Home Literature Stories পারিজাতের গল্প ( Parijat’s Story )

পারিজাতের গল্প ( Parijat’s Story )

0

দিনের শুরুটা বেশ ভালই হল যখন পারিজাত ওরফে টিপুর মামা অনেক দিন পর ওদের বাড়িতে এসে ওকে একটা খুব সুন্দর রঙিন ইংরাজি ছবির বই আর দশ টাকা উপহার দিয়ে বললেন , টাকা গুলো দিয়ে আজ যা খুশি কিনতে । এখন __ গল্পটা যে সময়ের , সেই সময়ে দশ টাকার মূল্য অনেক , বিশেষত ওর মত বয়সী ছেলের কাছে এটা অকল্পনীয় অর্থের মালিক হওয়া । অনেক দিন থেকে ওর দুটো জিনিসের খুব ইচ্ছা __ রঙিন লজেন্সের গুলি কেনা আর সিনেমা দেখা । তার বাবা লজেন্সের গুলি খেতে দেন না , তাতে নাকি দাঁত পড়ে যাবে আর সিনেমা তো সে শুধু তার বন্ধুদের মুখে গল্পই শুনেছে , একবারও নিজে যায়নি , বাবাও নিয়ে যাননি । আজ ভাগ্যিস বাবা অফিসে ছিলেন , না হলে দশ টাকাটা তার পকেটে ঢুকতো না , তা ছাড়া  টিপুর বাবা বিলাসিতা একদম পছন্দ করেন না । টিপু হিসাব করে দেখল __ তার দুটো শখই আজ পূরণ করতে পারবে এই টাকাগুলো দিয়ে । প্রথমেই তার চেনা দোকান থেকে পুরো এক প্যাকেট লজেন্সের গুলি কিনলো , দোকান থেকে বেড়িয়েই আগে দুটো গুলি মুখে পুরে চুষতে শুরু করলো , এক প্যাকেট  লজেন্স কেনা টিপুর জীবনে এই প্রথমবার  __ এরপর সে সিনেমা হলের দিকে রওনা হল ।

এখন সিনেমা বলতে আমরা যা বুঝি বা দেখি __ টিপুর সময়ে সেটা অন্য রকম ছিলো , ছোট্ট ছোট্ট গল্প নিয়ে সিনেমা গুলো তৈরী হত , প্রায় সব সিনেমাই বিদেশি __কোনোটা দশ মিনিট বা কুড়ি মিনিট করে চলতো , কিছু সিনেমা নির্বাকও ছিল , ওতে ক্যাপশনে গল্পের অগ্রগতি বোঝানো হত ।

সিনেমা হলটা  সে বাইরে থেকে অনেকবার দেখেছে , কিন্তু তার বাবা কোনোদিন তাকে নিয়ে ভিতরে যাননি _ জীবনে প্রথম সে একা সিনেমা দেখতে শুরু করলো ।

সমগ্র ব্যাপারটাই তার কাছে অসাধারণ স্বপ্নের মত লাগতে লাগলো __ প্রথম গল্পটা দুটো দুঃসাহসী অপরাধীদেরকে নিয়ে _ অসাধারণ দক্ষতার সাথে তারা বিশাল বিশাল বিল্ডিং থেকে লাফ দিয়ে রাস্তা পারাপার করতে লাগলো __ পিছনে পুলিশ ছুটছে আর তারা ক্ষিপ্ত গতিতে এক গলি থেকে আরেক গলিতে প্রায় উড়ে উড়ে যেতে লাগলো , কোনো কারন ছাড়াই তারা চলন্ত মটর গাড়ী থেকে গভীর নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লো _ রোমাঞ্চকর গল্প , টিপু  রোমাঞ্চিত হয়ে গেল ।

দ্বিতীয় গল্পটা ছিল একটা গ্রাম্য প্রেম কাহিনী , যাতে একটি সরল গ্রাম্য মেয়ে একটা রাজ পুরুয়ের মত দেখতে একজনার প্রেমে পড়ে , যদিয় তার দাড়িগোঁফই তাকে খলনায়ক বলে জানাচ্ছিল , তারপর অনেক ঘটনার ঘনঘটার পর গ্রাম্য মেয়েটি একটা গ্রাম্য ছেলের প্রেমে পড়ে , তারা যে ভাবে তাদের আনন্দ প্রকাশ করছিল , জিমনাস্টিকে অসাধারণ দক্ষতা না থাকলে তা সম্ভব হতনা ___ তারপর সেই

