Home Literature Stories নরকযন্ত্রণা।

নরকযন্ত্রণা।

0

কলকাতাস্থিত এক অত্যন্ত ধনী রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী , তবে খুব একটা সৎ মানুষ নন, একদিন হঠাৎ সকালবেলা ঘুমভেঙে দেখলেন তিনি একটি সুন্দর ঘরে এক দুগ্ধফেননিভ বিছানায় শুয়ে আছেন। ঘড়িতে তখন ছটার ঘণ্টা পড়ল। তিনি প্রথমে ভাবলেন  যে হয়ত তিনি গতরাত্রে ভারী অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়েছেন , তাই তাঁকে রাত্রে  রাজনৈতিক আনুকুল্যে বিশেষ বিমানেকরে এনে বিদেশের কোনো হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কিন্তু আবার মনে হল যে হাসপাতাল হলে অনেক যন্ত্রপাতি থাকবে , ডাক্তার,সেবিকা থাকবে কিন্তু সে সব কিছু নেই! এমন সময় দেখলেন যে একজন অপ্সরাসমা সুন্দরী ঘরে ঢুকলেন। ঝলমলেপোশাকে তিনি আরো রূপবতী হয়ে উঠেছেন। ঘরে ঢুকে তিনি বললেনমহাশয়, ঘুম ভেঙেছে! ভদ্রলোক বললেনহ্যাঁ,তা একটু আগেই ভেঙেছে। কিন্তু আমি কোথায় আছি! মহিলাটি কোনো কথা বললেন না, শুধু হাসলেন। তারপর বললেন, আপনিমুখ হাত ধুয়ে নিন আপনার কফি রেখে গেলাম। আর প্রাতরাশে কি খাবেন বলে দেবেনআমি একটু পরে এসে জেনে যাব।আর হ্যাঁ , আপনার কিন্তু কিছু করার নেই এমনকি পত্র পত্রিকা, গল্পের বইও পড়া যাবে না।ঘরের বাইরেও যাওয়া চলবে না।হুকুম নেই একমাত্র আমি দরজা খুলতে আর বন্ধ করতে পারি, আর কেউ নয়।আপনার দেখভালের দায়িত্ব কেবল আমারউপরেই আছে।আপনার আরাম কেদারা এবং বিছানার পাশে দুটি যন্ত্র বসানো আছে। সেগুলির যে কোনো একটিতে হাত দিলেইআমার কাছে সংকেত চলে যাবে। আমি চলে আসব। তবে বার বার যদি আমাকে বিরক্ত করেন তাহলে আপনার শাস্তি অনিবার্য।আর একটি কথা আপনার জানা দরকার। এখানে যখন তখন আপনি ঘুমাতে পারবেন না। ঘুমানোর সময় নির্দিষ্ট করা আছে রাত বারটা থেকে সকাল ছয়টা।অন্য সময় আপনার ঘুমই পাবে না। ব্যাপারে আপনি সম্পূর্ণরূপে আমাদের ইচ্ছার অধীন।

এই কথা বলে মহিলাটি চলে গেলেন। ভদ্রলোক অনেক মেয়ের সাথে মিশেছেন।ভাবলেন এই মহিলাটির মন জিততেই হবে।ওরহাত ধরে বাইরে যেতেই হবে,আর কিছু বইপত্র,পত্রিকা আনিয়ে নিতে হবে।

মুখ হাত ধুয়ে এসে ঘড়ি দেখলেনসবে ছটা পাঁচ। ভাবলেন বাবা এতক্ষণ সময় গেল আর সবে কিনা ছটা পাঁচ ! যাইহোক কফিতেচুমুক দিয়েছেন আর সেই মহিলা হাজির। তিনি জিজ্ঞাসা করলেনএবার কি খাবেন বলুন ! তবে এখানে আমিষ ভক্ষণ তথাসকল নেশার দ্রব্য নিষিদ্ধ। তাই আমি বলি কি আজ প্রাতরাশে লুচি, ছানার কোপ্তা আর ক্ষীর থাকুক। আর আপনি কি খাবারপছন্দ করেন সব আমার জানা আছে আমি আপনার খাদ্য তালিকা ঠিক করে দেব। ভদ্রলোক কিন্তু খুবই অধীর তিনি কোথায়আছেন জানার জন্য। তবে এবারও মহিলা শুধু হাসলেন। একটু পরেই প্রাতরাশও এসে গেল। মহিলাটিই নিয়ে এলেন আপনিধীরে সুস্থে খেয়ে নিন। সব খাবারই অনেক্ষণ গরম থাকবে”- এই কথা বলে তিনি চলে গেলেন। যাই হোক ভদ্রলোক দেরী না করেপ্রাতরাশটি খেয়েই নিলেন। ভাবলেন বা: বেশ খাওয়াদাওয়া হচ্ছে , দারুণ স্বাদ ,আবার খুব তাড়াতাড়ি হজমও হয়ে যাচ্ছে।তবে সবই নিরামিষ খাবার খেতে হবে জেনে মনটা একটু ক্ষুণ্নও হল বটে।আর একটু ভাল দামী মদ পেটে না পড়লে তাঁর আবার ঘুমই আসে না। দেখা যাক্, কি করে অপ্সরাকে বশে আনা যায়।

