Home Literature Stories ইরোটোম্যানিক

ইরোটোম্যানিক

0
ইরোটোম্যানিক

চমকে উঠলো বীথি।মনে হল ফোনের মধ্যে দিয়ে একটা জলন্ত আগুনের গোলা যেন প্রবেশ করল তার বুকের মাঝখানে। নিস্তেজ লাগছে শরীর। গলায় যেন একটা ধারালো ছুরি বিঁধিয়ে দিয়েছে কেউ। তীব্র রিন্‌রিনে তার যন্ত্রণা| দম বন্ধ হয়ে আসছে বীথির, কথা বলতে পারছেনা সে। কয়েক সেকেন্ড কাটলো এভাবে। সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে দীপ এখনো বলে চলেছে ‘জীজী ক্যান য়ু হীয়ার মি? হ্যালো, আর য়ু দেয়ার? সে সামথিং ইয়ার… হ্যালো, আই সেইড…… আই জাষ্ট সেইড, ড্যাট উই হ্যাড ইট… য়ু নো হোয়াট আই মিন্ রাইট? উই গট ইনটিমেট, ফিজিকালি। হ্যালো, জীজী……’

হঠাৎ সম্বিৎ ফিরল বীথির। সে প্রাণহীন নিস্তেজ গলায় বলল ‘হুম শুনেছি… নেটওয়ার্ক প্রবলেম করছিল একটু, কিন্তু এখন সব পরিষ্কার।’ কথা খুঁজে পাচ্ছেনা সে, তবু কিছু তো বলতেই হবে। কোনক্রমে তুত্‌লে তুত্‌লে বলল বীথি, ‘য়ু বোথ্‌ হ্যাড ইট্‌ দেন শি জাষ্ট কান্ট মুভ এ্যওয়ে ফ্রম য়ু অল অফ আ সাডেন্‌…… এ্যটলিষ্ট মেন্‌টালি…… গেটিং ইন্টিমেট ফিজিকালি সিগ্‌নিফাইজ দ্যাট হাউ ডীপলি শি ল্‌ভড য়ু।’ দীপ প্রতিবাদ করে উঠল, ‘নো জীজী, শি হ্যাড ইট উইথ হার এক্স ইভেন, ইট্‌স নাথিং নিউ টু হার। বাট আই লষ্ট মাই ভার্জিনিটি উইথ হার। আই গেভ হার এভ্‌রিথিং অফ মাইন এন্ড শি টুক এ্যওয়ে অল এক্সেপ্ট মি ওনলি।’ দীপ বলেই চলল ‘জীজী তুমি বলো মেল ভার্জিনির কন্সেপ্ট হয় না। তবু আমার কাছে এর অনেক মূল্য আছে, আমি তো নদীর সব পাস্ট মেনে নিয়ে নিজের সব কিছু দিয়ে ওকে ভালোবেসেছিলাম। আর দেখো আজ আমি কোথায় এসে দাঁড়িয়েছি!’

বীথি চুপ করে শুধু শুনছে, কিছু বলার ক্ষমতা নেই তার। বুঝতে পারছে সে, নিজের অন্তর দিয়ে অনুভব করতে পারছে দীপ-এর অন্তরযাতনা। কিন্তু সান্তনা দেওয়ার ভাষা সে হারিয়ে ফেলেছে। কাকে দেবে সান্তনা? আর কি বলেই বা দেবে? সে নিজেই তো এই মূহুর্তে নিজের করুণাপ্রার্থি। কি বলে বঝাবে সে কথা দীপ-কে? শুধু দীপ কেন হয়তো সমাজের কেউই মেনে নেবে না সে কথা জানলে পরে। মনে হচ্ছে সে যেন আজ সব হারালো, নিঃস্ব হয়ে গেল একেবারে। কি করে বোঝাবে দীপ-কে ভার্জিনিটির কন্সেপ্ট তার নিজের কাছে কতটা গভীর! ওপরে যাই বলুক না কেন নিজের মনের কথা তো জানে বীথি, সেই মনকে কি করে ফাঁকি দেবে সে? কি ভাবে পালাবে সে নিজের কাছ থেকে? সমস্ত শরীর-মন যেন জ্বলে-পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে তার। ডুকরে কেঁদে উঠতে ইচ্ছা করছে, অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে গলার কাছটায়। কিন্তু চোখ তার শুক্‌নো খট্‌খটে। ঠিক তেমনি শুক্‌নো খট্‌খটে গলায় বলল বীথি, ‘কষ্ট পাস না… দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। অনেকক্ষণ কথা বললাম রে, রাত হয়েছে, এবার তুই একটু ঘুমোতে চেষ্টা কর; বেটার ফিল করবি… টেক কেয়ার, গুডনাইট।’

