।নয়।

শনিবার সৌগত যে ফ্ল্যাটটার সামনে এসে দাঁড়াল সেটা একটা তিনতলার ফ্ল্যাট, লন্ডনের নাইটস ব্রীজ এলাকায়। সম্ভ্রান্ত এলাকায় সাজান গোছান একটা মাল্টি স্টোরি … তার তিন তলার একটা ফ্ল্যাটে এসে সৌগত বেল টিপলো। একটু পরেই মোনালিসা নিজেই এসে দরজা খুললো। তার পড়নে একটা হলদে রঙের শাড়ি আর তার ওপর সাদা অ্যাপ্রন। ওকে দেখেই এক মুখ হাঁসি …

মোনালিসা । ওঃ আপনি এসে গেছেন … আসুন ভেতরে আসুন। খুব সুন্দর সময় এসেছেন, একা একা রাঁধতে রাঁধতে কেমন বোর ফিল করছিলাম।

সৌগত ভিতরে ধুকে খানিকটা থতমত খেয়ে গেল। সে মধ্যবিত্ত ফ্যামিলীর ছেলে, অ্যাপার্টমেন্ট মানে ঐ একটা ফ্রিজ, একটা কালার টেলিভিসান, একটা ভালো ড্রেসিং টেবিল, একটা বইয়ের র‍্যাক, খাট বিছানা এই সবই বোঝে, কিন্তু এটা যেন একটু অন্য রকম। কমন যা যা থাকার সে সব তো আছেই তাছাড়াও ঘরের মধ্যেই টবের মধ্যে কিছু গাছ যার মধ্যে দুটোতে ফুল ফুটে আছে, ঘরের কোনায় একটা পাতা বাহার গাছ একেবারে সিলিং ওবধি উঠে গেছে, একটা ঘড়ের দেওয়ালের সাথে অ্যাকোয়ারিয়াম ফিট করা তার মধ্যে নানা ধরনের রঙিন মাছ ঘুরে বেরাচ্ছে … দূর থেকে একটা সার্ক আর কয়েকটা সি হর্সকে সৌগত চিনতে পারলো, এ ছাড়া কমন যেগুলো যেমন রেড শোডটেল, ব্ল্যাক মলি, ফাইটার, টাইগার, এঞ্জেল তো র‍য়েইছে।

মোনালিসাই ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিল, তিন বেড রুমের বেশ স্পেশাস অ্যাপার্টমেন্ট। একটা বেডরুমে আবার ঘরের মধ্যে একপাশ দিয়ে অবিরত জলের ধারা বয়ে চলেছে … সৌগত এটার মধ্যে বিরাট কিছু দেখতে পেল না। কিন্তু মোনালিসা বোঝাল যে এটাই স্টাইল, এই যে অবিরত একটা জলধারার আওয়াজ, এতে নাকি একটা ন্যাচারাল অ্যামবিয়েন্ট তৈরী হয় আর তাতে মানুষের নার্ভ ঠান্ডা থাকে। বাপরে, বোঝ ঠ্যালা, ছল ছল জলের শব্দে নাকি নার্ভ ঠান্ডা থাকে। অবশ্য সারা বাড়ীটাতেই বেশ কয়েকটা এয়ার কন্ডিশানিং মেশিন ফিট করা। এটা বরঞ্চ ভালো, শরীরটা অন্তত ঠান্ডা থাকে। এসব ছাড়াও তিনটের মধ্যে দুটো বেডরুমে দুটো মিডিয়াম সাইজের ফ্রিজ রয়েছে।

বেড রুম থেকে মোনালিসা ওকে রান্না ঘরে নিয়ে গেল। এটাও বেশ এলাহি, একচুয়ালি এই রান্না ঘরের সাইজ তাদের কোলকাতার বাড়ীর বেডরুমের চেয়ে বড় … বেশ বড় ঘরের চারিদিকে নানা রকমের কাঠের ক্যাবিনেট, একটা বিশাল ফ্রিজ, ঘরের এক কোনে একটা বেশ বড় ইলেকট্রিকের কুকিং টপ, তার ঠিক পাশেই গ্যাস আর নিচে ওভেন। ঘরের অন্যান্য জায়গায় একটা মাইক্রো ওয়েভ আর একটা জুসার বেশ অবহেলায় পরে রয়েছে। রান্না ঘর দেখাতে দেখাতে মোনালিসা হঠাৎ বললো …

মোনালিসা। আচ্ছা, আপনি পেঁয়াজ কাটতে পারেন?