দাড়িগোঁফ যুক্ত খলনায়ক জেলে গিয়ে তার গল্প ইতি করলো ।

তারপরের গল্পটাও ছিল একটা প্রেম কাহিনী , যাতে নায়ক ও নায়িকা দুজনাই একে অপরের প্রতি অটুট ভালবাসা ছিলো সেই সঙ্গে একে অপরকে  ধারাবাহিক ভাবে ভুল বোঝাবুঝি করতে লাগলো যা শুধু মাত্র সিনেমাতেই হয় ।  নায়িকার ভাই এখানে একটি দেবদূতের মত সারা গল্পে বিচরণ করতে লাগলো এবং তার বোনকে আগলে রাখতে লাগলো এবং তার জন্যই    নায়ক ও নায়িকার সব ভুল বোঝাবুঝি দূর হলো । এটা হৃদয় স্পর্শী গল্প ছিল, তা টিপুর হৃদয়কেও  স্পর্শ করে গেলো ।

পরেরটা একটা হাসির গল্প ছিলো__ দুটো রঙ মিস্ত্রি দরজা রঙ করতে শুরু করলো__ যখন  রঙ করা শেয হলো , দেখা গেল অগুনতি পথচারীদের অর্ধেক করে  রঙ করে দিয়েছে । গল্পটা খুব মজার_ আর টিপুরও খুবই মজা লেগেছিলো ।

শেয গল্পটা খুব বেদনাদায়ক , গল্পটা শুরু হল একটা অসামাজিক যুবক কে নিয়ে , যে _ দিন রাত মদ্যপান করতো আর তাস খেলত , বৃদ্ধ বয়সেও একই নেশায় মত্ত দেখা গেল । তার একটা দেব শিশুর মত ছোটো মেয়ে ছিল __ যে দিন রাত তার বাবার অধঃপতনের জন্য চোখের জল ফেলত আর তাকে বারংবার নেশামুক্ত জীবনযাপন করতে বলতো । বিরক্ত হয়ে মদ্যপ বাবা একদিন মেয়েটার মাথায় একটা  মদের  বোতল ছুড়ে মারল, যার পরিণতি _ __ মেয়েটা হসপিটালে ভর্তি হল , তখন তার বাবা বুঝতে পারলো নেশার কবলিত হয়ে সে কি সর্বনাশ করেছে ! মৃত্যুর কোলে ঢোলে পরার আগে দেব-শিশু সম মেয়েটি তার বাবাকে সৎ ভাবে জীবনযাপনের পরামর্শ দিয়ে এবং তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা করে চোখ বুজল । টিপু একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল গল্পটা শেষ হলে ।

সিনেমা-হল থেকে বাইরে বেরিয়ে সে তার কল্পনার জগত এ চলে গেল , সে নিজেকে এক দুঃসাহসী পুলিশ বলে ভাবতে শুরু করলো …… তার সামনেই দুটো কাল্পনিক অপরাধী ! সে তার পকেট থেকে একটা পেন্সিল বার করে সিনেমার রিভলভারের মত গুলি করলো , দুটো চোরই গুলিতে নিকেশ হয়ে গেল , এরপর সে অন্য গলিতে অপরাধী খুঁজতে ছুটতে লাগলো __ এই সব কাজ করতে গিয়ে এক দাদুর ছাতার বাঁটে পা আটকে নিজে রাস্তায় পড়ে গেল , একজন তার গোঁত্তা খেয়ে  পড়ে গেল । ছুটতে ছুটতে বাড়িতে ঢোকার সময়েও সে উল্টো দিকে মুখ করে পেন্সিল দিয়ে গুলি করতে লাগলো ।

টিপুর বাবা আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এসেছেন কারণ তাঁর প্রচণ্ড মাথার যন্ত্রণা __ বাগানে উনি পায়চারী করছিলেন তাই , আর তখনই তাঁর  উল্টো দিকে মুখ করা টিপুর সাথে সজোরে ধাক্কা লাগলো । প্রচণ্ড রেগে তিনি টিপুর হাতটা খপ করে ধরলেন __