বীথি পঁচিশ উত্তীর্ণা এক যুবতি, একটি বেসরকারি স্কুলে চাক্‌রিরতা। আর দীপ বছর কুড়ির এক যুবক ছাত্র, সদ্য ল পড়তে ঢুকেছে। দীপ-এর সাথে বীথির পরিচয় এই স্কুলেই। বছর দুই আগে সদ্য এম.এ. পাস করেই স্কুলের চাকরিটা পায় বীথি, তখন দীপ ক্লাস ইলেভেনের ছাত্র। সেই দিনগুলোতে কত অন্যরকম ছিল বীথি; বা বলা যায় তখন সে নিজেকে ঢেকে রাখত এক কঠীন গাম্ভীর্যের মোড়কে। সদ্য মা-হারা বীথি জীবনের নানা তিক্ত অভীজ্ঞতার প্রভাবে কাউকে বিশ্বাস করতে পারতোনা, আর না সে কাউকে নিজের কাছে আসতে দিতে চাইতো। সমাজের চোখে কঠোর-কঠীন বীথি নিজে জানতো কত কোমল ক্ষনভঙ্গুর তার হৃদয়। তাই নিজের মনের সকল দ্বার রুদ্ধ করে নিজের মধ্যে আতস্থ হয়ে থাকার লড়াই চালিয়ে যেত সে প্রতিনিয়ত; নিজেকে ঢেকে রাখতো এক ক্রোধ-মিশ্রিত গাম্ভীর্যের আবরণে, যাতে তার কঠীন ব্যক্তিত্ব ভেদ করে কেউ অন্তরে লুকিয়ে থাকা আসল বীথিকে ছুঁয়ে না ফেলে। জীবনে নেমে আসা একের পর এক মৃত্যুর আকস্মিকতা, একের পর এক হারাতে থাকা প্রিয়জন, ও আরও অনেক ঘটে যাওয়া আনুসঙ্গীক ঘটনা এক ধাক্কায় অনেক পরিনত করে তুলেছিল তাকে মানসিকভাবে। নিজের জীবনের এই অমোঘ সত্য, এই সম্পর্কহীনতা, এই একাকিত্ব স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিয়েছিল সেদিন বীথি। মেনে নিয়েছিল যে তার আর কেউ নেই; মা, বাবা, ঠাম্মা, ছোটকাকু যেই সম্পর্কগুলো ঘিরে ছিল তাকে, এত বছর, সবাই চলে গেছে একে একে। মৃত্যু এসে অসময়ে কেড়ে নিয়ে গেছে তার পরিবারকে- এটাই বাস্তব। এমনকি মা মারা যাবার শেষ মুহুর্তে বারবার ডেকেও কাছে পায়নি কেশব-কে।

কেশব, বীথি বাগদত্তা ছিল তার। অনেক বেশি কিছু আশা করে ফেলেছিল, অনেক বেশি কিছু চেয়ে ফেলেছিল হয়তো বীথি তার থেকে। আর এত বেশি চাওয়া না-পাওয়া হতে হতে এক গভীর অভীমানে পরিনত হয়েছিল। কয়েক মাস আগে সেই সব চাওয়া-পাওয়া, মান-অভীমানের খেলায় ইতি টেনেছে বীথি। সে মুক্ত করে দিয়েছে কেশব-কে সকল দায়ীত্ব-কর্তব্যের বন্ধন থেকে, মুক্তি দিয়েছে নিজেকেও সকল শর্তময় সম্পর্কের বাহুপাশ থেকে।

সম্পর্কটায় ভাঙন ধরতে শুরু করে অনেকদিনই, তবু কোনক্রমে একরকম জোড়াতালি দিয়ে চলছিল, খানিকটা সামাজিক ব্যবহারের সাথে তাল রেখে। হয়তো এইভাবে টিকেও থাকতো, এবং একদিন আর পাঁচটা সাধারণ সম্পর্কের মতো এর-ও সামাজিকভাবে সফল পরিনতি ঘটত বিয়েতে। হয়তো আর পাঁচটা সাধারণ দম্পতির মতো নিজেদের মধ্যে আপোস করে, জীবনের সাথে সমঝোতা করেই দিব্যি কেটে যেত বীথি আর কেশবের দিনগুলো। হয়তো এমনই কিছু ঘটত, যদি না বীথির সাথে হঠাৎ পরিচয় হত দীপ-এর।