সৌগত একটু থতমত খেয়ে তাকাতেই মোনালিসা নিজেই উত্তর দিল – ও ভুলেই গিয়েছিলাম, আপনি তো নিজেই রাঁধেন, তাহলে নিশ্চয়ই পারেন।

ও সৌগতকে একটা বেসিনের পাশে নিয়ে এলো, সেখানে একটা থালায় বেশ কিছু পেঁয়াজ আর একটা ছুড়ি রয়েছে। কিছু পেঁয়াজ অবশ্য অলরেডি কাটাও আছে। মোনালিসা থালাটা একটু এগিয়ে দিয়ে বললো …

মোনালিসা। আপনি শুরু করুন, আমি ওদিকে মাংসের পুরটায় একটু মশলা লাগাই। তারপর ময়দাটাও একটু মাখতে হবে, সেই কাল থেকে ফ্রিজে রাখা আছে তো। খুব কেয়ার নেওয়ার দরকার নেই যেমন পারেন তেমনই কাটুন। পেঁয়াজ তো মাংসের কিমার সাথে মেখেই দেব কাজেই যেমন তেমন একটা হলেই হোল। শুধু হাতটা সামলে রাখবেন … ছুরিতে ভীষণ ধার আর পেয়াজের রস চোখে গেলে এই কলে চোখটা ধুয়ে নেবেন।

সৌগতকে অবশ্য এতটা আনাড়ি ভাবার কোন কারণ নেই, সে তো প্রায় মাস দুয়েক নিজেই রাঁধছে আর কিছু না বুঝলেই রয়েছে কোলকাতায় মাকে ফোন করা। সে নির্দিধায় কাজে নেমে পরলো। আর মিনিট পনেরোর মধ্যে গোটা তিনেক বেশ বড় সাইজের পেঁয়াজ অনায়াসে সুন্দর ভাবে কুচিয়ে দিল। তারপর মাথা তুলে তাকাতেই দেখলো মোনালিসা ওধারের একটা টেবিলে এক তাল মাংসের কিমার ওপর সুন্দর একটা ব্রাশ দিয়ে তেল মাখাচ্ছে।

সাইড থেকে মোনালিসার সার্প নাক, তার উন্নত চিবুকের ডোল, নাকের পাটার পাশ দিয়ে ঠোঁটের পাশে নেমে আসা খুব সুক্ষ্য ভাঁজ … সৌগতকে কেমন যেন উন্মনা করে তুললো। এক গুচ্ছ কালো কোঁকড়ান চুল মোনালিসার কপালের ওপর এসে পড়েছে, সে মাঝে মাঝে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চুলটাকে সরাবার ব্যার্থ চেষ্টা করে আবার মন দিয়ে মাংসে তেল মাখাচ্ছে, তার বাঁ গালে অসাবধানে বোধহয় একটু হলুদ লেগে গিয়েছে কিন্তু মোনালিসা খেয়াল করে নি … সৌগত খুব মুগ্ধ হয়ে সেই দিকে তাকিয়ে ছিল। এর মধ্যে মোনালিসার সাথে তার বেশ কয়েকবারই টেমসের ধারে দেখা হয়েছে, কিন্তু সেটা ছিল বাইরের দেখা, সেখানে মোনালিসাও বেশ মাঞ্জা মেরে গাড়ী করে বেরিয়েছে, আর আজ সম্পূর্ন ঘরোয়া ব্যাপার।

আজ মুখে কোন মেক-আপ নেই, সাধারণ আটপৌরে হলুদ রঙের একটা শাড়ী পরনে, তাতেও সে চমৎকার। সৌগত বোধহয় একটু বেশীক্ষণই তাকিয়ে ছিল … মোনালিসা কিছু বুঝতে পারলো কিনা কে জানে অথবা হয়তো পেঁয়াজ কাটার শব্দ কিছুক্ষণ বন্ধ ছিল তাই মোনালিসা পাশ ফিরে তাকাল আর সৌগতর সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। সৌগত দারুণ এমব্যারাসড হয়ে মুখটা নামিয়ে ফেললো, মোনালিসা কিন্তু এসব গ্রাহ্য করলো না, কয়েক পা এগিয়ে এসে থালার দিকে তাকিয়ে দারুণ খুশী হয়ে বললো …

মোনালিসা। ও বাবা, এর মধ্যে তো বড় পেঁয়াজ গুলো সব কটা কুচিয়ে দিয়েছেন। আপনার তো হাত তো বেশ জলদী চলে দেখছি … এতো আমাকেও লজ্জায় ফেলবেন।

সৌগত এমনিতেই লজ্জায় অন্য দিকে তাকিয়ে ছিল, সে একটু মিনমিন করে বললো – এসব তো আমি রোজই রাত্রে করি, আমাকেও রাঁধতে হয় … তেমন কিছু শক্ত নয়।

মোনালিসা কিন্তু ওকে সংকোচ থেকে বাঁচিয়ে দিল, তার কাঁধটা একটু ঝাঁকিয়ে বললো – কেমন নেতিয়ে পরলেন যে, চিয়ার আপ, চলুন, পাশের ঘরে গিয়ে একটু বসি আর একটু কোক খাই দুজনে মিলে, তারপর আমি এসে ঝপাঝপ রোল গুলো শেপ করে ওভেনে ঢুকিয়ে দেব। আর তারপর তো মিনিট পঁচিশেক … কি খুব খিদে পায়নি তো?

