Home Literature Stories অস্ফুট

অস্ফুট

0
অস্ফুট

[১]

জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি। বেলা পশ্চিমে তখনও ছুঁই ছুঁই। ধলেশ্বরীর তীর ঘেষা গোপিনাথপুরের অন্তিম আকাশে কিছুক্ষণ আগেও ঝলমল করা  বিকালের সোনালি আভাটা কিছু ধূসর মেঘের আনাগোনায় ঠিক বোধহয়  নিজেকে আর  মেলে ধরতে পারছেনা। বাড়ির এদিক ওদিক ছড়িয়ে থাকা হাঁসমুরগিগুলো  তাড়িয়ে তাদের বাসায় তুলে দিয়ে পশ্চিমের ছনের রান্নাঘরে খড়কুটো জ্বালিয়ে কেবল রান্না বসিয়েছে এক মধ্যবয়সী তরুণী, জবা। অল্প সময়ের মধ্যেই ধূসর মেঘের আধিপত্যে খানিকটা আগেই বোধহয় সন্ধ্যা নেমে আসল ধলেশ্বরীর তীরে। অদূরে নদীতে ফুসে উঠা স্রোতের গর্জনে সায় দিয়ে ডোবার পাশের ঝাউগাছগুলোর প্রচণ্ড দোদুল্যমানতা ঠাণ্ডা হাওয়ায় নীরব প্রকৃতিটাকে আরেকটু যেন গম্ভীর করে দিয়ে গেল। হঠাৎই জবাদের থাকার ঘর থেকে মধ্যবয়সী এক যুবক বের হলো। পরনে কমলা ছাপের লুঙ্গি আর ময়লা স্যান্ডো গেঞ্জি,  হাতে ছোটখাট পুরাতনমতো একটা সাদাকালো টিভি। একই সাথে বের হলো কালোর মধ্যে লাল ছোপের ফিতাওয়ালা ফ্রক পরা সাত-আট বছর বয়সী এক মেয়ে। দুচোখ ডলতে ডলতে সে রান্নাঘরের দিকে আসতে থাকল। বাচ্চাটার দিকে একবার তাকিয়ে দমকা বাতাসের শব্দ ভেদ করে টিভি হাতে যুবকটিকে উদ্দেশ্য করে জবা বলল,

“বইসা যান সামাদ ভাই; তুফান কমলে বাইর হইয়েন।”

শুনে সামাদ নামের লোকটা একটু থামল। অনেকক্ষণ জবার দিকে তাকিয়ে থেকে , লাল দাঁতগুলা বের করে বিকৃতভাবে হেসে বলল,

“এহন না গেলে, তুফান শুরু অইলে আর যাইতে পারুম না, ভাবি। যাই আমি। পরে আবার আসমু।” বলেই হাঁটা শুরু করল। জবা ইতস্তত হয়ে নিজের কাপড় ঠিক করল। বাচ্চা মেয়েটা রান্নাঘরের কাছেই এসে থামল। লম্বা হাই তুলে সে খানিকটা আড়মোড়া ভেঙ্গে নিল। জবা ইশারায় তাকে কাছে আসতে বলল। মাটির চুলায় ধোঁয়া উঠা সিলভারের হাড়ির ঢাকনা সরিয়ে আঙুল দিয়ে ভাত ফুটা দেখতে দেখতে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটাকে বলল,

“বাইর হইছ কেন্,আম্মা? ঘরে গিয়া জানলাগুলা লাগাইয়া বুবুর কাসে যাও, আমি আইতাসি।”

মেয়েটা না নড়ে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,

“মা, অই বেডা আমার টিবি লইয়া কই যাইতাসে?“

সাথে সাথে কাছেই কোথাও একটা বাজ পড়ে চারদিক অন্ধকার করে তুমুল বৃষ্টি শুরু হল। পিছল মাটির সিঁড়ি পেরিয়ে মেয়েটা ভয়ে দৌড়ে রান্নাঘরে ঢুকে মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়াল।  জবা ভাতের মাড় ফেলতে ফেলতে বলল,

“নিয়া যাক। ঘরে কারেন্ট নাই টিবি দিয়া কি হইব।“

মেয়েটা চোখ মুছে মায়ের আঁচল ধরে বলল- “কারেন্ট খুইলা নিল কেন্, মা? আন্ধাইরে যে আমার ডর লাগে।”