দীপ-এর সাথে দেখা হওয়ার প্রথম দিকের দিনগুলো আজও স্পষ্ট মনে পড়ে বীথির। ভাবতে বসলে খুব মজা লাগে। কত বকুনিই না খেয়েছে দীপ, রাগি-গম্ভীর বীথি ম্যাডামের থেকে। কেন যে দীপ প্রথম থেকেই এত কাছে আসতে চেষ্টা করত বীথির, আজও ঠিক বুঝতে পারেনা সে। শুধুই খামখেয়ালীপনা, না কমবয়সী টিচারের সাথে ফ্লার্ট করার মজা, না অন্য কোনকিছুর হাতছানি…?- আজ আর সত্যিই জানতে চায় না বীথি। সে শুধু জানে যে সে একদিন সেচ্ছায় ধরা দিয়েছিল দীপ-এর কাছে; কিন্তু দীপ কোনদিন তার ব্যক্তিগত সুযোগ নেয়নি। আর সেই জন্যেই বয়েসে ছোট এই ছেলেটিকে মনে মনে অনেক শ্রদ্ধা করে সে।

আজও মনে পড়ে সেই দিনটার কথা; এক কলীগ্‌ কাম বান্ধবীর হাত ধরে ফেসবুকে প্রবেশ, নিছকই সময় কাটানোর তাগিদে। কিছু কিছু স্টুন্ডেটের ফ্রেন্ড রিকোয়েষ্টও একসেপ্ট করেছে বীথি, নিজেও পাঠিয়েছে কয়েকজনকে। এই সময়েই তার একটা ফটোতে মজা করে কমেন্ট করে দীপ, তাও ইনবক্সে, পাবলিক্‌লি নয়। সেই সময় কেশবের সাথে বেশ ঝামেলা চলছিল বীথির। মন-মেজাজ ভালো ছিলনা এমনিই, তার ওপর সামান্য এক ছাত্রের এই অহেতুক মজা মেনে নিতে পারেনা সে, হঠাৎ মাথা গরম হয়ে যায় খুব। চ্যাট বক্সেই বেশ দু-কথা শুনিয়ে দেয় সে দীপকে, সাথে প্রচুর টিচারসুলভ জ্ঞানও ঝারে। সেই সময়ের মতো থেমে যায় ব্যাপারটা। কিন্তু পরদিন সকালে স্কুলে গিয়ে একটু অবাকই হয় বীথি।

সেদিন স্কুলে গিয়ে বীথি দেখে দীপ তার জন্য আগে থেকেই অপেক্ষা করছে টিচার্স রুমের বাইরে। সে আলাদা করে বীথির সাথে একবার কথা বলতে চায়, সাথে সরি-ও বলে তাকে। দীপ-এর কথা ও ব্যবহারের মার্জিত অনুশাসন ভারি ভালো লাগে বীথির। বেশ কিছুক্ষণ এমনিই কথা বলে তারা দাঁড়িয়ে। সেই শুরু, তারপর রেগুলার ফেসবুক আর ওয়াট্‌স-অ্যাপে কথা হতে থাকে দুজনের। বীথির একাকিত্বের মুহুর্তগুলো ভরিয়ে রাখত দীপ; কত মজা, কত হাসি-ঠাট্টা, এমনকি নন-ভেজ জোক্‌স অব্দি শেয়ার করেছে তারা। সম্পর্কটা আর টিচার-স্টুডেন্টের সীমায় আবদ্ধ থাকেনা, পরিনত হয় গভীর বন্ধুত্বে। দুই অসমবয়সী নারী-পুরুষের বন্ধুত্ব।

আস্তে আস্তে নিজের জীবনের সব কিছু, সব দঃখ-কষ্ট দীপ-এর কাছে উন্মোচন করতে থাকে বীথি। দীপ-ও বলতে থাকে তার জীবনের কথা, পরিবারের কথা। যত দিন যায় ক্রমেই আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে দুজনে। প্রথম প্রথম বীথি দীপ-কে তার ভাই বলত, দীপ-ও তাকে দিদি কাম বন্ধু হিসেবেই নিয়েছিল। সেই থেকেই দীপ তাকে জীজী ডাকতে শুরু করে। দীপ মজা করে বলেছিল, ‘য়ু আর মাই জীজী, নট ইন হিন্দি বাট ইন চাইনিজ’। চাইনিজ ভাষায় নাকি জীজী শব্দের অর্থ বন্ধুর মতো বড় বোন; এ তথ্য দীপ-ই দিয়েছিল তাকে।

