Home Life Travel রূপসী ইয়াংইয়াং

রূপসী ইয়াংইয়াং

0

পাহাড়ের ওপর বাঙালীর দুর্বলতা নতুন কিছু নয়। বিশেষ করে এপ্রিল-মে মাসে কলকাতায় যখন সূর্য দেব-এর মস্তানি চরমে ওঠে, সবাই গরমে হাঁসফাঁস করে তখন কটা দিন পাহাড়ে একটু ঠাণ্ডায় বেড়াতে যাবার জন্য মনটা ছটফট করে ওঠে। আর সেটা যদি সিকিম হয় তো তাহলে কথাই নেই- গ্যাংটক- নামটা শুনলেই মনটা কেমন নেচে ওঠে। প্রত্যেক বাঙালীর কাছে গ্যাংটক, পেলিং, ছাঙ্গু, ইয়ুম্থাম, গুরুদম্বার লেক, লাচুং, লাচেন খুব প্রিয় জায়গা আর এগুলো সবার কাছেই খুব পরিচিত নাম।

আজ আমি একটা সিকিমের নতুন জায়গার কথা বলব যেই জায়গা টার নাম হয়তো আপনারা শোনেন নি। ইয়াংইয়াং বা ইয়াঙ্গাং, সাউথ সিকিম এর একটি ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম। ভাবছেন তো কিভাবে যাবেন?  শিলিগুড়ি থেকে গ্যাংটক গামী যেকোনো গাড়িতে উঠে পড়ুন। সব গাড়ি রংপো, সিংথাম হয়ে গ্যাংটক যায়। সিংথামে নেমে পড়ুন। এটি সিকিমের একটি অন্যতম ব্যস্ত জায়গা, বড় মার্কেট আছে।

তবে একটা কথা বলি পাহাড় মানেই ভাববেন না সব জায়গাই খুব ঠাণ্ডা, সিংথামে বেশ গরম। এখান থেকেই ইয়াঙ্গাং এর গাড়ি পেয়ে যাবেন। সিংথাম থেকে পাবং ফটক হয়ে ইয়াং ইয়াং যাবার পথে তিস্তা নদীর ধারে আরও একটি ছোট পাহাড়ি গ্রাম পড়বে- মাঙ্গলে। মোটামুটি ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই ইয়াঙ্গাং পৌঁছে যাবেন। তবে ইয়াং ইয়াং বেশ ঠাণ্ডা, প্রায় গ্যাংটক এর মতই আবহাওয়া, তবে শীতে আমার তো মনে হয় কখনও কখনও এখানে গ্যাংটকের থেকেও বেশী ঠাণ্ডা পড়ে।

দীর্ঘ দিন আমি ইয়াং ইয়াং-এ থেকেছি, এখানে Sikkim Govt.-এর একটি স্কুলে আমি ফরাসী  ভাষার শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছি, তাই খুব কাছ থেকে এই সুন্দর পাহাড়ি গ্রামটাকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে।  এখানকার মানুষজন খুব আন্তরিক, এখানে অনেক ভালো বন্ধু পেয়েছি। এদের বন্ধুত্ব পূর্ণ ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করে।

পাহাড়ের ওপর ভোরের সূর্যোদয় থেকে বিকেলের সূর্যাস্ত, শীতকালে (মোটামুটি অক্টোবরের শেষ বা নভেম্বরের শুরু থেকেই শীতের আমেজ শুরু) কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ায় সাদা বরফের মখমলের মোহময়ী রূপ- আহা কি অপূর্ব তার শোভা। আর সন্ধ্যার পরেই উল্টোদিকের পাহাড়গুলোতে সব বাড়ীর  আলোগুলো ঠিক যেন হাজার হাজার জোনাকি পোকার মত জ্বলে ওঠে। রাতে হাল্কা ঠাণ্ডা সবসময়েই থাকে, আর শীতে তো বেশ কনকনে, টনটনে। মাঝে মাঝে আর একটা সুন্দর অভিজ্ঞতা হল চারিদিক মেঘে ঢেকে যায়, কিছু দেখা যায় না, জানলা খোলা থাকলে মেঘ ঘরে ঢুকে পড়ে।

এখানে একটি বিশাল পাহাড় আছে যার স্থানীয় নাম ‘ভালে দুঙ্গা’, উচ্চতা প্রায় ১১,০০০-১২,০০০ ফুট। দুপুর ২ টোর পর  সাধারণত ভালে দুঙ্গার ওপর মেঘের আনাগোনা শুরু আর বিকেলে বা রাতে বৃষ্টি। এখানে একটু বেশী বৃষ্টি হয়।  শীতে এই পাহাড়ের ওপর বরফ জমে থাকে। এই পাহাড়টির জন্যই এখানে শীতে এত বেশী ঠাণ্ডা। তবে আরও একটা কথা বলি- দার্জিলিং-এ যেমন জলের কষ্ট, এখানে তা নয়, এখানে পাবেন অফুরন্ত জল, আর এই জলের উৎস ঝরনার জল।