‘বাঁদর ছেলে , এই রকম ভাবে আমাকে ধাক্কা দেওয়ার মানেটা কি শুনি ?’ হুঙ্কার দিলেন তিনি ।

শান্ত ভাবে বাবার হাত থেকে টিপু নিজেকে ছাড়িয়ে বলল _ ‘আমি টোমাকে ধাক্কা দিতে টাইনি বাবা , আমি আর পাট্টা মানুযের মটই ঘরে ধুক..থিলাম __ আ সস লে টোমায় আমি ডেকটে পাইনি , কারন’ ।

‘একদম চুপ’ আবার হুঙ্কার দিলেন তিনি __ ‘ওই রকম করে কথা বলছিস কেন ? মুখে কি ? অ্যাঁ ? জিব দেখি জিব বার কর ’ । টিপুর মুখে তখন তিনটে লজেন্সের গুলি পোরা , জিবও রঙিন হয়ে গেছে !

‘কতবার আমি বলবো তোকে ওই সব ছাইপাঁশ জিনিস একদম খাবি না ? ’

‘এ গুলো মোটেও ছাইপাঁশ নয় , এগুলো লজেন্স , মামা দিয়েছে ’ __ টাকার কথাটা ও হজম করে গেল ।

‘চুপ , আর কত গুলো আছে ? বার কর সব ’ বাবা গর্জন করলেন ।

নিতান্তই অনিচ্ছার সাথে টিপু প্যাকেটের বাকি লজেন্স গুলো বার করে বাবার হাতে দিলো , এক টানে বাবা প্যাকেটটা বাগানের ঝোপের ভিতর ফেলে দিলেন । টিপুর  সকালের অর্ধেকটা সময় কেটে গেল সেগুলো খুঁজতে , পেল যখন , তখন __ লজেন্স আর বাগানের মাটি মিশে একটা নতুন গুলি তৈরি হয়ে গেছে ।

সেগুলোকে নিয়ে বাগানের পাঁচিলে সে উঠে বসলো ।

‘তুমি ওখানে কি করছ ?’ পাশের বাড়ীর মেয়ে বিন্নি ওপর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো ।

হঠাৎ বিন্নির মুখ আর কোঁকড়া চুল দেখে __ সিনেমায় দেখা সেই  সরল গ্রাম্য মেয়েটার কথা মনে পড়ে গেল টিপুর , আর নিজেকে একটা গ্রাম্য ছেলে ভাবতে শুরু করলো । কল্পনার আকাশে উড়তে ওর জুরী কেউ নেই ।

‘কেমন আছো বিন্নি’ গলার স্বর যতখানি সম্ভব গভীর আর ভরাট করা যায় ওর পক্ষে , সেই ভাবে বলল __ ‘তুমি নিশ্চয় আমাকে খুঁজছিলে যখন আমি ছিলাম না , তাই না ?’ টিপু বললো ।

‘তুমি ছিলেনা বুঝি ?’ ‘কিন্তু তুমি ওই রকম মজার গলায় কথা বলছ কেন ?’ বিন্নি বলে ওঠে ।

‘আমি মোটেও মজার গলায় কথা বলছি না ’ আরও গভীর ভাবে  টিপু বললো ।

‘তাহলে তোমার ঠাণ্ডা লেগেছে , মা তোমায় দেখেছে __ ‘ভোরে তুমি তোমাদের বাগানের চৌবাচ্চায়  লাফাচ্ছিলে ’, মা বলছিল _ ‘আমরা খুব শিগগিরই শুনবো টিপুর ঠাণ্ডা লেগে জ্বর হয়েছে আর বিছানায় শুয়ে আছে ’ ।

‘আমার মোটেও ঠাণ্ডা লাগেনি , আমি এই রকম করেই কথা বলি ’ রহস্যময় ভাবে টিপু বলে ।

‘তুমি কি খাচ্ছো ?’