বেশ কাটছিল সময়। ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হতে হতে বীথি নিজেও বোঝেনি কখন তার সব কিছু দিয়ে ভালোবেসে ফেলেছে সে দীপকে, বা বলা যায় নিজের অজান্তেই সে প্রেমে পড়েছে দীপ-এর। কিন্তু এই ভালোবাসা, দীপকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাওয়া, এই প্রেমজ অনুভূতি, সবই তো তার একার; সম্পূর্ণ একতর্‌ফা। দীপ-এর জীবনে যে আছে অন্য কেউ।

নদী, সে দীপ-এর সমবয়সী; সুন্দরি-প্রাণোচ্ছল এক তরুণী। আর দীপ-ও খুব একাগ্র এই সম্পর্কে। এই অবস্থায় কোনমতেই নিজের ভালোবাসা জানানোর কোন যুক্তি নেই। উপরন্তু বীথি একটু ভয়ই পায়, যদি দীপ তার মনের কথা জানলে তার থেকে দূরে সরে যায়! কি করে বাঁচবে বীথি? দীপ-এর সঙ্গে এই নির্মল সম্পর্কটুকু ছাড়া যে তার জীবনে আর কিছুই নেই!!

তাই তো সে অপেক্ষা করে থাকে প্রতি মাসের ছ-তারিখের জন্য। দীপ স্কুল ছাড়ার সময়ে বীথি-ই এই ডিল্‌ করেছিল যে প্রত্যেক মাসের ছ-তারিখে সে ফোন করবে দীপকে। সেদিন সারা মাসে তাদের জীবনে যা যা ঘটেছে, খারাপ-ভালো-মজার সকল ঘটনা শেয়ার করবে দুজনে; আর খুব প্রয়োজন না হলে দুজনেই চেষ্টা করবে মাসের অন্য দিনগুলোতে একে অপরের সাথে যোগাযোগ না করতে। দীপ ভারি মজা পেয়েছিল এরম শর্তে। তারপর থেকে পুরো সাত মাস অতিক্রান্ত হয়েছে, শর্ত অনুযায়ী বীথি অপেক্ষায় থাকে মাসের ছ-তারিখের।

বীথির হাজার ইচ্ছা হলেও সে নিজেকে সংযত রাখে। দীপ খুব ভালোবাসে নদীকে; সেই সব ভালোবাসার কথা, একান্ত গোপন আদরের কথা মাঝে মাঝে বলে সে বীথির কাছে। অসহ্য কষ্ট হলেও বাহ্যিক ব্যবহারে বীথি নিজেকে সংযত রাখে, কারণ সে যাকে ভালোবেসেও কাছে পেতে পারবেনা সেই মানুষটার জীবনের অপর এইটুকু ঘনিষ্ঠতার অধিকার থেকে সে বঞ্চিত হতে চায় না। দীপ তাকে নিজের জীবনের যেটুকু সময় আর অধিকার দেয় এর চেয়ে বেশি পাওয়ার আশা বীথি সত্যিই রাখেনা।

দীপকে সত্যিই ভালোবেসেছে বীথি। আর এই ভালোবাসা হয়তো স্বাভাবিক নয়, কারণ তার ভালোবাসা প্রতিদান চায় না, রাখে না কোন দাবী। এমনকি যাকে মন এত কাছে পেতে চায়, তার থেকেও নিজেকে আড়াল করে দূরে সরিয়ে রাখতে পিছয়না তার প্রেম। প্রেমাস্পদের কাছ থেকে সযত্নে লুকিয়ে রাখে সে এই অনুভূতি যাতে বীথির ভালোবাসার আহ্বানে বিহ্বল-বিব্রত না হয়ে পড়ে দীপ।

