Home Life Social তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ

তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ

0

ধীরে ধীরে পৌষের আড়িমুড়িটা ভেঙে গেল,এখন চারদিনের ছুটি নিয়েছি আপিস থেকে, ম্যানেজারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, ভিতরটা ভূমিকম্পের মত ফাটতে লাগলো, রিখটার স্কেলটা ভেঙে গেল, আমি নিঃশ্বাসে হোঁচট খেয়ে বলে উঠলাম,” ইয়ে মানে ওই আরকি, চারদিন!”
উনি চশমার উপর দিয়ে আমার দিকে ক্ষুধার্ত ঈগলের মত তাকালেন, সে দৃষ্টিতে আমার সকালের মাছ ভাত মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসার জোগার, আমি চোখ নামিয়ে নিলাম, উনি গম্ভীর গলায় বললেন,” চারদিনটা যেন সাড়ে চারদিন না হয়!”
আমি মাথাটা রোবটের মত হেলিয়ে বেরিয়ে আসলাম, সেদিন থেকে না অনেক আগে থেকেই আমি জানতাম আমার ইহকালে আর সাহসী হয়ে ওঠা হবে না, আমার মনের ভুল যে আমি মনে মনে ভেবেছিলাম কোনো এক দিন, হোক না বসন্তের একদম শেষ প্রহরে, কিংবা হোক না বুড়ো ছাতিমের গুটিকয়েক শুভ্র নবজাতকের জন্ম দেওয়া শরতে আমার আর একটা অন্য জন্ম হবে আমার সেই কল্পনার প্যারাডাইসে, যা আমি বানিয়েছি নিজেই, সব ঝতু মিলে শুধু তোমারি জন্য! মেঘবালিকার সাদা রেশমের শাড়ি পরবে তুমি, চুলগুলো হবে সবে মাত্র ঘুমভাঙা ছোট্ট পাখির পালকের মত, আমি তোমার সামনে আসব, নতজানু হয়ে বসব , তোমার প্রিয় ল্যাভেন্ডার আর কারনেশনগুচ্ছ আমি তোমায় দেব সাজিয়ে , আর বলব,” প্রিয়তমা আমি তোমায়….”
সিইইইইইইইইইইইইইই…..
ট্রেনের সিগনাল আর সাথে স্টেশনের চা ওয়ালার বিদ্ঘুটে চিৎকারে আমার দিবাস্বপ্ন ভেঙে গেল, “আরে দাদা, চায়ের পয়সাটা দিন!”
আমি হকচকিয়ে উঠলাম, মাটির ভাঁড়টা ফেলে ওর পয়সা মিটিয়ে দিলাম, ট্রেনটা সবে ছাড়বে ছাড়বে, আমি উঠে পড়লাম, মা আর বাবা আগে থেকেই জিনিসপত্র গুছিয়ে বসে গল্প ফেঁদেছে বেশ, রাজীব গান্ধী, রাহুল গান্ধী, সুচিত্রা সেন আর এই ওই সেই…আমি বসেছি একপাশে চুপ হয়ে, ওদের কথা শুনছি না, শুধু চায়ের দোকানে সেই আমার শেষ না হওয়া দিবাস্বপ্ন টা ভাবছি, এ কেমন গন্ডগোলের, দিন নেই রাত নেই ,মানুষ নেই,আমি শুধু ভাবছি!
ঠিক সময়ে ট্রেন পৌঁছালো উত্তরবঙ্গে, আমরা মেজমাসির বাংলো বাড়িতে প্রথম এসেছি, আগে থেকে ঠিক করা গাড়ি এসে নিয়ে গেল, যাওয়ার পথে আমি কেবল হাঁ করে দেখলাম, কাঁচের ওপারে নীল আকাশের সাদা পাঞ্জাবিতে অর্ধেক ঢেকেছে পাহাড়ের চূড়া, কুচি কুচি বরফের শিফন সুতোর কাজ তাতে….চা বাগানের সবুজটা যেন শান্তি দিল একটা, আঁকা বাঁকা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আমরা বাংলো বাড়িতে আসলাম।
আমার আদর বেড়ে গেল, প্রথমত মাসির বাড়ি তাও এসেছি অনেক দিন পর আর দ্বিতীয়ত চাকরি হয়েছে নতুন, আমার এতো যত্ন দেখে নিজেই বুঝিনি আমার চাকরিটা অসময়ে এইভাবেও কাজে আসে, মাসির ছেলে উদিত , আমার থেকে দুবছরের ছোট আর মেয়ে রিনিতা , কলেজে পড়ে , ওদের সাথে দুদিনে বেশ ভাব জমে গেল, উদিত আর আমি দুপুরে খাওয়ার পর চাকরিবাকরি নিয়ে গল্প করছিলাম, রিনিতা কোথা থেকে জানি ঝোড়ো হাওয়ার মত ছুটে এলো, “এই দাদা চল না একটু ঘুরে আসি”
উদিত প্রথমে একটু না করছিল, তবে আমি হ্যাঁ বলাতে আমরা চললাম, তবে হেঁটে নয় , সাইকেলে!
উদিত প্রথমে বললো, “তুমি পারবে না, এই উঁচুতে সাইকেল চালিয়ে আবার কি বিপদ ডেকে বসবে,”
আমি বললাম,” না না ভাই, কিচ্ছু হবে না, চল না”