‘লজেন্সের গুলি , নেবে ?’ প্যাকেটটা ওর হাতে দিয়ে টিপু বলে ওঠে ‘যতগুলো খুশি নাও তুমি ’ দরাজ হয়ে বলে সে ।

‘কিন্তু এগুলো তো নোংরা ’ ।

‘ও সব কিচ্ছু নয় , ওগুলো সাধারণ মাটি , চুযেই ফেলে দেওয়া যায় , কিন্তু লজেন্স গুলো দারুণ খেতে ’ । ‘আমি বলছিলাম’ আবার নিজেকে সেই গ্রাম্য প্রেমিক ছেলে ভাবতে শুরু করলো __ “ তুমি আমাকে খুঁজছিলে তাই না ?  আমি জানি আমি তোমার সম্পর্কে যতটা চিন্তা করি , তুমি আমার জন্য ততটা মোটেও করনা ” । টিপুর গলার স্বর গভীর থেকে গভীরতর হতে হতে শেষে একদম বন্ধ হয়ে গেল ।

‘টিপু , তোমার গলায় খুব ব্যাথা করছে তাই , তুমি ওই রকম করে কথা বলছ , তাই না ? ’ সহানুভূতির সঙ্গে তিন্নি বলল ।

‘একটু খানি’ গলায় হাত দিয়ে টিপু  অনিচ্ছার সাথে স্বীকার করলো   । ‘আমি এ সব নিয়ে বেশী কথা বলতে চাই না ’ পৌরু্য গলায় সে আবার বলে উঠলো ।

অবাক চোখে তিন্নি ওর দিকে চাইল __ ‘ টিপু , তোমার বুকে খুব ব্যাথা , তাই না ? আমার জ্যাঠাইমার ও এই রকম ব্যাথা হয়েছিলো , খালি কাশত আর কাশত ’ টিপু সঙ্গে সঙ্গে কাশতে লাগলো । ‘ আর কাশির সাথে জ্যাঠাইমার বুকে খুব  ব্যাথা করতো , তোমার অতটা কষ্ট হছে না তো ? ’ ।

বিন্নির অবাক ও বেদনাময় চাহনি তাকে ভাবুক করে দিল ‘হ্যাঁ , আমারও তাই হয়েছে মনে হয় , কিন্তু এটা নিয়ে আমি বেশি চিন্তা করছি না’ সে আবার কাশতে লাগলো ।

‘ডাক্তারবাবু কি বলল ?’

টিপু একটু ভেবে নিয়ে বলল __ ‘‘ডাক্তারবাবু বলল আমার ফুসফুস ঠিক আছে , আমাকে সর্বদা হাসিখুশি থাকতে বলল’ ।

‘টিপু তুমি আমার নতুন রং পেন্সিল গুলো নেবে ?’।

‘না , অসংখ্য ধন্যবাদ তোমায় ’।

‘আমার পুতুল গুলো ?’ ।

‘না __ ধন্যবাদ, আমার আর এই সবের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই , তুমি জানো না ,  ফুসফুসের রোগে কখন কি হয়ে যায় ।’

বিন্নির চোখে জল এসে গেল !

‘সেই জন্যই তো আমি সব সময় নিয়ম মেনে চলি ’ টিপু বলে ।

‘বিন্নি !’ বাড়ির ভিতর থেকে ডাক আসে ।

‘মা ডাকছে , আমি চললাম , বাবা আজ যদি চকোলেট নিয়ে আসে , আমি তোমাকে দেবো , কেমন ?’

‘ টা টা __ আমার চিন্তা বেশী করো না ।’

বাড়ির ভিতরে ঢুকতে গিয়ে টিপু দেখে __ তার কলেজ পড়ুয়া দিদি একজন তারই বয়সী ছেলের সাথে দরজার কাছে কথা বলছে ।

‘আমি জানি , তুমি আমার জন্য এটা করবে , আচ্ছা এখন আসি তবে’ বলে ছেলেটা চলে গেল __ দিদি কিছুক্ষণ ওর গমনপথের দিকে তাকিয়ে রইলো । তাই দেখে টিপুও আগ্রহী হয়ে ওঠে ।

‘ ওর নাম কুমার রায় , তাই না ?’ সে বলে ওঠে ।

মাথাটা নেড়ে ওর দিদি বাড়ির ভিতরে চলে গেল ।

একে অপরের প্রতি ওই চাহনি , ছোট্ট করে কথা বলা , তাদের ভাবভঙ্গি টিপুকে ব্যাকুল করে দিলো , তারা নিশ্চয় একে অপরকে ভালোবাসে ওই সিনেমাটার মত , কিন্তু হয়ত তারা নিজেরাও জানে না বা কারোকে বলতে পারছে না , সিনেমাটায় বোনের ভাই দুজনাকে এক সাথে মিলিয়ে দেয় , টিপুর মাথায় আলো খেলে গেল ।