অথচ এত লুকোচুরি যেই মানুষটার কাছ থেকে, তাকে ভালোবেসে বীথি নিজে হয়ে উঠেছে এক সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। আর এখানেই তার ভালোবাসা কিছুটা হলেও অস্বাভাবিক। যেদিন থেকে সে বুঝেছে যে নিজের অজান্তেই নিজের সবটুকু দিয়ে ফেলেছে সে দীপকে, ঠিক সেই মূহুর্ত থেকে দূরে সরে গেছে কেশব। সেই সময় বীথির প্রথম মনে হয়েছিল কেশবের সাথে তার এতবছরের সম্পর্ক, এতবার শারীরিক ভাবে ঘনিষ্ঠ হওয়া সত্বেও আজও সে ভার্জিন তার কারণ হয়তো ছিল দীপ-এর সাথে অসময়ে পরিচয়ের এই ভবিতব্য। মনে মনে সে সত্যিই চেয়েছিল যেন সে তার ভার্জিনিটি হারায় দীপ-এর কাছেই; তারপর যদি তাকে কেশব বা অন্য কারও সাথে বিয়ে করে সারা জীবন কাটাতেও হয় কোন ক্ষোভ থাকবেনা তার মনে। শুধুমাত্র দীপ-এর সাথে ক্ষণিক মিলনের সুখ-স্মৃতি অবলম্বন করে দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারবে সে বাকি জীবনটা। বা হয়তো শুধু একবারের জন্য দীপ-এর ভালোবাসা পাওয়ার স্পর্শ সুখের রেশ সঙ্গে রেখে একাই অতিবাহিত করবে জীবন। কোন দাবী রাখবেনা সে দীপ-এর ওপর, কখনোও জোর করবেনা দীপকে, আর সত্যিই কোন দাবী তো তার নেইও। এমনকি দীপকে মনে মনে কাছে পাওয়ার স্পর্ধাও তো সে দেখাতে পারেনা, সে অধিকার তো দেয়নি তাকে দীপ, আর দেওয়া উচিৎও নয় হয়তো। তবু যৌবনের সকল আশা-আকাক্ষা যে দীপকেই সমর্পন করতে চায় মন। নিজের সবকিছু দিয়ে শুধুমাত্র একবারের জন্য হলেও দীপকেই কাছে পেতে চায় বীথি।

অন্তরের এই তীব্র আকাক্ষা মনে মনে ভারি লজ্জা দেয় তাকে, আবার বেশ একটা ভালোলাগাও কাজ করে তার মধ্যে। যেন সব কিছুর আড়ালে, মনের কোন নিভৃত কোনায় সে আজ রীতিমত সংসার করছে দীপ-এর সঙ্গে, যেন ‘লিভ্‌-ইন রিলেশ্‌ন’। তার এই স্বপ্নময় কাল্পনিক সম্পর্কের বোধ যত গভীর হয়েছে দীপ-এর সাথে ততই সে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে কেশবের সাথে বাহ্যিক সামাজিকতার বাস্তবময় সম্পর্ক থেকে।

আর আজ দীপ তাকে এটা কি বলল…?? এখনো যেন কেমন ঘোরের মধ্যেই আছে বীথি। সে কি ঠিক শুনেছে? সে যে ভাবতেই পারেনা, তার দীপ, শুধুমাত্র তার দীপ অন্য কারও সাথে এক বিছানায়! কিন্তু প্রকৃতিক নিয়মে সেটাই তো স্বাভাবিক যে দুটি তরুণ-তরুণী একে অপরের ভালোবাসায় এতটাই ডুবে যাবে যে সেখানে মুখের ভাষা হারিয়ে জেগে উঠবে শুধু শরীর।

বীথি তো কোনদিন কোন দাবী রাখেনি দীপ-এর কাছে, আজও রাখেনা; তাহলে আজ কেন সে দীপ আর নদীর শারীরিক ঘনিষ্ঠতা নিয়ে এত বিচলিত হয়ে পরছে? কেন এত কষ্ট হচ্ছে তার? কেন সে ফোন ধরে রেখে কথা বলতে পারলো না? কেন সে নদীর সাথে সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ার এই কষ্টের মূহুর্তে দীপকে সান্তনা দিতে পারলো না?? কেন???

হঠাৎ ঘোর কেটে যায় বীথির। কি বোকামি করছে সে? কেন মিছিমিছি কষ্ট পাচ্ছে? যেই দীপ-এর হাত ধরে কেশবের সাথে ‘ক্লীশে’ হয়ে যাওয়া এত বছরের সম্পর্ক ছেড়ে বেড়িয়ে এসেছে সে, যেই দীপ-এর জন্য সামাজিক রীতি-নিয়মের তোয়াক্কা করে না সে, আর যেই দীপ নদীর জন্যে ফোনে কাঁদছিল এতক্ষণ, তারা দুজনে তো এক নয়। যেই দীপ-এর সাথে সে একটু আগে ফোনে কথা বলছিল সে তো শুধুই তার স্টুডেন্ট, সে তো নদীর দীপ। আর তার দীপ? সে তো তার পাশেই বসে আছে। তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে, আল্‌তো করে বীথির হাতের ওপর নিজের হাত ছুঁয়ে রেখেছে। এতক্ষণ খেয়ালই করেনি সে এই ছোঁয়া! কি যে হয়েছে বীথির আজকাল!?