কোন উত্তর না করে ভাত নামিয়ে চুলা নিভিয়ে চালের ছেড়া সাদা বস্তা দিয়ে ঢেকে কোণায় ইট দিয়ে দেয় জবা । হাড়ি হাতে বৃষ্টির মধ্যেই ঘরের দিকে রওনা দেয়। মায়ের আঁচল মাথায় দিয়ে ছোট্ট মেয়েটাও চলে পিছুপিছু। তার নাম শানু- ছোটকাল থেকেই ভারি জেদি। সামনের দুইটা দাঁত পড়ে গেলেও কথায় কথায় মানুষের হাত-পা কামড়াতে খুব একটা সমস্যা তার হয়না। গত শুক্রবারেই তো- কারেন্ট বিক্রি করে দেয়ার পর সকাল সকাল বাড়িতে এসে কয়েকজন ফ্যান-তার-লাইট খুলে নিতে গেলে দুইজনকে ভয়ঙ্করভাবে কামড়ে দিয়েছে সে। সেদিনই দুইজনকে টিটেনাস ইনজেকশন নিতে হয়েছে। দেখতে আবার সে পুরোটাই বাবার মতোই হয়েছে। বাবা ছুটিতে বাড়ি আসলেই যেন প্রচণ্ড শক্ত কোন এক অধিকারবলে সে বাবাকে সারাক্ষণ তার করে রাখে। বাবাকে সে ভয়ঙ্কর ভালোবাসে।

[২]

পরদিন সকাল থেকেই নদীর পাড়ের বড় কদম গাছটার নিচে পা ছড়িয়ে বসে আছে শানু। এবার বর্ষার শুরুতেই বড় বড় কদম ফুলে ঝেঁকে গেছে গাছটা। আর তার লম্বা শেকড় ঘেষে বয়ে চলছে শান্ত ধলেশ্বরী। সারাক্ষণ নৌকা-স্টিমারের কোলাহলে মুখর ধলেশ্বরী আজ কয়েকমাস ধরেই বেশ নিশ্চুপ হয়ে গেছে। জেলেদের কয়েকটা পাল তোলা নৌকা ছাড়া তেমন কিছুই আর চোখে পড়ে না নদীতে। নদীপাড়ে শক্ত মুখে বসে ঝরে পড়া কদম ছুড়ে একটু পরপর  শিকার ধরতে আসা মাছরাঙাকে বিরক্ত করছে শানু। সেগুলো একেবারে চলেও যাচ্ছেনা। ঘুরেফিরে আবার একই জায়গায় বসছে মাছের আশায়।

খানিকবাদে এক প্রৌঢ়াকে দেখা যায় লাঠিতে ভর দিয়ে  পেছন থেকে শানুকে ডাকতে। তার নাম জয়নব বেগম, শানুর দাদি। বয়সটা বেশি হলে পঞ্চাশের ঘরে হবে। এই বয়সে লাঠি নিয়ে হাঁটলেও সবার ধারণা তার পা দুটো সৃষ্টিকর্তা বিশেষ যত্ন নিয়ে বানিয়েছেন। পুরো গ্রামে তার চোখের সামনে ঘটে না এমন ঘটনা বিরল। আজকাল তাকে খুব বিমর্ষ দেখায়। কি একটা ভাইরাস যেন এসেছে দেশে। আপাতত  তাই তার পাড়া ভ্রমণ সাময়িক নিষিদ্ধ করে দিয়েছে জবা। এটা শুনে কেউ যদি ভেবে থাকেন যে জয়নব বেগম পুত্রবধূ ভক্ত শাশুড়ি- তবে ভুলই হবে।  অপারগ হয়ে জবা নিজের স্বামীকে  দিয়ে  জয়নব বেগমকে বলানোর পরেই তাকে গৃহবন্দী করা গেছে। তিনি কদম গাছতলা থেকে একটু উঁচুতে ভাঙ্গা কলাগাছগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে ডাক দিলেন,

“শানু, অই সেরি , খাড়া রইদের মদ্দে এহানে বইয়া আসস ক্যা? কহন থেইকা তরে ডাকতাসি।”

শানু উত্তর না দিয়ে বামহাতে জমানো ফুল থেকে আরেকটা ফুল নদীতে ছুঁড়ল।

“দেহ দেহি কি জিদ্দাল ছেমড়ি।” বলে তিনি আস্তে আস্তে এগিয়ে শানুর কাছে এসে কঞ্চিবাঁশের বাদামি লাঠিটা পাশে রেখে বসলেন। শানু অন্যদিক মুখ করে ঢিল ছুড়তে থাকল।

“মুখুশটাও তো পিন্দা আহস নাই, দিনকাল যে ”