সৌগত হাঁফ ছেড়ে বাঁচল, চোখাচোখি হয়ে যাবার পর তার এতো লজ্জা করছিল … সে বেসিনের কলে হাতটা ধুয়েই পাশের ঘরে এসে সোফায় বসে পড়লো। মোনালিসা তার হাতটা বোধহয় সাবান দিয়ে ধুয়ে একটা ফ্যান্টার বোতল নিয়ে আর দুটো কাচের গ্লাস নিয়ে ঘরে এসে ধুকলো।

 

।দশ।

 

মোনালিসা গ্লাসে ফ্যান্টা ঢালতে ঢালতে অন্য দিকে তাকিয়ে ছিল, ঘরে দিনের আলো ঢুকছে বন্যার জলের মতো, জানলার ভারি পর্দাগুলো সরান। একটু আগে সৌগত জানলার ধারে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল … পরিস্কার নীল আকাশ, মৃদু হাওয়ার মধ্যে খুব গরম না হওয়া ঝলমলে রোদ্দুর আর দূর থেকে এঁকে বেঁকে দূরে মিলিয়ে যাওয়া টেমস। ঠিক যেন স্যুভেনির সপে গিয়ে কেনা কোন পোস্টকার্ড। এই মুহুর্তে সৌগত জানলার কাছ থেকে এসে সোফায় বসেছে, আর … আঃ, সে কি সোফা … তাদের কোলকাতার রাম পুরনো শক্ত কাঠ সোফার মতো নয় যেটার গায় অসংখ্য ছেড়া খোঁড়া কাটা দাগ একটা কভারের তলায় চাপা দেওয়া। এ একেবারে জাত বনেদী জিনিস … পুরোটাই লেদার ফিনিস … বসলে কেমন গায়ের চামড়ায় লেদারের একটা ঠান্ডা অনুভূতি পাওয়া যায়, কেমন একটা মিষ্টি মিষ্টি পুরনো লেদারের গন্ধ নাকে আসে। সৌগত সোফার একদিকে বসে মোনালিসার দিকে তাকিয়ে ছিল, মোনালিসা তার ফর্সা হাতের লম্বা লম্বা আঙুল দিয়ে চামচি নাড়িয়ে ফ্যান্টার মধ্যে দু একটা আইস কিউব একটু গুলে ওর দিকে বারিয়ে ধরলো …

মোনালিসা। নিন, অনেক খাটালাম, এবার একটু ঠান্ডা খান। দাঁড়ান, দু একটা চুমুক মারুন কিন্তু বেশী খাবেন না, আপনার জন্য কিছু স্ন্যাক্সও রেডি আছে … নিয়ে আসছি।

মোনালিসা উঠে ওই ঘরের মধ্যেই ফ্রিজের মধ্যে থেকে একটা বড় বাক্স বার করে নিয়ে এলো। সৌগত ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো হলদিরামের খাঁটি ক্ষিরের সন্দেশ। মোনালিসা বাক্সোর ঢাকনাটা খুলে ওর দিকে বাড়িয়ে ধরলো …

মোনালিসা। আর প্লেট ট্‌লেট আনলাম না। সোজা সুজি হাত দিয়ে তুলে খান, জটা ইচ্ছে হয়।

সৌগত হাত দিয়ে প্রথমে একটা তুলে নিল, বেশ বড় সাইজ। মুখে দিতেই … আঃ, চমৎকার, একেবারে রিয়েল ক্ষীর। ইভেন কলকাতাতেও আজকাল এতো পিওর ক্ষীরের মিষ্টি পাওয়া যায় না। সৌগত বেশ তাড়িয়ে তাড়িয়ে পুরো সন্দেশটা খেল, সেই সঙ্গে মাঝে মাঝে ফ্যান্টায় সিপ মারলো। কিন্তু তারপর আর একটা আর খেতে পারলো না, ক্ষীরের সন্দেশ বেশ ভাড়ি হয় … একটা খেয়েই পেটটা বেশ ভর্তি হয়ে গেল। মোনালিসা কিন্তু একটা সন্দেশও খেল না, ও টুক করে কোথা থেকে একটা আধ খাওয়া চিপসের প্যাকেট বার করে কুর মুর করে কয়েকটা মুখে ফেললো, ওর হাতেও খানিকটা দিয়ে বললো …

মোনালিসা। আমি ক্ষীর টির বেশী খাই না, আমার আবার মোটা হওয়ার ধাত। মাঝে মাঝে এই চিপস গুলো খেয়ে নি। আচ্ছা, আপনাকে একটা কথা জিঞ্জাসা করবো?

সৌগত। কি … পারসোনাল কিছু?

মোনালিসা। না, সেরকম পারসোনাল কিছু নয়। মানে, আপনি তো বেশ শিক্ষিত … খড়গপুরের পি.এইচ.ডি. … এখন তো চাকরিও করছেন … মাইনেও তেমন খারাপও নয়। আবার আজকে দেখলাম যেরকম ঝপাঝপ পেঁয়াজ কাটলেন, মানে রান্নার হাতও খুব খারাপ নয়, অন্তত আনাড়ী তো নন। তাহলে একা কেন, বিয়ে করছেন না কেন?