দীপ-এর চোখে চোখ পরতেই নরম গলায় কথা বলে উঠল সে, ঠিক যেমনটা বলেছিল একবার স্কুলে থাকতে, যখন বিথি কি একটা কাজে যেন তাকে ফোন করেছিল আর গলা ভারী শুনে ফোন ধরেই দীপ বলে উঠেছিল- ‘কি হয়েছে? কাঁদছো কেন?’ বীথি হেসে বলেছিল, ‘ধুর পাগল! কাঁদবো কেন? সর্দি লেগেছে বড্ড।’

‘এই কাঁদছো কেন? দীপ আর নদীর কথা ভেবে কষ্ট হচ্ছে? আমি তো আছিই তোমার সাথে, দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। একবার ফোন করে নাও দীপকে, দেখো বেটার ফিল্‌ করবে তুমি’।

হ্যাঁ তার দীপ-ই তো; তার গা ঘেঁষে বসে, হাতটা আল্‌তো করে ধরে তার চোখে চোখ রেখে নরম গলায় এ্যডভাইজ দিচ্ছে তাকে, যেমন সবসময় দিয়ে থাকে। তার দীপ তো তার পাশেই আছে, কোথাও যায়নি তাকে ছেড়ে, কোনদিন যাবেওনা। সে যে বোঝে বীথির মনের কথা, মুখ ফুটে বলতেও হয়না বীথিকে। একবার অনেক কান্নাকাটির পর চোখ-মুখ ধুয়ে, মন ভালো করার জন্য একটু হালকা সেজে, একটা ‘সেল্‌ফি’ তুলে ওয়াট্‌স-অ্যাপে প্রোফাইল পিকচার রেখেছিল বীথি। দীপ মজা করে বলেছিল, ‘আপকে ডিপি পে দিল আ গ্যয়া মিস্‌। পার ক্যায়া হুয়ি, আপ ইত্‌না রোয়ে কিঁউ?’ কিন্তু কই কেশব তো কিছু বোঝেনি, বরং সে ভারি অপচ্ছন্দ করেছিল ছবিটা। এই অপচ্ছন্দ নিয়ে একটা ঝামেলা বাঁধিয়ে ব্যাপারটা এমন পর্যায় নিয়ে যায় কেশব যে বীথি ছবি পাল্টাতে বাধ্য হয়। এই ঝামেলার রেশ ধরে আর একপ্রস্থ কান্নাকাটি যা সামলাতে হয় সেই দীপকেই।

দীপ-এর কিন্তু কোনদিন অসুবিধা হয়নি বীথি আর কেশবের সম্পর্ক নিয়ে। তার শুধু খারাপ লাগতো বীথি এত কষ্ট পেত বলে। বীথির একাকিত্ব নিজের ভালোবাসা দিয়ে ঢেকে দিতে চেয়েছিল দীপ, তাইতো স্কুল ছাড়ার পর থেকে সে এখন বীথির সাথেই থাকে। এখানে থেকেই পড়াশুনা করে সে। দীপ পারিবারিক বা অন্য কোন সম্পর্কের পিছুটান রাখেনি, কারণ তাদের এই অসমবয়সী ঘনিষ্ঠতা ‘লিভ্‌-ইন’ কেউই স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়নি বলে। এত কম বয়সে বীথির জন্য এই সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে দীপ, বীথিও তাই নির্দ্ধিধায় কেশবের সাথে সমস্ত সামাজিক বন্ধন ছিন্ন করে বেরিয়ে আসতে পেরেছে দীপ-এর ভালোবাসার টানে। কোন প্রতিশ্রুতি না দিয়েও দীপ যে তাকে অনেক কিছু অনুভব করিয়েছে, যা সে কেশবের সাথে এতবছরের সম্পর্কেও কোনদিন পায়নি।