শানু ঘাড় না ঘুরিয়েই বলল, “তুমিও তো পিন্দ নাই।

“আমি বুড়া মানুষ। আইজ মল্লে কাইল দুইদিন। এইগুলা আমারে ধরব না। আর এই কতাডাই  তো তর মারে আমি বুজাইতেই পারিনা।”

শানু এবারও কোন উত্তর দিল না।

“বাড়ি চল বুবু, বিহান থেইকা তো খাস নাই কিছু।”

শানু কিছু না বলে পাশ ফিরে দাদিকে জড়িয়ে হঠাৎ হুড়মুড় করে কাঁদতে লাগল। জয়নব বেগম আবাক হয়ে তার মাথায় হাত দিয়ে বলল,

“আরে দেহ দেহি, কান্তাসস ক্যান? কি জ্বালা। অই শানু?”

শানুর কান্নার বেগ বারে।

“বাপজানের কথা মনে পড়ে? ”

“বাপজান কি আর আইবনা বুবু?”

জয়নব বেগম সামনে তাকিয়ে লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,

“আইব বুবু, আইব। নামাজে বইয়া আল্লাহর কাসে কত কই আমার পুতটা য্যান ভালায় ভালায় ফিইরা আহে।”

জয়নব বেগমের চোখ বেয়ে পানি পড়ে। শানু দাদির চোখ মুছে দেয়। দাদির কোলে মাথা রেখে দূরে চরের কাছে হলুদ পালতোলা একটা নৌকায় পলক হারায় সে। মাথার উপর দিয়ে কয়েকটা কালো কাক কা কা করতে করতে উড়ে যায়।

[৩]

জবা বাড়ি ফিরে সন্ধার আগে আগে। তাকে দেখে শানু দৌড়ে কাছে যেতে নিলেই সে বাঁধা দেয়। বাইরে থেকে শুকনো কলাপাতা ঘেরা টিউবওয়েলে সময় নিয়ে গোসল সেরে কাপড় কেঁচে গামছা মাথায় পেচিয়ে ঘরে ঢুকে জবা। শানুকে কোলে নিয়ে গালমুখ চুমোয় ভরিয়ে ফেলে।

“সারাদিন না খাইয়া একলা একলা গাঙপাড়ে গেসিলা ক্যান?”

শানু উত্তর না দিয়ে মাকে জাপটে ধরে থাকে। আজান পড়লে নামাজ সেরে কুপি হাতে রান্নাঘরের দিকে যেতে নিলে জয়নব বেগম জায়নামাজ থেকে বলেন,

“রানবার যাও নাকি বউ?”

“রাইতে খাওন লাগব না, আম্মা?”

“চাইল ছাড়া তো নাই ঘরে কিছু, কি রানবা?”

“আফনের হইলদা ডেরহিডা  ডিম পাড়ে নাই আইজ?”

“দেখলাম নাতো পাড়তে, কুচ খালি।”

শানু অবসন্ন দেহে এগিয়ে শাশুড়ির ঘরে ঢুকে তার পাশে বসে। জয়নব বেগম তসবী টানতে টানতে বলেন,

“শানু ঘুমাইসে?”

একটু আগেও তো ভাত চাইতাসিল। জবা শানুকে নাম ধরে ডাকে। একটু পর শানু চোখ মুছতে মুছতে ঢুকে।

“বুবুর বিসনায় একটু হুতো মা। আমি ভাত আনতাসি।”

শানু কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে পাশের চৌকিতে উপুর হয়ে শুয়ে পড়ে।

“কাশেমের পোলা হুনলো কতা?”

“না, হেগো কাউরেই বুজাইতে পারলামনা আম্মা। বিশ্যুদবারের আগে হেগো টেকা না দিলে বাড়িভিটাডাও যাইব। এই সময়ে হেগর আতেও তো টেকাপয়সা নাই।”

“জামালের লগে আর কতা অইসে?  মুবাইলডাও ব্যাচা লাগল। পুতের মুকখান্ দেহিনা কতদিন।”

“আজকে বাইরে থাইকা কল দিসিলাম। শানুরে দেকবার চায় খালি। হের শরিলডা আম্মা ভালানা।”

জয়নব বেগম আতঙ্কিত স্বরে বলল,

“কি অইসে আমার জামালের?”