সৌগত একটা ঢোক গিললো, এরকম প্রশ্ন আশা করেনি। মুখের মধ্যে তখনও ফ্যান্টার কমলালেবুর স্বাদ, কাজেই ঢোকটা গিলে খুব একটা খারাপ লাগলো না। খানিকটা সময় পাবার আশায় গেলাসের তলায় যেটুকু পড়েছিল সেটুকুও গলায় ঢেলে দিল, তারপর গলা টলা ঝেড়ে বললো একটু হাসলো …

সৌগত। অ্যাই … শুরু হোল। আমাকে বিয়ে দিয়েই ছাড়বেন দেখছি। এই তো গত সপ্তাহে টেমসের ধারে একবার ধরেছিলেন … কি … না গার্ল ফ্রেন্ড খুঁজছেন না কেন। এখন আবার কি … না বিয়ে করিনি কেন …। আরে সময় কোথায় হোল বলুন, এতো দিন তো শুধু স্কুল কলেজে পড়েই গেলাম, রোজকারটা করলাম কখন। আর রেগুলার ইনকাম না থাকলে ইন্ডিয়ানদের কারোর বিয়ে হয়, আপনি কোন বেকার ছেলেকে বিয়ে করবেন?

মোনালিসা গোটা কয়েক চিপস মুখে ফেলে চিবতে চিবতে বললো – আরে আমার কথা এখন ছাড়ুন। আর ছেলেদের দাম তার ফিউচারে। এই মুহুর্তে যে বেকার সে একমাস পরে চাকরী পেতেই পারে যদি ভালো সি.ভি. থাকে। একচুয়ালি সেটাই মেইন পয়েন্ট। আপনার তো সবই আছে … ভালো ডিগ্রি, একটা পোস্ট ডক জব যেটা এক্সটেন্ড হতেই পারে। তাহলে প্রবলেমটা কোথায় … ?

সৌগত একটু মুচকি হেঁসে বললো – আচ্ছা, শুধু আমাকে নিয়েই হঠাৎ পরলেন কেন বলুন তো? লন্ডনে তো বাঙালী ছেলের অভাব নেই … আছে কি?

মোনালিসা ঠোঁটটা একটু সুন্দর করে বেকালো – সরাসরিই বলছি। প্রথম যেদিন আপনাকে দেখলাম, সেদিনই কেমন লেগেছিল। কেমন ভ্যাবলার মতো একা একা টেমসের ধারে সিটে বসে আনমনা হয়ে জলের দিকে তাকিয়ে আছেন। লন্ডন একটা জীবন্ত শহর, এখানে সবাই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আর আপনি একটা ভালো বন্ধুত্ব খুঁজে পেলেন না। একচুয়ালি দু মাস কিন্তু অলরেডি হয়ে গেছে। আপনি কি একটু অ্যালুফ টাইপ নাকি বউ খোঁজার দায়িত্ব বাবা মার ওপর ছেড়ে দিয়েছেন?

সৌগত একটু সময় নিল, ফ্যান্টার বোতল থেকে নিজেই খানিকটা গেলাসে ঢেলে নিয়ে একটা বড় চুমুক মারলো, তারপর বললো –

সৌগত। আরে … এই তো সবে পি.এইচ.ডি. কমপ্লীট করে এখানে এসেছি, মাত্র মাস দুই হোল। একটু সময় তো লাগবে … তাছাড়া এটা তো কনট্র্যাক্ট জব। আর সত্যি বলতে কি, আমি সব সময় গার্ল ফ্রেন্ড গার্ল ফ্রেন্ড করে লাফিয়ে বেড়াই না … কিছু গল্পের বই আর ঘরে একটা টেলিভিশান থাকলে একাই সময় কেটে যায়, সে আপনি যাই বলুন।

মোনালিসা। সেরকম ভাবে ভাবলে তো সবাই একাই থাকতো, তাই না? আর এই সব জব তো এই রকমই হয় … শুরুতে সব সময়ই কনট্র্যাক্ট জব। কয়েক বছর এক্সপেরিয়েন্স করে ভারতে কোথাও অ্যাপ্লাই করলে নিশ্চয়ই পারমানেন্ট কিছু হয়ে যাবে।

সৌগত। একচুয়ালি সেটারও কোন গ্যারান্টি নেই। তবে অনেকেই পায় … এই পর্যন্ত।

মোনালিসা। আপনার কনফিডেন্সই বা এতো কম কেন? আপনারও কিছু একটা নিশ্চয়ই হয়ে যাবে। তার জন্য বিয়েটা পিছিয়ে দিচ্ছেন কেন? আর গার্ল ফ্রেন্ড করে নাই বা লাফালেন, কাউকে জীবনে তো দরকার, সেটা তো অ্যাকসেপ্ট করেন?

সৌগত। হ্যাঁ করি। আর পিছিয়ে দিচ্ছি কোথায়? আমার তো এখনও সেরকম কোন চেস্টা শুরুই হয়নি।

মোনালিসা। কেন, বাড়ী থেকে কিছু বলছে না?