দীপকে ভালোবেসে বীথি পেয়েছে নিজের জীবনের প্রতি নিজের অধিকার, পেয়েছে ভালোবাসার স্বাধিনতা। দীপ বীথিকে সাহায্য করেছে নিজেকে নতুন করে খুঁজে পেতে। বীথির নির্জন কাঠিন্যের আবরণ সরিয়ে ফিরিয়ে এনেছে তার স্বতঃস্ফুর্ততা। তাই দীপ-এর সাথে এই নতুন জীবনে, তাদের এই নিভৃত সংসারে আনন্দে আছে বীথি। দীপ-এর সাথে মজা করতে, ইয়ার্কির ছলে তার পেছনে লাগতে দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়না বীথিকে। বীথির না বলা কথাও দীপ ঠিক বুঝে নেয়। দীপ-এর মধ্যে বীথি যেন খুঁজে পেয়েছে তার আত্মার আত্মীয়কে, তাইতো তার সামনে খসে গেছে বীথির সকল নির্মোক। তাদের এই নির্মল সম্পর্ক সমাজের আর কেউ বুঝবেনা, তাই অনেক যত্নে লুকিয়ে রেখেছে বীথি, এমনকি নদীর দীপ-এর কাছ থেকেও আড়াল করে রেখেছে সে তার দীপকে। আর সেই জন্যেই নদীর দীপ-এর জন্য বরাদ্দ শুধু মাসের একটা দিনের কিছু মিনিট, কি বড় জোর কয়েক ঘন্টা। বাকি সময়টুকু যে সে দিয়েছে তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা দীপকে।

দীপকে পাশে পেয়ে এখন মনটা অনেক হাল্‌কা লাগছে বীথির। সে এবার নিশ্চিন্তে ফোনটা হাতে তুলে নিল। ফোন করল নদীর দীপকে। দীপ কাঁদছে, এখনো ঘুমোয়নি সে। বীথি আল্‌গা ধমকের সুরে বলে, ‘কি শুরু করেছিস তুই? এত রাত হল, এভাবে পড়ে পড়ে কাঁদছিস, এরপর তো শরীর খারাপ করবে। এই করলে পড়াশুনা হয়ে গেল তোর! কাল কলেজ যেতে পারবি এভাবে? একটা মেয়ের জন্য এমনি করছিস, আর জীবনের বাকি সম্পর্কগুলোর কথা ভাবছিস না? ওঠ, চোখে-মুখে জলের ঝাপ্‌টা দে, কিছুক্ষণ আমার সাথে কথা বল নিয়ে ঘুমোতে চেষ্টা কর। যত নর্মাল থাকবি দেখবি আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে গেছে। এ্যন্ড ট্রাস্ট মি য়ু ডিসার্ভ সামওয়ান বেটার দ্যান হার।’

দীপ এবার প্রতিবাদ করে ওঠে, ‘ওহ্‌ প্লিজ জীজী, নাও ডোন্ট গিভ্‌ মি দ্যাট ক্র্যাপ। আমিও তোমায় সেম বলেছিলাম, আফটার ইওর ব্রেক-আপ উইথ কেশব। বাট টিল্‌ নাও য়ু হ্যাভেন্ট বিন্‌ এব্‌ল টু মুভ-অন ইয়েট, য়ু আর স্টিল সিঙ্গেল। এবার তুমিই বলো, এত সহজ মুভ-অন করা?’

ভারি মজা লাগে বীথির কথাগুলো শুনে, দীপ যে জানেই না বীথি অনেক আগেই মুভ-অন করে গেছে দীপকে নিয়েই। সে মুচকি হেসে বলে, ‘দীপ য়ু নো হোয়াট? আই এ্যাম হ্যাপি ফ্রম উইদিন, দ্যাটস্‌ হোয়াই আই নো আই হ্যাভ মুভ্‌ড অন। এ্যন্ড আই ওয়ানা বি দিস হ্যাপি অলওয়েজ। ইট্‌স জাষ্ট আ ম্যাটার অফ পারসেপশ্‌ন। টু মুভ-অন য়ু নিড টু কিপ ইওর মাইন্ড ওপেন। যদি কেউ মনের সকল বন্ধ দরজা এক ধাক্কায় খুলে দিয়ে অন্তরে প্রবেশ করে যায়, তাকে আসতে দিতে হয়; আটকাতে নেই, মন পেতে রাখতে হয়। সারা দিতে হয় হঠাৎ আসা ভালোবাসার ডাকে। তারপর যা হওয়ার দেখবি নিজে থেকেই হয়ে গেছে। আর আমার ব্যাপারে আমি বলতে পারি যে আমি মন পেতে রেখেছি, তাইতো দেখ বেশ ভালো আছি। তোকেও তাই বলছি কিপ ইওর মাইন্ড ওপেন, লেট ল্‌ভ টাচ ইওর সোল’। কথাগুলো বলতে বলতে পাশে বসে থাকা দীপ-এর বুকে মাথা রাখে বীথি।