“এক সপ্তা ধইরা জ্বর। দুই মাস ধইরা তো কোন কাম নাই। কি খায় না খায় মরুবূমির মদ্দে। হেয় আজকে কানসেও ফুন ধইরা। হে দ্যাশে চইলা আইবার চায়, আম্মা।” কথা জড়িয়ে আসে জবার।

“দুইডা বসর দইরা আমার পুতটা বিদেশ পইড়া আসে। রইদে রইদে কাম কইরা চোকগুলান পাগারে গেসেগা।”

“বাড়িভিটাডা বাচামু কেম্নে আম্মা?”

জয়নব বেগব নীরুত্তর অশ্রুপাত করেন। জবা রান্নাঘরে গিয়ে শুকনা পাতা দিয়ে আগুন ধরায়। ততক্ষণে চারদিকে ঠাণ্ডা বাতাস শুরু হয়েছে। জবা কিছু চাল ভাজে। চুলা নিভিয়ে কালো কড়াইটা নিয়ে ভেতরে আসতেই বাইরে থেকে ডাক আসল।

“ভাবি ভিত্রে আছেন নাকি? ও ভাবি।“

জবা দরজা থেকে খানিকটা সামনে বের হয়ে দেখে কোণায় কাঁঠালগাছটার হেলান দিয়ে বিড়ি টানছে সামাদ।

“কেডা অইখানে?”

সামাদ বিড়িতে লম্বা টান দিয়ে ফেলে পা দিয়ে মাড়িয়ে দুই হাত ঝেরে সামনে আগাতে আগাতে বলল,

“খোঁজখবর নিতে আইলাম ভাবি। ভাই তো আর বাড়িত নাই।” বলেই লাল দাঁতগুলো বের করে হাসতে লাগল সামাদ।

“তা ভাবি চাল ভাজলেন ক্যান? আমারে কইতেন বাজার কইরা আনতাম।”

সামনে আগাতে আগাতে বলল,

“এত পর ভাবেন ক্যান, ভাবি?”

জবা ভয়ে ভয়ে পিছাচ্ছে । হঠাৎ জয়নব বেগম ঘর থেকে হুংকার করে উঠেন,

“কেডা রে আমার বাড়িত? কেডা অইখানে?”

সামাদ জবার সারা শরীরে বিশ্রীভাবে চোখ বুলিয়ে বলল,

“বুড়িডা দেহি ঘুমায় নাই এহনও। আইজ তাইলে যাই ভাবি। পরে আবার আসমু।”

হাত নাড়িয়ে খুব বাজে একটা ইঙ্গিত করে অস্রাব্য একটা গান গুনগুন করতে  করতে বেরিয়ে যায় সে। জবা কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে ঘরে ঢুকে দরজা লাগায়।

জয়নব বেগম বলেন,

“তুমি বাইর অইলা ক্যান? লুচ্চাডারে কি করতাসি দেহ। রাইতটা পুয়াইবার দেও খালি। অইদিনও গঞ্জে সবাই এত মাইর মাল্ল- লাজ শরম কিসুই নাই বদমাইশটার।”

জবা কাঁদতে কাঁদতে কড়াই থেকে চালভাজা বেড়ে শাশুড়িকে দেয়। যে কয়টা দাঁত মুখে আছে তা দিয়েই আস্তে আস্তে চালভাজা চিবাতে লাগলেন জয়নব বেগম।

শানু না খেয়েই ঘুমিয়েছে। জেগে থাকলেও যে খেত, তাও না। তার গায়ে প্রচণ্ড জ্বর। জবা তাকে কোলে নিয়ে বসে আছে। বাইরে তুমুল ঝড়। মাথার উপরে পুরনো টিনের চালটা বিকট শব্দে একটু পর পর ঝাপটা বাতাসে উড়ে যেতে চাইছে। থেকে থেকে বাজের শব্দে কেঁপে উঠে চোখ বন্ধ করে প্রলাপ করছে শানু,

“মা, আমার বাপজান কই ? অই তো আমার বাপজান। লাল শাট পিন্দা আসে। আমার লাইগা পটেটু আনসে।”