‘জানো মা , এই রবিবারে কুমার রেবতীর বাবা মাকে ওদের বিয়ের প্রসঙ্গে কথা বলতে ওদের বাড়ি যাবে , আমি যেহেতু  রেবতীর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু , কুমার আমাকে ওর হয়ে রেবতীকে বলতে বলল , ভাবতো , কি আনন্দর খবর ! ’ বাড়ির ভিতরে ওর দিদি শিউলি মাকে বলতে থাকে ।

টিপু ততক্ষণে কুমারদের বাড়িতে পৌঁছে গেছে । টিপু বরাবরই সপ্রতিভ __ সোজা গিয়ে কুমারের মুখোমুখি ।

‘ আপনি বোধ হয় আমাকে চেনেন না , আমি  শিউলির ভাই হই’ ।

‘তাই নাকি ?’

‘হ্যাঁ , আমি তার কাছ থেকেই আসছি ’ বলে পকেট থেকে টিপু একে একে , তাদের বাগান থেকে নেওয়া ছোট্ট গোলাপের কুঁড়ি , একটা পেন্সিল , দুটো লজেন্সের গুলি আর একটা লাট্টু বার করে ।

‘সে এগুলো আপনার জন্য পাঠিয়েছে ’ টিপু বলে ।

উপহার সামগ্রী গুলো দেখে কুমার বাক্যহারা হয়ে যায় !

‘উম ! হ্যাঁ , শিউলিকে অশেষ ধন্যবাদ উপহার গুলোর জন্য । উমঃ__  কিছু বলেছে আমাকে ?’

‘হ্যাঁ , সে আপনাকে আমাদের বাড়ি সন্ধ্যে বেলায় যেতে বলেছে ’ ।

কুমার আশ্চর্য হয়ে লাট্টুর দিকে তাকিয়ে থাকে__ “ তুমি বলছ , এটাও সে পাঠিয়েছে ” ?

‘ হ্যাঁ ’ ।

‘আর কোনো কথা বলেনি ?’

‘না’

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর  টিপু বলে ___ ‘ দিদি আপনার কথা খুব চিন্তা করে’ ।

‘তাই ? ‘উম ! হ্যাঁ , তাকে অনেক ধন্যবাদ ’ ।

‘ঘুমের ভিতরেও দিদি আপনার নাম করে ’ টিপু মোলায়েম করে বলে । ‘আমি তার পাশের ঘরে শুয়ে শুয়ে শুনতে পাই  , সারা রাত আপনার নাম করে __ আমার কুমার , কুমার, কুমার , ।’ টিপুর গলার স্বর মোলায়েম থেকে মোলায়েমতর হয়ে ওঠে । “আমার কুমার , আমার কুমার , আমার কুমার , ” ।

বাক্যহারা হয়ে কুমার বসে থাকে __  ভীত হয়ে ওঠে তার মুখমণ্ডল !

‘তুমি ঠিক শুনেছ তো ?’ এক সময় বলে ওঠে সে __ ‘হয়তো শিউলি অন্য কারোর নাম বলে ’ !

‘না , শুধু আপনার নাম __কুমার , কুমার, কুমার__ আপনি বাড়ি থেকে চলে গেলে , জানলার ধারে দাঁড়িয়ে থাকে যতক্ষণ আপনাকে দেখতে পাওয়া যায়’ ।

‘কি ভয়ঙ্কর ’ ফিসফিস করে কুমার বলে ।

‘দিদির গলায় একটা ছোট্ট লকেট আছে , যার ভিতরে আপনার ছবি আছে __ সে খালি আপনার ছবিটা দেখে ।’

‘তুমি সঠিক জানো _ ওটা আমার ছবি ? ’

‘হ্যাঁ , আপনি কিন্তু সন্ধে বেলায় আসবেন ’ বলে টিপু চলে গেল ।

হতবাক হয়ে কুমার বসে থাকে !