সৌগত। আরে, বললাম না, সবে তো দুমাস হলো এসেছি। এখনো গ্রুপের সবার সাথেই ভালো করে খাপ খুলে মেশা হয়নি। দু একটা গ্রুপ পার্টিতে গেলে আরো ভালো করে সবাইকে জানবো। এখানে গ্রুপটা একটু বড় আর স্টুডেন্টরা নানা এরিয়ায় কাজ করে তাই ফ্রেন্ডশিপ হতে একটু সময় দরকার হয়। বছর খানেক গেলে তারপর বোঝা যাবে। তারপর গ্রুপ লীডারের সাথে ভালো করে র‍্যাপো তৈরীর দরকার আছে।

মোনালিসা। সে সব করুন না … ওরকম মেলামেশা তো সবারই দরকার হয়। কিন্তু তাতে বিয়েটা পিছিয়ে যাচ্ছে কেন? আর এখন বললে তো এখনই হবে না, বেশ কয়েক মাস সময় লাগবে …।

সৌগত। না … মানে এখন আমার ওপর অনেক চাপ চলছে। নতুন একটা সাবজেক্টের ওপর পড়াশুনো করছি, তাছাড়া কোডিং করারও ব্যাপার আছে। এখন বিয়ের কথা ভাবছি না। তবে পরের বছর হয়তো চিন্তা করবো। একটা এক্সটেনশান পেলে আরো ভালো হয়। আমার বিয়ের বয়স তো পেরিয়ে যাচ্ছে না রে বাবা।

মোনালিসা। আপনার কেমন যেন সব ছাড়া ছাড়া ভাব … এটা হলে হয়, ওটা হলে ভাববো। কি … কলকাতায় কোন প্রেম ট্রেম আছে নাকি বলুন তো?

সৌগত। আরে নানা … আমরা তো মিডিল ক্লাস ফ্যামিলীর ছেলে …।

মোনালিসা। তো কি হয়েছে। আমার তো কত বন্ধুই মিডিল ক্লাস ফ্যামিলীর ছিল … কলেজ লাইফে অনেকে দুটো তিনটে করে প্রেম করেছে, বেশ চুটিয়ে। ওসব মিডিল ক্লাস ট্‌লাস এখন চলে না, প্রেম সবাই করতে পারে … অবশ্য সবার দ্বারা হয় না এটাও ঠিক। আপনার কি ব্যাপার … কলেজ লাইফে ল্যাং ট্যাং খাননি তো?

সৌগত। মানে … প্রেমে ফেল করার কথা বলছেন?

মোনালিসা। মানে কাউকে ভালো টালো বাসলেন কিন্তু শেষে সে হাত ফসকে অন্য কারুর সাথে কেটে পরলো … এই আর কি। সেরকম কিছু ব্যাপার আছে নাকি?

সৌগত। সেরকম বিশেষ কিছু নয়। তবে একজনকে একটু ভালো লাগতো … তবে সে সব বেশ কিছুদিন আগের।

মোনালিসা। হ্যাঁ … এই বার বুঝেছি। তাহলে তার কথা এখনও ভেবে চলেছেন? তাই আপনাকে একটু উদাসও দেখায় কিন্তু। নিশ্চয়ই দেখতে ভালো ছিল? কি হয়েছিল একটু খুলে বলবেন?

সৌগত। নানা সেরকম দারুণ কিছু দেখতে নয় তবে পড়াশুনোয় চমৎকার … আর আমাকে একদম পাত্তা দিত না কোনদিনই। বেশ বড় লোক ঘরের মেয়ে, অন্য একটা ছেলের সাথে চুটিয়ে প্রেম করতো। ওরও পি.এইচ.ডি. শেষ তবে এখন কি করছে বলতে পারছি না।

মোনালিসা। অ … তাহলে গোপন অনির্বাপিত আকাঙ্ক্ষা … মনের মধ্যে নিশ্চয়ই এখনও রাগ আছে। আচ্ছা …, তাহলে সব মেয়ের ওপরই রেগে আছেন, তাই তো?

সৌগত অনেকক্ষণ পরে খানিকটা মন খুলে হাসলো, তারপর বললো – আরে আপনি যা ভাবছেন ওরকম সিরিয়াস কিছু নয়। ও আমাদের ডিপার্টমেন্টেরই মেয়ে, আলাপ টালাপ ভালোই ছিল, মাঝে মাঝে চা-ও একসাথে খেয়েছি … ব্যাস ঐ পর্যন্ত। ও ওর কাজে মত্ত আর আমি আমার …। আসলে মেয়েটা খুব ক্যারিয়ারিস্ট, ও কাউকে এই মুহুর্তে বিয়ে টিয়ে করতো না। ওর একচুয়াল প্রেমটাও তো কাটিয়ে দিল।

মোনালিসা। আরে ওর মধ্যেই যা করার করতে হয় … ওরকম ভ্যাবা গঙ্গারাম হয়ে … এই যাঃ …।ভুলে গেছি …।

 

।এগার।

 

মোনালিসা লাফিয়ে উঠে রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। তারপর ওখান থেকে চিৎকার করে বললো – একদম ভুলে গেছি … মাংসটা মেখে রেখে গেলাম … ওটা তো ময়দার মধ্যে পুরে ওভেনে দিতে হবে। না হলে খাবেনটা কি?