কাকতালীয়ভাবে, আড়াই হাজার মাইল দূরে কাতারের মাসায়েদ মরুভুমির ছোট্ট কাঠের কুটিরের বাইরেও ঝুম বৃষ্টি। তিনতলা স্টিলের বিছানার উপরের তলায় অন্ধকারে শুয়ে আছে জালাল। দুই বছর ধরে এই একই ঘরে থাকে সে। সঙ্গী হিসেবে নিজের দেশী কাউকে না পেলেও দুইজন বিদেশীর সাথে দিন ভালোই কেটে যাচ্ছিল তার। একজন ভারতের ঝাড়খণ্ডের, আরেকজনের বাড়ি নেপাল। সাতদিন যাবত এই জ্বরের পর থেকে করোনা সন্দেহে কেউই তার কাছে ঘেঁষে না। দুজন মিলে আরেকটা ঘরে থাকে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় জালালের কাঁপুনি বাড়ে। নেমে গিয়ে কম্বলটা নেয়ার শক্তিও সে করে উঠতে পারেনা। এ কয়দিন এক মুহূর্তও ঘুম হয়নি তার।  টাকা না পাঠালে  দেশে জবা-শানু-মা ওরা কিভাবে চলবে, ঋণের টাকা- এসব ভাবতে ভাবতে  জ্বরের ঘোরে একা একা চিৎকার করে একটা বাচ্চার মতো কেঁদেছে সে। এখন অনেকটাই বোধশক্তিহীন। মৃত্যুর আগে মানুষ বুঝতে পারে। জালালও পারছে। শেষ সময়টাতে শানুকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে। হঠাৎ হালকা তন্দ্রায় ঘোরে সে একটা স্বপ্ন দেখল- একটা উঁচু দেয়ালের ওপাশে শানু সাদা ফ্রক পরে লম্বা বেণী দুটো দুলিয়ে খিলখিল করে হাসছে আর আরেকপাশে চিপস হাতে লাল শার্ট পরে হাত বাড়িয়ে আছে জামাল। দেয়াল ভেদ করে একে অন্যকে দেখতে পারার ব্যাপারটা জামালের স্বাভাবিকই লাগছে।

“বাপজান, আমি তোমার কাছে আসবার পারতাসিনা ক্যান?”

“দৌড় দেও আম্মা, এইত আমি। তুমার লাইগ্যা পটেটু আনসি।”

“বাপজান, লাল শাটে তুমারে নায়কের লাহান লাগতাসে।”

বলেই খিলখিল করে হেসে উল্টা ঘুরে দৌড়ে চলে শানু।

গোপিনাথপুরের জ্বরে কাতর শানুর পাতলা ঠোঁট জোড়াতেও চিলতে হাসি। জবা তার পাশে বসে কপালে জলপট্টি দিয়ে যাচ্ছে। বাইরে ঝড়ের সাথে সমানতালে বাড়ছে শানুর জ্বর। জয়নব বেগম কিছুক্ষণ জেগে থেকে আপাতত নাক ডাকছেন। পাশে বসে থেকে তখন জবার চোখটা একটু লেগে এসেছে। কিছু না বলে শানু হঠাৎ বিছানা ছেড়ে উঠে বিপুল মালপত্রের বহর থেকে কিছু একটা বের করে নিয়ে আবার শুয়ে পড়ে। জবা সজাগ পেয়ে তার কাঁথা তুলে দেখে বাবার সাথে তার ছোটবেলার একটা ছবি জড়িয়ে শুয়ে আছে শানু। এই ছবিটাই অনেকদিন ধরেই খুঁজছিল জবা। শানু শুয়েই বলতে শুরু করে,

“মা, বাপজান কি মেলা দূরে থাহে? আমি যদি মইরা যাই, আল্লা কি আমারে বাপজানের কাসে লইয়া যাইব?” বলেই ছবিটা আরো জোরে জাপটে ধরে বুকে। জবার দুচোখ বেয়েও জল ঝরে অবিরাম। জংধরা টিনের চালের ছিদ্রপথে অঝোরে পানি পড়তে থাকে ঘরের ভেতর। জয়নব বেগব ঘুম থেকে উঠে সুরা-কালাম পড়তে পড়তে বিলাপ করতে থাকেন। জবা নিজের উপর একটা কাঁথা দিয়ে উপুর হয়ে বসে। শানু বৃষ্টির জলে না ভিজলেও, ভিজে যায় জবার চোখের পানিতে। চাল বেয়ে পানি জবার উপর পড়তেই থাকে। একসময় বৃষ্টির জলে মিশে জবার চোখের জল অদৃশ্য হয়। দমকা হাওয়ায় নিবু নিবু বাতিটাও দপ্ করে নিভে যায় হঠাৎ। বিদঘুটে অন্ধকারে শানুকে ভালবাসার শুষ্কতায় জড়িয়ে অস্ফুট আর্তনাদে রাতভর জবা নীরবে অপেক্ষার প্রহর গুনে একটি স্বপ্নময়ী ডাকের-

“বউ, ও বউ… জবা, দরডা গুসা। আমি জালাল।”

________

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
wpDiscuz
0
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x
Exit mobile version