দীপ এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল বীথির কথা। এবার সে বলে উঠল, ‘আই ল্‌ভ য়ু জীজী। তোমার মতো করে আমায় কেউ বোঝেনা আর বোঝাতেও পারেনা। ওন্‌লি য়ু হ্যাভ সিন মি ইন মাই ওয়ার্স্ট, য়ু হ্যাভ সিন মি ক্রাইং এ্যাজ ওয়েল উইটনেস্‌ড মাই আগ্রেস্‌ন। ইট্‌স ওন্‌লি য়ু হু ক্যান হোল্ড মাই ইমোশ্‌নস সো ওয়েল; এ্যন্ড আই নো দ্যাট সেম গোওজ ফর য়ু। য়ু টু হ্যাভ টু এ্যগ্রি দ্যাট ইট্‌স মি ওন্‌লি হু ক্যান গিভ য়ু শোল্ডার হোয়েন য়ু নিড ইট দা মোস্ট। উই বোথ কমপ্লিমেন্ট ইচ্‌ আদার, ডোন্ট য়ু থিংক সো?’ বীথি হাল্কা হেসে বলল, ‘তা তো বটেই। এবার যা একটু ঘুমিয়ে নে, দেখিস আবার মন খারাপ করিসনা কিন্তু’। দীপ-ও এবার হাল্কা মেজাজেই বলল, ‘ওকে জীজী, ল্‌ভ য়ু… গুডনাইট’।

ফোনটা রেখে পাশে থাকা দীপ-এর বুক থেকে মুখ তুলে তার দিকে তাকালো বীথি। দেখলো এখনো সেই নরম মিষ্টি হাসি লেগে আছে তার চোখে-ঠোঁটে। বীথির ঠোঁটেও খেলে গেল এক অনাবিল স্মিত হাসি। চোখ দুটো চিক্‌চিক্‌ করে উঠল ভালোবাসায়। দীপ আল্‌তো চুমু এঁকে দিল বীথির কপালে। এর মানে দীপ এবার তাকে নিয়ে যাবে ঘুমের দেশে, দীপকে জড়িয়ে এখন নিশ্চিন্তে ঘুমোবে বীথি।

অনেক শান্ত লাগছে এখন মন। বীথি তো সত্যিই বলেছে, যা সে উপলবদ্ধি করেছে নিজের অন্তরে। সে তো সত্যিই মন পেতে রেখেছে হঠাৎ আসা ভালোবাসার ডাকে সারা দিতে। যেমন একদিন দীপ এক ধাক্কায় সকল আগল ভেঙ্গে জায়গা করে নিয়েছিল তার মনে, যদি তেমনি কেউ আবার আসে, ঠিক একই ভাবে ভালোবেসে সেই ভালোবাসাকে পরিপূর্ণতা দিতে চায় নিশ্চই সারা দেবে বীথি। আর তখন দীপ-ও খুশি হয়েই তুলে দেবে বীথিকে সেই মানুষটার হাতে; তবু তাকে ছেড়ে দীপ চলে যাবেনা চিরদিনের মতো, সবসময় থাকবে তার পাশে, বীথিকে ঘিরে রাখবে দীপ-এর ভালোবাসা। দীপ যে শুধুই ভালোবেসেছে; কামনা করেনি, সম্মান করেছে, নিজেকে নিয়ে সুখি হতে শিখিয়েছে। আর তাই বীথিও কামনা করেনা নদীর দীপকে, এমনকি যৌবনের তাড়নাতেও না। সে খুশি তার নিজের দীপকে নিয়ে, আর সে এভাবেই সুখি থাকতে চায় চিরকাল।

সমাজ হয়তো বলতে পারে এই সুখ-অনুভূতি বাস্তবিক নয়, নিছকই কাল্পনিক জগতে বিচরণ, উৎকট পাগলামো। কিন্তু বীথি জানে এ তার স্বপ্নের সম্পর্ক; বন্ধনহীন প্রেমের স্পর্শ; অন্তরঙ্গতার অনন্য উপলবদ্ধি, যা তাকে অনুভব করিয়েছে তার বহু আকাক্ষিত মুক্তির স্বাদ। মুক্তিতে বন্ধন, বন্ধনে মুক্তি… বীথির কাছে সেটাই যে আল্‌টিমেট এসেন্স অফ সোল্‌মেটশিপ!!

 

~ ইরোটোম্যানিক ~

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
wpDiscuz
0
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x
Exit mobile version