এবার আবার ঘড়ি দেখলেনসবে ছটা পনের। তিনি তাজ্জব বনে গেলেন। সময় এগুচ্ছেনাভারী অদ্ভুত ব্যাপার। কি আরকরা যাবে আবার সেই মহিলার আবির্ভাব। ভদ্রলোকের সেই একই প্রশ্নআচ্ছা এবার বলুন আমি কোথায় আছি ! আমারজানতে ভীষণ ইচ্ছা করছে। দয়া করে আমাকে বলুন।

মহিলাটি তখন উত্তর দিলেন  আপনি মারা গেছেন আর আপনার মৃত্যুর পরে আপনাকে শমন দেবের সমন অনুসারে এখানেনিয়ে আসা হয়েছে।

তা মারা যাবার পর মানুষ হয় স্বর্গে নয় নরকে যায়। তবে আমার যা পাপ তাতে নরকবাসই স্বাভাবিক।কিন্তু দেখেশুনে মনেহচ্ছে আমি স্বর্গে আছি।

মহিলাটি বললেন,মহাশয় সেটি ক্রমশ প্রকাশ্য। এই বলে একটু মুচকি হেসে তিনি চলে গেলেন আর ঘরের দরজাও নিজে থেকে বন্ধ হয়ে গেল।

এইবার আবার ঘড়ি দেখলেন। দেখলেন সবে ছটা আঠারো।তিনি চুপচাপ বসে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেনআরে সময় একদমই এগুচ্ছে না। কিন্তু এইভাবে চুপচাপ কি করে বসে থাকা যায় ! ভদ্রলোকের অসহ্য লাগল। তিনি অধৈর্য্যহয়ে উঠলেন। ধীরে ধীরে তাঁর কাছে সব পরিষ্কার হয়ে গেল। তখন তিনি অপ্সরাটিকে যন্ত্রের মাধ্যমে সংকেত পাঠালেন।সাথেসাথেই মনোরমা হাজির।

মহাশয়, আমাকে কি প্রয়োজন !”

দেখুন আমি কি নরকে এসেছি ! এখানে সময় এগুচ্ছে না। অথচ না আছে কিছু কাজ , না পারছি অন্যরকম ভাবে সময়কাটাতে। না পারছি বই পড়তে, আপনার সাথে একটু সময় কাটাব , কিন্তু আপনিও সে সুযোগ দিচ্ছেন না। আমি কি করি ! আমিএবার পাগল হয়ে যাব। আমি এখানে থাকতে পারব না।

মহিলাটি হেসে বললেন – “ মহাশয়, আপনি ঠিকই ধরেছেন। এটিই নরক।আপনার যতই এখানে আরামের ব্যবস্থা থাকুক নাকেন আপনি ক্রমশ:অস্থির হয়ে উঠবেন। তার দুটি কারণপ্রথমটি এখানে সময় চলে একেবারে শম্বুক গতিতে, আর দ্বিতীয়তআপনি পুরাপুরি কর্মহীন। আরও একটি বিষয়ও দিনেদিনে আপনার মনের কষ্ট বাড়িয়ে দেবে।

প্রতিদিন একই ধরণের নিরামিষ আহার আর কোনরূপ নেশার দ্রব্যের অমিল। সব মিলিয়ে এটিই হল নরক যন্ত্রণা। আর যেদিনআপনি এই পদ্ধতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবেন, সেদিনই আপনার এখান থেকে মুক্তি। তবে নরকের সময় অনুযায়ীসেটি কবে হবে বলা খুবই শক্ত। সবটাই আপনার উপর নির্ভর করছে।

এই কথা বলে মহিলাটি চলে গেলেন। ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে গেল।ভদ্রলোকের বাকরোধ হয়ে গেল।

সেদিন এক বয়স্ক মানুষের বাড়ি গিয়েছিলাম। বিশাল বাড়ি। কিন্তু তিনি একেবারে একা। তাঁর স্ত্রী আমেরিকার আছেন মেয়েরকাছে মেয়ের মেয়েকে সামলাচ্ছেন। মানুষটির দুটি হাঁটুতে ভয়ংকর যন্ত্রণা।

বাত আশু হাঁটু বদলের দরকার। চলৎশক্তিরহিত। কিন্তু স্বজন কেউ কাছে নেই,অত্যন্ত বেদনাদায়ক পরিস্থিতি। বই পড়তে ইচ্ছা করে না। ভাল রবীন্দ্র সংগীত গাইতেন। এখন গলা কেঁপে যায়।তাই গাইতে পারেন না। তাঁর কাছেই উপরের গল্পটি শুনলাম।তিনি তাঁর অবস্থাকে নরক যন্ত্রণার সংগে তুলনা করেছেন।

একাকীত্ব যে কি ভয়ংকর এবং সত্যই যে সেটি নরক বাস সম তা তাঁকে দেখলে,সেই একাকী মানুষটির  কথা শুনলেই বুঝতে পারাযায়।তাঁর মুখ থেকে শুনে নেওয়া গল্পটি পরিবর্ধন তথা পরিমার্জন করে উপরে পাঠকদের জন্য আমি লিপিবদ্ধ করলাম। 

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
wpDiscuz
0
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x
Exit mobile version