খানিক্ষণ চুপচাপ, রান্না ঘর থেকে নানা রকম ঠুং ঠাং আওয়াজ আসছে আর সৌগত জানলার সামনে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে রৌদ্রে চান করে ঝকঝকে হয়ে ওঠা টেমসের জলের দিকে তাকিয়ে আছে। সকালেও টেমস বেশ ব্যাস্ত, নানা সাইজের বোট আর ফেরী যাতায়াত করছে। একটু দূর থেকে লন্ডনকে ভারি চমৎকার দেখাচ্ছে। সৌগতর এই একটা দোষ, কিছু সুন্দর জিনিস বা দৃশ্য দেখলেই সে কেমন আনমনা হয়ে তাকিয়ে থাকে, অনেকক্ষণ তার অন্য কোন দিকে দৃস্টি থাকে না। মোনালিসা ঠিকই বলেছে, সে কেমন নিজের মনের মধ্যে হারিয়ে যায়, তখন তাকে বাইরে থেকে হয়তো ভ্যাবলাই মনে হয়।

খানিক বাদে মোনালিসা আবার বললো – একা ঘরে চুপচাপ বসে থাকবেন না। টিভিটা খুলে কিছু একটা দেখুন, আমার এদিকে প্রায় শেষ, এগুলোকে ওভেনে দিয়েই আমি আসছি।

সৌগতর কেমন যেন স্বভাব, সে একা থাকতে বেশ পছন্দ করে। প্রায় সব উইক এন্ড গুলোই তার একাই কাটে, মাঝে মাঝে খুব বোর লাগলে পিকাডিলি সার্কাস বা লেস্টার স্কোয়ারে চলে আসে। ওখানে বেজায় ভিড়, কাজেই সময় কেটে যায়, না হলে কোন একটা হলে গিয়ে নতুন কোন মুভি শোয়ে ঢুকে পরে। আজ এই হাল্কা হাওয়ায় জানলার সামনে দাঁড়িয়ে লন্ডন দেখতেই তার ভালো লাগছে … টেমসের পাশ দিয়ে একটা চওড়া রাস্তা গিয়েছে … এখন তাতে বেশ ভিড়, অসংখ্য প্রাইভেট কার যাচ্ছে আবার তার মধ্যেই লাল দোতলা বাসগুলো কেমন ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার পাশের ফুটপাথ দিয়ে বহু লোক হেঁটে চলেছে … আজ শনিবার কাজেই রাস্তায় কেমন একটা উইকএন্ড সেলিব্রেশানের আমেজ। কিন্তু বেশিক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা হোল না, রান্না ঘর থেকে প্রায় বাতাসেরই মতো মোনালিসা ঘরে এসে ঢুকলো …

মোনালিসা। ও বাবা, আপনি এখনও জানলার ধারেই দাঁড়িয়ে … অদ্ভুত তো, আপনি বাচ্চা নাকি… গাড়ী, রাস্তা, নদী এসব আগে দেখেন নি?

ওর কথায় রাগ নেই, কেমন একটা কোমল মিস্টি শাসন রয়েছে। সৌগত একটু লাজুক হেসে বললো – না মানে দেখতে বেশ ভালো লাগছিল … এই টিভিটা খুলছি।

মোনালিসা তার জন্য অপেক্ষা করলো না, টেবিলের ওপর থেকে রিমোটটা নিয়ে একটা বোতাম টিপে দিল আর টিভিতে ডিসকভারি চ্যানেল শুরু হয়ে গেল। হয়তো মোনালিসা ওটাই বেশী দেখে … এখন বেয়ার গ্রীলসের একটা অ্যাডভেঞ্চার দেখাচ্ছে … বেয়ার কোন রেইন ফরেস্টের মধ্যে দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে এগিয়ে চলেছে, পিঠে একটা ছোট ব্যাগ ছাড়া আর কিছুই নেই। সৌগত বেয়ার গ্রীলসের দারুণ ফ্যান … কলকাতায় সে ডিসকভারিতে বেয়ারের অনেক এপিসোডই দেখেছে, লন্ডনে অবশ্য তার এখনও কেবল নেই কাজেই এসব দেখা সম্ভব হয় না। সে সোফায় বসে পরে বেশ উৎসাহ নিয়ে দেখছিল, মোনালিসা জিঞ্জাসা করলো …

মোনালিসা। কি এটাই দেখবেন নাকি পালটে কোন ট্রাভেল চ্যানেলে দিয়ে দেব … কোন নতুন দেশ দেখবেন …!

সৌগত। আরে বেয়ার গ্রীলস মানেই তো নতুন দেশ, বলতে পারেন সিটি না দেখিয়ে বন জঙ্গল মানে নেচার দেখাচ্ছে। তাছাড়া বেয়ার গ্রীলস আমার ভিষণ প্রিয় কিন্তু।

মোনালিসা। সে তো বুঝতেই পারছি … যেরকম জমিয়ে সোফায় বসে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন যেন হেমা মালিনী স্যুয়িম স্যুট পরে সাঁতার কাটছে …।

সৌগত আবার হা হা করে হেসে উঠলো – আপনি দেখছি বড় ডাইরেক্ট কমেন্ট করেন …।

মোনালিসা। ডাইরেক্ট  কি আবার … আপনিও বাচ্চা না, আমিও নয়। আর আমি বাবা বন্ধুত্ব যার সাথে করি তার সাথে অত লজ্জার ধার ধারি না। আপনি আবার অফেন্ডেড হলেন নাকি?