টিপু বাড়ি আসতে আসতে চিন্তা করতে থাকে , হাসির সিনেমাটায় রং মিস্ত্রিগুলো  রাস্তায় পড়ে যাবার আগে অদ্ভুত একটা যন্ত্র দিয়ে পুরানো রঙগুলো গলিয়ে ফেলে ছুরি দিয়ে কি সুন্দর উঠিয়ে দিচ্ছিল , ফলে  কি তাড়াতাড়ি দেওয়ালে নতুন রং লাগাচ্ছিল ! ও আগে এরকম কোনো যন্ত্র দেখেনি , নিজের পকেট থেকে ওর ছোট্ট ছুরিটা বার করে ওদের বাড়ির ওপর তলায় উঠে গেল ।

তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে  ।

‘বাবা , তোমার মাথার ব্যাথা কমেছে ? ’ শিউলি বলে ।

‘বিন্দু মাত্র না’ ।

‘এখন কিছু খেয়ে নাও , ব্যাথা কমে যাবে’ শিউলি বলে ।

বাইরে থেকে খবর এলো __ কুমার এসেছে  __ শিউলির সাথে দেখা করতে চায় _ ও বাইরের ঘরে অপেক্ষা করছে । বাবার মাথার যন্ত্রনা আবার বেড়ে গেল ! ‘কি দরকার এই রাতে তোমার সাথে শুনি ? ভদ্রলোকের বাড়িতে রাত বিরেতে এসে কোনো মেয়ের সাথে দেখা করতে নেই , এই স্বাভাবিক ধারনা টুকুও নেই নাকি ?’ তিনি চিৎকার করে ওঠেন ।

শিউলি তাড়াতাড়ি বসার ঘরে আসে __ দেখে  কুমার বসে আছে ।

‘শিউলি কেমন আছো ?’

‘ভালো ___ তুমি  ?’

‘আমিও ’ কেউ বুঝতে পারে না কি বলবে __ দুজনাই অপ্রস্তুত ভাবে চুপ করে বসে থাকে । কুমার নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে __ শিউলি ঘড়ির দিকে !

‘আজ খুব গরম পড়েছে , তাই না ? ’

‘হ্যাঁ , বৃষ্টি না হলে গরম কমবে না ’ ।

‘বৃষ্টি হলে রাস্তায় জল জমে খুব খারাপ অবস্থা হয়ে দাঁড়ায় ’ ।

আবার সব চুপচাপ ।

খাবার ঘরে সবাই শিউলির জন্য অপেক্ষা করছে , মা বলে __ কুমারকেও আমাদের সাথে খেতে বলি না কেন ? ’ ‘একদম না , ব্যাটা রাত বিরেতে পরের বাড়িতে আসবে , একে আমি আমার জ্বালায় মরছি , আবার ওই হাঁদাকে খাবারে নিমন্ত্রণ  ’ বাবা রেগে বলে ওঠেন ।

সেই সময় ফোন বেজে ওঠে __ মা ফোন ধরতে চলে যায় ।  কিছুক্ষণ পর মা ফিরে আসেন __ উদভ্রান্ত হয়ে __ ‘ বিন্নির মা  ,__  বিন্নির শরীর খারাপ হয়েছে টিপু নাকি ওকে কি এক রকম লজেন্স দিয়েছিল সেটা খেয়ে __ আরও বলল __ টিপুর খবর শুনে ওর মা খুব কষ্ট পেয়েছে _ , টিপুর নাকি ফুসফুসে রোগ হয়েছে _ ডাক্তার ওকে নাকি সম্পূর্ণ বিশ্রাম নিতে বলেছে ! ’ । হতভম্ব হয়ে বাবা বলেন ‘মানে ? অ্যাঁ ? তুমি কি ___ ’ । ‘আমি কিচ্ছু জানি না ’ মা কাঁদোকাঁদো হয়ে বলে ওঠেন ।

