‘কলম লে আও,কাগজ লে আও,কালী লে আও ধাঁ করকে’শ্রীমতি শোভনা দেবী ও শ্রীমতি নলিনী দেবীকে লেখা কবিগুরুর ‘শিলংয়ের চিঠি’ নতুন যুগের লোকের কাছে বড়াই করে রাখবার মতো৷ শরতের জ্যোৎস্না,শীতের উষ্ণাভা,আকাশের ঘন মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকা চোখের প্রশান্তির মতো উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মেঘমল্লার শৈলশহর শিলং রবীন্দ্রনাথকে তৃপ্তি করত তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সস্নিগ্ধ স্পর্শে৷ কবির ভাষায়—’…বিশেষত শীতের দেশ,জিনিসে-মানুষে বিচ্ছেদ সুখকর নয়৷ যা হোক, শিলঙ পাহাড়ে এসে দেখি,পাহাড়টা ঠিক আছে,আমাদর গ্রহ বৈগুণ্যে বাঁকেনি,চোরেনি,নড়ে যায়নি দেখে আশ্চর্যবোধ হল,এখনও পাহাড়টা ঠিক আছে৷’
নীল গগনের প্রত্যুষে জেগে উঠা পাখির নীড়ের মতো আপন ছিল শিলং রবীন্দ্রনাথের কাছে৷ ‘শেষের কবিতা’-য় শিলং সৌন্দর্য বর্ণনায় চিত্রকর রবীন্দ্রনাথের ভাষ্যে অমিতের ভাবনালোক—’শিলং পাহাড়টা চারিদিক থেকে অমিতকে নিজের মধ্যে যেন সরিয়ে নিচ্ছে৷ আজ সে উঠেছে সূর্য ওঠবার আগেই,জানালা দিয়ে দেখলে দেবদারু গাছের ঝালরগুলো যেন কাঁপছে,আর তার পিছনে পাতলা মেঘের ওপর পাহাড়ের ওপর থেকে সূর্য তার তুলির লম্বা লম্বা টান লাগিয়েছে…৷’
শিলং সফরে বোঝা যায় প্রকৃতিপ্রেমীর কাছে সেইরূপ কেমন মোহময়ী৷ ঘন রাত্রির মায়াময় অন্ধকার “নিশীথে’ কিংবা ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পের নিস্তব্ধতাকে মনে করিয়ে দেয়৷ পাহাড়ের বাড়িগুলি থেকে ভেসে আসা ঝালর বা চিমনির আলো আকাশ থেকে খচিত নক্ষত্রের মতো মনে হয়৷ আঁকা-বাঁকা সরু পথের বিশুদ্ধ,নির্মল শীতল সমীরণ মন হরিণী করুণ তাল তুলে সুরার ন্যায় মাতিয়ে তুলে৷ ফুলের একগুচ্ছ রাশি রাশি সমারোহ সাদৃশ্য আবেগের এহেন উচ্ছ্বসিত জোয়ারে রবীন্দ্রনাথের লেখনীতে প্রকৃতি ঐশ্বর্যবান৷তাই ”অজানা খনির নতুন মনি”কিংবা ”অধরা মাধুরী” ধরে তাঁর ছন্দোবন্ধনে পরিবেশিত—
“আমার যাবার বেলায় পিছু ডাকে
ভোরের আলো মেঘের ফাঁকে ফাঁকে
বাদল প্রাতের উদাস পাখি উঠে ডাকি
বনের গোপন শাখে শাখে পিছু ডাকে”
রবীন্দ্রনাথ—মহাসমুদ্র তুল্য৷ সমুদ্রের গভীরতাকে তলিয়ে দেখার সুখ নেই বরং সেই সৌন্দর্যের গভীরতায় মন-প্রাণ জুড়িয়ে আত্মসমর্পণ করাটাই সুখের৷তারঁ রচনা মহত্ত্বের প্রতি নিবেদন৷এমন কোনো আবেগ বা অনুভূতি নেই যা তিনি বলে যাননি৷ তাই শিলংয়ে বেড়াতে গিয়ে যখন তিনি হাতে কলম তুললেন সেখানে কেবল সাহিত্যের সাহিত্য সৃষ্টিই ছিল না, ছিল প্রকৃতির প্রতি এক নিবিড় সচেতনতা৷ তিনি বলেছেন ‘আস্ত পাওয়াটা যদি নিতান্ত অসম্ভব তবে আস্ত হারানোটাই’শ্রেয়৷তিনি শিলংয়ের নিরালাময় জগতে আস্তটাই খুঁজে পেয়েছিলেন৷ তাই লিখলেন—’গর্মি যখন টুটলো না আর পাখার হাওয়া সরবতে ঠান্ডা হতে দৌড়ে এলুম শিলং নামক পর্বতে।’ (‘শিলংয়ের চিঠি’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর৷) ১৯১৯ সালের বিক্ষুব্ধ ভারতে প্রতিবাদী হিসাবে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রাওলাট এক্ট, জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড-এই বিষয়গুলি আহত করছিল তাঁকে৷ প্রায় চারশো নিরপরাধ ভারতবাসীর মৃত্যু৷ তিনি ঐ বছরের ১৩ই এপ্রিল ভাইসরয়কে চিঠি দিয়ে ‘নাইটহুড’ ত্যাগ করেন।ওই সময়েই শিলং পর্বতে তিনি শান্তির সন্ধানে গিয়েছিলেন৷ রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন,তাঁর সাহিত্যিক কর্মের দায়িত্ব৷ তাই পৃথিবীর এমন কোনো হয়তো স্থান নেই যেখানে তিনি নিজে উপস্থিত না থেকে একছত্র পংক্তিও লিখেছেন৷ ‘বিশ্বকবি’ তাঁর নিজস্ব নিষ্কাম-কর্মযোগী মনে ভারতবাসীকে দেশমাতৃকার বন্দনা করতে শিখিয়েছেন৷ দেশের প্রত্যেকটি রাজ্যকে ভালবাসতে শিখিয়েছেন৷
আজ পূণ্য করো ন্যায়ধীশ,
সত্যের প্রেমিক-অনুসন্ধানে ৷
পরিশেষে,—
“তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান;
;
গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায় ,
বন্ধু, বিদায়।”
শিলং যাত্রায় তাঁর সাহিত্যিক পটভূমিকা হিসেবে ‘শেষের কবিতা’ অমর হয়ে থাকুক যুগান্তরের মানসালোকে৷
When you login first time using a Social Login button, we collect your account public profile information shared by Social Login provider, based on your privacy settings. We also get your email address to automatically create an account for you in our website. Once your account is created, you'll be logged-in to this account.
DisagreeAgree
I allow to create an account
When you login first time using a Social Login button, we collect your account public profile information shared by Social Login provider, based on your privacy settings. We also get your email address to automatically create an account for you in our website. Once your account is created, you'll be logged-in to this account.