সৌগত। একদম না … তবে আমার সাথে আপনার আলাপ তো সবে কয়েক সপ্তাহ … তাই …।

মোনালিসা। তো কি … আমি তো আপনাকে নিজেই বাড়ীতে ইনভাইট করলাম … নাকি? আর কথাটা তো খারাপ বলিনি … ছেলেরা তো সিনেমায় নায়িকার সাঁতার কাটার বা বৃষ্টির জলে ভিজে নাচার সিন থাকলে চোখ বড় বড় করেই দেখে … ঠিক নয়?

সৌগত আজকে হঠাৎ কেমন ঠোট কাটা হয়ে গেছে, সেও বলে দিল – একদম ঠিক বলেছেন।

মোনালিসা একটু মুচকি হেঁসে তাকাল – হু …, ছেলের মুখ খুলেছে তাহলে। তবে ঘাবড়াবেন না, মেয়েরাও দেখে। আপনি হয়তো জানেন না, কারণ মেয়েদের তো বোঝেন না, আমি লেডিজ হোস্টেলে দু বছর কাটিয়েছি, আমি জানি। সালমান খান বা রনবীর সিং কোন সিনে খালি গায় হলে মেয়েদের চোখ দুটো আপনার মতোই রসগোল্লার মতো বড় হয়ে যায়।

সৌগত একটু হেসে ওর দিকে তাকাল – তা ঠিক। ওগুলো একটু আধটু বুঝি।

মোনালিসা। ছাই বোঝেন। আপনারা, মানে ছেলেরা মেয়েদের যা যা নিয়ে ফ্যান্টাসী করেন, মেয়েরাও ছেলেদের করেসপন্ডিংলি ঠিক সেই সেই ব্যাপার নিয়ে ফ্যান্টাসী করে … । তবে, সংকোচটা মেয়েদের একটা দুর্ধর্ষ ডিফেন্স … ওটার আড়ালে মেয়েরা দারুণ ভাবে নিজেদের বাঁচায়। আর একটা টিপস দিচ্ছি, মেয়েদের লজ্জা জিনিসটা অনেক সময়ই ফেক।

সৌগত। মাই গড …। আপনি তো এই নিয়ে একটা বই লিখতে পারেন।

মোনালিসা মুচকি হেসে বললো – হয়তো আপনার জন্য লিখতে হতে পারে। দাঁড়ান … ওভেনটা দেখে আসি, বোধহয় হয়ে গেছে।

মোনালিসা উঠে গেল। একটু পরেই হাতে একটা ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকলো।

 

।বারো।

 

মাটন রোল গুলো চমৎকারই হয়েছিল। গোটা দুই খুব তাড়াতাড়ি পেটে চালান করে দিয়ে সৌগত একটু দম নিতে পারলো। অনেকক্ষণ ধরেই ভাবছিল, এবার একটু ফাঁক পেয়ে সে বলেই ফেললো …

সৌগত। আচ্ছা, আমার ব্যাপারে তো অনেক কিছুই বললেন … প্রেমের ব্যাপারেও দারুণ সব টিপস দিলেন, তা আপনার ব্যাপারটা কি? আপনি একলা এখানে কি করছেন?

মোনালিসা একটু চুপচাপ বসে থাকলো, তারপর কেমন একটু নিরাশ ভাবে হাসলো – আমার ব্যাপারে আবার কি জানতে চাইছেন? সেরকম কিছু তো বলারই নেই।

সৌগত। সে কি … আপনাকে তো কিছু বোঝাই যায় না। এখানে, মানে লন্ডনে একা একা কি করছেন?

মোনালিসা একটা দীর্ঘ্যস্বাস ফেললো, তারপর উঠে অন্য একটা ঘরে চলে গেল, অবশ্য একটু পরে ফিরেও এলো … হাতে একটা মোটা বইয়ের মতো। সেটা সে সৌগতর হাতে দিল – দেখুন।

ফটো অ্যালবাম …। সৌগত বেশ কিছুক্ষণ ধরে বেশ ঘেঁটে ঘুঁটে দেখলো। বিয়ের সাজে মোনালিসাকে মার্ভেলাস দেখাচ্ছে। ওর হাসব্যান্ডও বেশ লম্বা এবং চওড়া, ভালো দেখতে। সৌগত মনে মনে কেমন যেন মিইয়ে গেলো কিন্তু বাইরে সেটা প্রকাশ হতে দিল না। বেশ স্মার্টলি অ্যালবামটা সোফার ওপর রেখে প্রশ্ন করলো …

সৌগত। মাই গড … আপনি তো দারুণ চেপে রাখতে পারেন। কবে বিয়ে করেছেন … আপনার হাসব্যান্ড কোথায়, আলাপ করিয়ে দেননি তো?