‘ছেলেটা একদম পাগল হয়ে গেছে , এছাড়া আর কি বলার আছে আমার ’ বাবা বলেন ।

‘ভয়ঙ্কর ব্যাপার , কুমার বলল __ টিপু ওদের বাড়ি গিয়ে বলে এসেছে আমি নাকি ওর সাথে রাতে দেখা করতে চাই __ তাই সে এসেছিল __ আমার হয়ে ও অনেক উপহারও দিয়ে এসেছে __ এমনকি গোলাপ ফুল অবধি __ ও বলে এসেছে __ ওগুলো নাকি আমি দিয়েছি কুমারকে __ এদিকে টিপুর সাথে আজ আমার দেখা অবধি হয়নি ’ । এক নিশ্বাসে শিউলি বলে যায় । মা ওর কাছে এসে বসেন । বাবা প্রচণ্ড রেগে গিয়ে আস্তে আস্তে বলেন ‘কোথায় সে ?’ ।

‘কিছুক্ষণ আগে বাড়ি এলো __ আওয়াজ পেলাম ওপর ঘরে কিছু হয়তো করছে ’ মা বলেন ।

টিপু ওপরে আধ ঘণ্টা ধরে একটা দারুণ কাজ সম্পন্ন করেছে __ একটা ছোটো কুপিতে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ালের পুরনো রঙগুলোকে নরম করে __ ছুরি দিয়ে উঠিয়েছে __ সিঁড়ির অর্ধেকটা  রঙ ওঠানো হয়ে গেছে __ নিজের কাজে টিপু মহা খুশি ! বাবা আস্তে আস্তে ওপরে উঠে আসেন __

ঘণ্টা খানেক পরে টিপু মনমরা হয়ে বাগানে চুপ করে বসে গোটা দিনের ঘটনাগুলো চিন্তা করতে থাকে __ পাশের বাড়ির বিন্নির প্রতি তার মহানুভবতা _ বিন্নির শরীর খারাপ হয়ে দাঁড়ায় , কিন্তু সে তো তার ভালোই চেয়েছিল __ এক মাত্র দিদির , ভালোবাসার পাত্রকে সাহায্য করতে গিয়ে সেটা ভুল বোঝাবুঝিতে সমাপ্ত হয় __ আর সে যখন কত সুন্দর উপায়ে দেওয়াল থেকে পুরনো রং তোলার উপায় বার করলো __ প্রশংসা করার জায়গায় __ বাবার পিটুনি আর সবার বকুনি খেতে হল !

আচমকা ওর মনে হয় বাবা মনে হয় মদ্যপ __ সে চিন্তা করে সিনেমাটার মত সে হসপিটালে শুয়ে আছে আর তার বাবা নিজের কৃতকর্মের জন্য ওর কাছে ক্ষমা চাইছেন । টিপু ধীরে ধীরে   সব বুঝতে পারে ।

এদিকে ঘরের ভিতরে ___ বাবা মাথায় হাত বোলাতে  বোলাতে বলে ওঠেন ‘ ও একদম পাগল হয়ে গেছে __ কালই ওকে পাগলের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও _ সক্কালে আমাকে ধাক্কা দিয়ে বাগানে ফেলে দিলো কোনো কারন ছাড়া __ পাশের বাড়ির মিষ্টি মেয়েটাকে বিষাক্ত খাবার দিলো __ দিদির হয়ে এক অচেনা ছেলেকে প্রেম নিবেদন করে এল তাও আবার উপহার দিয়ে __ ঘরের রঙের দফা রফা করে দিলো __  আবার বলা হয়েছে __ সে নাকি ফুসফুসের রোগে ভয়ানক ভাবে অসুস্থ ।  তোমরাই বল পাগল না হলে এই রকম আচরণ কেউ করে ?’ ।

ঘর গোছাতে গোছাতে মা বলে ওঠেন __ ‘ দেখ _ বাচ্চারা এমনিতেই অনেক রকম কল্পনা করতে ভালোবাসে _ আমাদের টিপু না হয় একটু বেশি কল্পনাপ্রবণ , আদতে ও তো একটা ছোটো ছেলেই , তাই নয় কি  ?’ জানলা দিয়ে তিনি বলে ওঠেন ‘ টিপু অনেক রাত হয়েছে __ শুতে যা ’।

মনমরা টিপু ভিতরে আসে __ মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে ‘শুতে চললাম মা ’ তারপর বাবার দিকে

করুণ ভাবে চেয়ে বলে ‘ নিজের ভুল কাজের জন্য বেশি চিন্তা করো না বাবা । আমি তোমাকে ____ ’ তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়ে সে ।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
wpDiscuz
0
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x
Exit mobile version