Home Literature Stories বড়শি

বড়শি

1
বড়শি

১৯৯৮ সাল আমি মেরী ষ্টোপস এ চাকুরী করি। আমরা অনেক বন্ধু একসাথে ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম কিন্তু চাকুরীর নিয়োগ পেয়েছি পাচঁজন। সবার সাথে আমার সম্পর্ক ভালই ছিল কিন্তু রেহনুমার সাথে একটু কম। রেহনুমার মতো অফিস ছুটির পরে লাকী প্লাজায় গিয়ে ফুসকা খাওয়া, শপিং ইত্যাদি আমারর হ’য়ে উঠত না। আমি মিথিলা দিদির (পি এম) গাড়ীতে করে কিভাবে কতদ্রুত বাসায় ছেলের কাছে ফিরব, ওটাই ছিল আমার একমাত্র চাওয়া। যার কারণে আস্তে আস্তে রেহনুমার সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে।

রেহনুমার বড় বোন ওদের সাথে থাকতেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর স্বামী মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। আমি উনাকে বুবু ডাকতাম। বুবুর ছিল ডায়বেটিক। তাই সব সময় আমাদের অফিসে এসে সুগার পরীক্ষা করাতেন। নাস্তা খাওয়ার দু’ঘন্টা পরে যেটা দিতে হতো, তখন বুবু রিকভারী রুমে ব’সে, বা আমাদের টেবিলে এসে গল্প করতেন। আমার আবার ছোটবেলা থেকে একটা স্বভাব, বয়সে বড়দের সাথেই বন্ধুত্ব বেশী ছিল। সেই সময়ে মোবাইল ছিল না তারপরও বুবু কয়েকদিন পর পর বাসা থেকে আমাকে অফিসে ফোন দিতেন লাঞ্চ এর সময়। আমি রেহনুমাকে দিতে চাইলে বলতেন, ‘বন্ধু আমি তোমার সাথে কথা বলার জন্য ফোন করেছি’। এই ভাবে অনেকদিন গত হয়।

হঠাৎ একদিন বুবু আমাকে ফোন করে বলেন, ‘আগামী ২০শে ফ্রেরুয়ারী আমার জন্মদিন, তোমার পরিবারসহ আসবে। রাতে তোমাদের গাড়ীতে ক’রে পৌঁছে দেব’। আমি জানতাম রেহনুমারা অনেক ধনী, খুলশীতে থাকে। কিন্তু রেহনুমা সবাইকে যে ভাবে নিমন্ত্রণ করেছে, আমাকে ঠিক তার উল্টো অর্থাৎ বলার জন্যই বলা।

আমি একটু চিন্তিত হয়ে পড়লাম কি করা যায়, আমি তো যাব না। আমি বুবুর জন্য একটা শাড়ী কিনলাম সাদা কালো দোকান থেকে। ২১শে ফ্রেরুয়ারী উপলক্ষ্যে। আর ভাবছি কি ভাবে পৌঁছাবো কিন্তু ২০তারিখ বিকেল থেকেই বুবুর ফোন। কি করবো ভেবে পাচ্ছি না অতঃপর আমার স্বামী আমাকে সমাধান দিল। তুমি কি বুবুকে ভালোবাস??? যদি ভালোবাসা তাহলে যাও। অথচ বন্ধু রেহনুমা সবাইকে ফোন দেয় কিন্তু আমাকে নয়। আমি ইচ্ছার বিরুদ্ধে সাধারণ পোশাক পড়ে একটি ফুলের তোড়া ও শাড়িটি নিয়ে কেমন লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে গেলাম। খুলশিতে ধনীরা থাকে গাড়ী দিয়ে পাহাড়ে উঠতে হয় কিন্তু আমার তো গাড়ী নেই তাই রিক্সা থেকে নেমে বহু কষ্টে উপহার গুলো নিয়ে বেশ কয়েক জনকে জিজ্ঞাসা করে বাড়ীতে ঢুকলাম। আমার আজো বিশ্বাস হয় না বুবু আমার মতো সাধারণ এক মেয়ের জন্য গ্রীলে দাড়িয়ে ছিলেন। আমি বুবুর কাছে গিয়ে পায়ে হাত দিতেই বুবু বলে ‘তোর জায়গা আমার বুকে’।

এতক্ষণ শুধু আপনাদের দীর্ঘদিনের বুবুর সাথে আমার পরিচয়ের ভুমিকাই দিলাম। বুবু আমার উপহারটা নিয়ে শিশুর মতো জিজ্ঞাসা করলেন ‘তুই হাতি ঘোড়া কি এনেছিস’?? তারপর প্যাকেটটা খুলে শাড়িটা নিয়ে চলে গেলেন ভিতরের রুমে এবং খানিকক্ষণ পরে আসলেন।

আমি অবাক হয়ে দেখছি বুবু আমার শাড়ীটা প’রে, হাতে নিকষ কালো একটা বড়শি নিয়ে আমার সামনে। আর সবাইকে চিৎকার করে বলছেন ‘তোরা সবাই আমার ছবি তোল’। আমি অবাক। হাতে বড়শি কেন??
অতঃপর কেক কাটা শেষ হলো এবং খাওয়া দাওয়াও প্রায় শেষ। কিন্তু মাথা থেকে নিকষ বড়শিটা যেন যায় না।

সাহস করে আবার বুবুকে জিজ্ঞাসা করলাম ‘বুবু বড়শি কেন’?? তখন শুধু দেখলাম তার চোখে শ্রাবণ-ধারা। স্বাধীনতা যুদ্ধে বুবুর পুরো বাড়ী পাকিস্তান হানাদার বাহিনী জ্বালিয়ে দেয়। ছোট্ট ছেলেটাকে পাকিস্তানীরা নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলে। তারপর স্বামী মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। বাড়ী জ্বালিয়ে দেওয়াতে পুকুর ঘাটে ছেলেটার ঐই বড়শিটা ছাড়া তার আর কোন স্মৃতি চিহৃ ছিল না। তাই আজ এতগুলি বৎসর নিকষ কালো পুরোনো বড়শিটাই তার দিবানিশি শেষ সম্বল।

 

~ বড়শি ~
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
wpDiscuz
1
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x
Exit mobile version