতের। আকস্মিকতায় অশ্রুপাতের অভ্যাস নেই বলেই হয়ত সেদিন কাঁদিনি আমি। কিন্তু লাল-নীল রঙিন স্বপ্ন, অনুভূতির প্রগাঢ়তা আর শ্রদ্ধাবোধের আতিশয্যের মিশ্রণে যে আমাশচুম্বী হিমালয় নিজ হাতে গড়েছিলাম সে আর নিষেধ মানল না। অনৈচ্ছিক তীব্রতাকে অতিক্রমে গলে চলল তোমার সঞ্জীবনী স্পর্শে জমে যাওয়া অশ্রুখণ্ড। তোমার চিরস্থায়ীত্বের অতিনিশ্চয়তার সুখে গলতে ভুলেই বসেছিল। হিমালয় বেয়ে ছুটে চলল সে দুর্দম্য স্রোত। ধুয়ে নিল তিল তিল করে গড়ে তোলা স্বপ্ন আর শ্রদ্ধাটুকু। পাদদেশে সে স্বপ্ন আর শ্রদ্ধার রূপান্তর ঘটলো ঘৃণা আর হতাশায়। শুধু ধুয়ে গেল না ভালোবাসাটা। কারণ নিখাদ সে ভালোবাসার মিশ্রণ ছিল হিমালয়ের গোড়া হতে চূঁড়া অবধি প্রতিটি কণার অস্তিত্বজুড়ে। প্রবল স্রোতের সক্ষমতায় হয়তো তার পুরোটা ধুয়ে নেওয়া ছিল সীমাবদ্ধতাময়। সেই অধোয়া-অযাচিত ভালোবাসাই ধ্বংস করে দেয় বিবেক স্নায়ুর সাথে আমার দেহাবশেষের যোগাযোগ। অতঃপর দুঃখবিলাসী নদী বয়ে চলল প্রতিটি হৃদয়গ্রাহী বাগানকে তার গর্ভে বিলীন করে। তাল মেলাতে পারিনি তার সাথে আমি। স্বপ্নহীন, সম্ভাবনাহীন আর শ্রদ্ধাহীন ভালোবাসা আঁকড়ে আজও আমি পড়ে আছি অন্ধকার হিমালয়ে। ব্যস্ততা, বাস্তবতা আর কালব্যাপনে সৃষ্ট বাঁধে সদা শান্ত আজ দুঃখনদী। তবু সবার অগোচরে আজও সে বয়ে চলে নীরবে। আমার বিবস্ত্র বিচরণে আজও অভিসম্পাত প্রতিফলিত হয় স্বীয় হিমালয়ে। আজও যখন অপরাহ্ণ শেষে শান্ত অরুণের পশ্চিমগামীতায় আগত গোধূলী রুদ্ধ করে দেয় এই হিমালয় থেকে মুক্ত হওয়ার প্রতিটি বিরল পথ। অন্ধকার উপত্যকায় দুঃখনদীর স্বচ্ছ জলে সোনালি সূর্যের অস্তাগমনে যুগপৎ পেয়ে বসে আমায় অপরিমেয় অনুভূতির সংনম্যতা।