অনেক ক্ষণ এমন হ্যাঁ-না চলার পর বিকেলের দিকে আমরা বেরিয়ে পড়লাম , তিনজন তিনটে সাইকেল নিয়ে, উদিত আর রিনিতা সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে আমার আগে আগে, আমার ও কষ্ট হচ্ছে না, খালি একটু জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছি, আমরা ওদের পুরোনো স্কুল , ভৈরব মাতার মন্দির , এসব দেখে সন্ধ্যের মুখে ফিরছি, সাইকেলটা এবার জোরে চলছে, আমি সারা বিকেলে যা দেখলাম, সেগুলোর কিছু মোবাইলের ক্যামেরায় আর কিছু চোখে করে নিয়ে আসছি, চারিদিকটার কেমন ঘুম পেয়েছে, হঠাৎ উল্টোদিক থেকে একটা সাইকেল হঠাৎ ছুটে এলো, আমি ব্যালেন্স রাখতে পেরে পড়ে গেলাম রাস্তায়, আর ওদিকের আরোহী ও আমার হাতের উপর পড়ে গেল, দুটো সাইকেল একে অন্যের উপর পড়ে চাকায় চাকায় আটকে গেছে, অন্য আরোহীটি আমার হাতের উপর পড়ে যাওয়ায় হাতে লেগেছে বেশ, আমি চোখ খুলে তাকিয়েছি সবে, উল্টোদিকে দেখলাম দুটো টানা টানা চোখ,কালো কাজলে আঁকা, লম্বা খোলা চুল অজান্তেই এসে পড়েছে কিছুটা ওর কপালে আর আমার কাঁধের উপর, গোলাপি ঠোঁট দুটো অনাবিল আড়ষ্টতায় মৃদু কাঁপছে, ফর্সা সরু হাতদুটো একটি আমার ডান কাঁধের উপর আর একটি বাঁহাতে, চোখদুটো বিম্ষয়কর স্থিরতায় আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমিও যেন চোখ সরাতে পারছি না, সূর্যের শেষ আলোটা ওর চুলের উপর পড়েছে একপাশ থেকে, রংটা অন্য হয়ে গেছে ঠিক ওর চোখের মণির মত, যেখানে আমি নিজেকে দেখতে পাচ্ছি আয়নার মত, চারপাশের পরিবেশ টা ঠিক কোন্ ঋতুতে বেঁচে আছে বুঝলাম না, আমার সমস্তটা যেন কোনো অজানা তুষারপাতে ঢেকে যাচ্ছে, আমি শুধু তাকিয়ে আছি!
একটু পর উদিত আর রিনিতা এসে আমাদের তুললো, আমরা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে তখন ও, ইতঃস্ততভাবে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার লাগেনি তো?”
মেয়েটি এবার ও অবাক বিষ্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, বুঝলাম ওর ভাষাতে ভিন্ন, জিজ্ঞেস করলাম,”আপ কো কাহি চোট তো নেহি লাগি না?”
মেয়েটি মৃদু স্বরে বলল,”নেহি !”
সূর্য ডুবে গেল ওই দূর পাহাড়ের ভাঁজে, আমরা ফিরে এলাম, আমি কেমন যেন চুপ হয়ে গেলাম, উদিত আর রিনিতা আমার সাইকেলের কাঁচা হাত নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে চলেছে, কিন্তু আমি কান দিইনি, আমার মন আমার বাধ্য নয়, তাই সেই চোখদুটোয় হারিয়ে গেলাম, এত সুন্দর প্রশান্তি এতকালের কোনোদিনও তো হয়নি! আমি বুঝলাম না আমার মধ্যেকার ঠিক কোন্ গভীরতায় ওই চোখের সৌন্দর্য গেঁথে গেছে!
পরেরদিন ভোরে ট্রেনে চেপেছি, বিদায় পর্ব সেরেছি কোনোমতে, উদিত রিনিতা , মাসি আমার জন্য কিসব খাবার প্যাক করে দিয়েছে, আমি তাও দেখিনি, শুধু মাথা নাড়লাম, ট্রেনটা হুইসেল দিয়ে ছেড়ে যাচ্ছে, কালো ধোঁয়া টা যেন বিষাদে মিশে যাচ্ছে সাদা আকাশে, দূরে ওরা হাত নেড়ে বলছে গুড বাই, আমার মন কালো হয়ে যাচ্ছে, বুঝতে পারছি না কেন এত কান্না ভেতরে, স্টেশন ছাড়লে জানলা দিয়ে ভোরের আকাশটাকে দেখলাম, আবার সেই চোখ দুটো , আমার দিকে তাকিয়ে আছে বিষ্ময়ে, আমার ঋতু, কাল, ক্যালেন্ডার ,তারিখ সব মিলিয়ে গেছে অনাদির শেষ ক্রুর নিঃশ্বাসে, কি সর্বনাশের ডাক ওই হুইসেলে মিশে আছে কে জানে, কোন্ অজানা অপরাধের প্রতিশোধ নিতে ট্রেনটা আমায় নিয়ে চলেছে দূরে আরো দূরে… হাওয়ার পালক আমার ঘুম নির্ঘুমে এসে বলে যাচ্ছে, “তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ”

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
wpDiscuz
0
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x
Exit mobile version