এই ‘ভালে দুঙ্গা’- র উপর স্কাই ওয়াক তৈরি হচ্ছে, পৃথিবী তে এই স্কাই ওয়াক খুব বেশী নেই। সম্ভবত ভারতবর্ষে এই প্রথম এবং এশিয়াতে দ্বিতীয়। প্রচুর অর্থ ব্যয় করে এই স্কাই ওয়াক তৈরি হচ্ছে এখানে। মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী ডঃ পাওয়ান কুমার চাম্লিং-এর স্বপ্ন এই ইয়াং ইয়াং কয়েক বছরের মধ্যেই সিকিমের সেরা পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠবে এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও স্কাই ওয়াক এর জন্য। এই স্কাই ওয়াক প্রজেক্ট এর কাজ ফ্রান্স-এর একটি কোম্পানির হাতে দেওয়া হয়েছে।

এখানকার মার্কেটটি বেশ সাজানো গোছানো, সুন্দর বসবার জায়গাও আছে। প্রাকৃতিক দৃশ্য খুব মনোরম,  চারিদিক পাহাড়ে ঘেরা। এই ইয়াঙ্গাং হল সিকিমের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী ডঃ পাওয়ান কুমার চাম্লিং-এর জন্মস্থান। সিকিমের সচেয়ে বড় পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারও এখানেই অবস্থিত। লোকাল ট্যাক্সি নিয়ে একটু  ইয়াঙ্গাং ঘুরে দেখে নিতে পারেন- কালচার পার্ক, বিভিন্ন মন্দির, হেলি প্যাড, একটা ছোট লেক, ‘নয়া ফলস’, Yangang monastery, Gurung monastery, Lepcha monastery ইত্যাদি। সিকিম ইউনিভার্সিটি এখানেই তৈরি হচ্ছে।

যারা একটু নিরিবিলিতে একটু পাহাড়ি শোভা উপভোগ করতে চান, এখানে তাদের বেশ ভালই  লাগবে। এখানে ময়না গুঁড়ির বাঙালি বউদির চা, জলখাবারের দোকানও পেয়ে যাবেন আর বাংলায় কথা  বলার লোকও পেয়ে যাবেন। ডাল, সবজি, চিকেন, ডিম পেয়ে যাবেন, মাছ ও পেতে পারেন। আর বাঙালীর ভাত না হলে চলে না জানি। এখানে কোনও অসুবিধে নেই সিকিমেও লোকে ভাতই খায়। এখানকার স্থানীয় কিছু খাবারও খেয়ে দেখতে পারেন- মোমো, থুকপা, ছুরপি, গুন্দ্রুক কো আচার, সায়েল রোটি, খাব্জে ইত্যাদি। যারা খুব ঝাল পছন্দ করেন এখানকার লঙ্কা খেয়ে দেখতে পারেন- ডল্লে খুরসানি।

এখানে কি সুন্দর লাউ কুমড়ো হয় দেখলে অবাক হয়ে যাবেন। আর জুন-জুলাই তে এখানে দেখতে পাবেন সারি সারি ভুট্টা গাছ। এই ভুট্টা একটু সেদ্ধ করে খেয়ে দেখতে পারেন, আহা কি সুমিষ্ট আর নরম! আর দেখবেন প্রায় প্রতিটি বাড়ীতে আর একটি সবজি প্রচুর দেখা যায় যার স্থানীয় নাম ‘ইস্কুস’, যেটি আমরা স্কোয়াস বলি।এই স্কোয়াশ এর শাকও বেশ নরম ও সুস্বাদু, অনেকটা আমাদের লাউ শাকের মত।

এখানে খুব ভালো বিন্স হয়। এখানকার আদা, তেজ পাতা ও খুব ভালো মানের। আর একটা কথা জেনে রাখা ভালো যে এখানকার শাক সব্জি সব organic, কোনও রাসায়নিক সার ব্যবহার  করা হয় না। তাই এখানে শাক সব্জির স্বাদ বেশ সুন্দর। যাদের আবার পাহাড়ে একটু সুরা পানের ইচ্ছে তারাও বঞ্চিত হবেন না, এখানে অনেক দোকান আছে, আর কলকাতার তুলনায় দামও অনেক কম। কিছু লোকাল ড্রিঙ্ক ও পাবেন, প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি যেমন রক্সি, ধুংরু, কোদো কো জার। এই কোদো কো জার একটি কাঠের উঁচু লম্বা পাত্রে দেওয়া হয় এবং সরু বাঁশের পাইপ দিয়ে খেতে হয়।

তবে রাস্তায় এখানে ওখানে কিছু ছুঁড়ে ফেলবেন না, রাস্তায় ধূমপান না করাই ভালো। প্রকৃতির ডাকে এখান ওখান দাঁড়িয়ে পরবেন না, ছোট খাটো ঝরনার জল এখান ওখান দিয়ে বয়ে যায়, সেখানে তো একদমই নয়। সিকিমে এই নিয়ম গুলো মেনে চলবেন। সিকিমে ওপেনলি সিগারেট খেলেই পুলিশ ধরবে আর সঙ্গে সঙ্গে স্পট ফাইন।

এই ইয়াঙ্গাং থেকে আপনি সব জায়গায় যেতে পারবেন। ডিরেক্ট এখান থেকে গ্যাংটক যাবার গাড়ি পেয়ে যাবেন, দু ঘণ্টার কিছুটা বেশী সময় লাগবে। তবে যেহেতু এটা সাউথ সিকিমে তাই সাউথ সিকিমের কিছু দর্শনীয় স্থান দেখে নিতে পারেন। ইয়াঙ্গাং থেকে রাবাংলা যেতে ৩০-৪০ মিনিট সময় লাগে। কিন্তু এই রাবাংলা যাবার রাস্তাটি প্রায়শই ল্যান্ডস্লাইড হবার ফলে বন্ধ থাকে। তাই একটু ঘুর পথে যেতে হয়, তখন সময়টা একটু বেশী লেগে যায়। রাবাংলা খুব সুন্দর জায়গা। শীতে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। বেশী রাতে  কখনও হাল্কা তুষারপাতও হয়। সকালে দেখবেন সব গাড়ির ওপর হাফ ইঞ্চি বরফ পড়ে আছে।

এখানে বুদ্ধ পার্ক একটি অতি জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান। এখান থেকে চলে যান সোজা ‘নামচি’। রাবাংলা থেকে নামচি এক ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাবেন। নামচি বা রাবাংলা যাবার পথে রাস্তায় ঝুরো বরফও কখনও দেখা যায়। ‘নামচি’ শব্দের অর্থ হল ‘sky high’। এটি সিকিমের দ্বিতীয় বৃহত্তম ও গুরুত্বপূর্ণ শহর (গ্যাংটকের পরেই)। প্রাকৃতিক শোভা বেশ মনোরম। বেশ কিছু বিলাসবহুল হোটেলও আছে।

এখানকার সেন্ট্রাল পার্কটি খুব সুন্দর সাজানো গোছানো। সুন্দর বসার জায়গাও আছে, চারিদিকে বিভিন্ন দোকানপাট আর আছে একটি বিশাল মাপের একুরিয়াম। সন্ধ্যার পর এখানে বসে সময় কাটাতে বেশ ভালই লাগবে। নামচিতে অনেক দেখার জায়গা আছে, আর আছে বিভিন্ন মন্দির। কিন্তু নামচির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হল ‘সিদ্ধেশ্বর ধাম’ যেটি ‘চারধাম’ বলেও পরিচিত। এটি একটি অসাধারণ দর্শনীয় স্থান। হিন্দুদের সব ধাম এখানে একসাথে দেখতে পাবেন। পাহাড়ের ওপর এমন অসাধারণ স্থাপত্যের নিদর্শন খুব কমই আছে।

আর এখানেই আছে শিবের একটি বিশালকায় মূর্তি। না দেখলে সত্যি মিস করবেন। বাড়ীতে বৃদ্ধ বাবা মা থাকলে তারা যদি শারীরিক ভাবে সক্ষম থাকেন তাহলে তাঁদের একবার এই ‘চার ধাম’ দেখিয়ে আনতে পারেন, তাঁরা খুব খুশী হবেন। এই নামচি থেকেই গাড়ি করে একটি ছোট গ্রাম সাদাম সান্তালে থেকে ঘুরে আসতে পারেন। ওখানে একটি সুন্দর দর্শনীয় স্থান আছে যা আপনাকে মুগ্ধ করবে। ‘তারে ভির’- খুব মনোরম একটি জায়গা, যেখান থেকে পুরো কালিম্পং শহরটি দেখা যায় আর এখনে পাবেন পাগলা হাওয়া, কোনও কিছু ছুঁড়ে দিলে হাওয়ার টানে সেটি আবার আপনার কাছেই ফিরে আসবে। জায়গাটি না দেখলে মিস করবেন। এই নামচি যাবার পথেই আপনি দেখে নিতে পারেন সিকিম এর একমাত্র চা বাগান- তিমি টি গার্ডেন।

তাই যারা একটু নিরিবিলি তে কিছুদিন কাটাতে চান, ইয়াং ইয়াং- এ কদিন কাটিয়ে যান। আর এখান থেকে আপনাদের প্রিয় সব জায়গাতেই যেতে পারবেন। এখানে সিকিমের কিছু অপরিচিত জায়গার কথা বললাম। তাই সিকিম বেড়াতে গেলে গ্যাংটক, পেলিং এর সাথে এই জায়গাগুলোও একবার ঘুরে আসার চেষ্টা করবেন।

আশা করি আপনাদেরও খুব ভালো লাগবে। আমার চোখ দিয়ে মোহময়ী ইয়াং ইয়াং কে যেভাবে দেখেছি সেভাবেই আপনাদের কাছে তুলে ধরলাম। আপনাদের যদি ভালো লাগে তবেই আমার ফটোগ্রাফি সার্থক। আর স্কাই ওয়াক চালু হয়ে গেলে তো আর কথাই নেই, তখন তো সিকিম বেড়াতে এলে ইয়াং ইয়াং আসতেই হবে এই বিরল অভিজ্ঞতার সাক্ষী হতে।

 

~ রূপসী ইয়াংইয়াং ~

 

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
wpDiscuz
0
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x
Exit mobile version