মোনালিসা মুখটা একটু বেঁকাল, তারপর জানলার বাইরের দিকে তাকিয়ে কেমন শান্ত ভাবে বললো – বিয়ে তো আমার প্রায় দু বছর হয়ে গেছে, ইন্ডিয়াতে থাকতেই। আর আমার হাসব্যান্ড … সে খুব বিজি লোক, ব্যাঙ্কের খুব বড় ম্যানেজার। সকালে আটটার আগে বেরিয়ে যায় আর ফিরতে ফিরতে প্রায় সাড়ে নটা। এখন তো সে লন্ডনেও নেই, কয়েক দিনের জন্য স্যুইজারল্যন্ডের জ্যুরিখে গেছে, সেখান থেকে ফ্র্যাঙ্কফার্ট হয়ে আগামি সপ্তাহে … কি জানি বোধহয় বুধ কি বৃহস্পতিবার লন্ডনে ফিরবে। পরে কোন একদিন আসবেন, আলাপ করিয়ে দেব।

সৌগত কেমন বোকার মতো তাকিয়ে রইল। সে কিরে ভাই, এতোদিনের আলাপ আর মোদ্দা কথাটাই জানা হয়নি। সে আবার বোকার মতো মোনালিসার দিকে তাকাল, নাঃ … মেয়েটার এতো অল্প বয়স, ঝকঝকে গায়ের রঙ, এক মাথা কোঁকড়ান চুল কিন্তু কোথাও একটুকু সিঁদুরের চিহ্ন নেই। মোনালিসা ব্যাপারটা বুঝতে পারলো, চোখ দুটো একটু চকচক করে উঠলো দুষ্টুমিতে …

মোনালিসা। কি … সিঁদুর খুঁজছেন নাকি?

সৌগতর কেমন লজ্জায় কথা আটকে গেল – না, মানে বাঙালী তো … তাই …।

মোনালিসা। আমি বরাবর ইংলিশ মিডিয়ামে পড়েছি … সাইথ পয়েন্ট, লরেটো কনভেন্ট এই সব। আমার বাবাও বহু বছর বাইরে কাটিয়েছেন, আমাদের ফ্যামিলীতে এগুলো ম্যাটার করে না। আমার বরও বেশ ফরোয়ার্ড।

সৌগত একটু কিন্তু কিন্তু করে জিঞ্জাসা করেই ফেললো – আচ্ছা, তাহলে আপনি এরকম একা একা নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ান কেন? বরের সাথে ঘুরলেই তো পারেন?

মোনালিসা আবার কেমন উদাস হয়ে গেল। খানিক্ষণ চুপ করে থেকে বললো – বললাম না আমার হাসব্যান্ড ভিষণ ব্যাস্ত, তাছাড়া ছুটির দিনে ও গলফ খেলতে যায় ওর বন্ধুদের সাথে, আমার ওসব একদম ভালো লাগে না। আমি বাড়ীতেই থাকি বা কোথাও বেরিয়ে পড়ি। এই ভাবেই তো আপনার সাথে দেখা হয়ে গেল … কেমন ভালো হয়নি? ও অবশ্য দিনে তিন চার বার আমাকে ফোন করে বা এস.এম.এস. করে।

সৌগত কি আর বলবে, চুপচাপ বসে থাকলো। তবে সে মনে মনে ভাবলো যে ব্যাপারটা এতো সহজ নয়, ডাল মে কুছ কালা হ্যায় ভাই।

 

********

 

সেদিন কেমন একটু মনটা খারাপ নিয়ে উদাস ভাবে সৌগত নিজের বাড়ীর দিকে যাচ্ছিল। বিকেল বিকেলই বলা চলে, প্রায় সাড়ে পাঁচটা বাজে … এই সময় সে সাধারণত টেমসের আশে পাশে কোথাও একা একাই ঘুরে বেড়ায় … আজকে আর ভালো লাগছে না। মনের মধ্যে কোথাও একটা ছোট্ট ক্ষত … চুইয়ে চুইয়ে রক্ত ঝড়ছে। আগে মোনালিসাকে দেখে একরকম লাগতো, আজ একদম সব পালটে গেলো। দামি গাড়ী, দামি পোশাক, দামি ঘড়ি … এসবের আড়ালে মোনালিসার আর একটা অন্য পরিচয় আছে। সে ভীষণ একাকী …। সৌগতর মনে হোল মোনালিসা যেন সেই একটা ফুল গাছ যাকে কেউ জল দেয় না … গাছটা আস্তে আস্তে মড়ে যাচ্ছে। কিন্তু সৌগতই বা কি করবে, … কয়েক ঘন্টা আগে অবধিও সে এক রকম চিন্তা করেছে কিন্তু যে মুহুর্তে জানলো যে মোনালিসা বিবাহিত সেই মুহুর্ত থেকে সে বাইরের মানুষ, ওদের ফ্যামিলীর মধ্যে কি হচ্ছে তা দেখার অধিকার তার নেই। সে শুধু মোনালিসার বন্ধু, এই পর্যন্ত।

কিন্তু মোনালিসার অদ্ভুত মানসিক স্থৈর্য … কয়েকদিন পরেই সন্ধ্যেবেলায় আবার ফোন।

মোনালিসা। কি করছেন, কিছু পরছেন নাকি বিছানায় লেপটে শুয়ে আছেন?

সৌগত। মানে প্রায় দুটোই। আজকের খবরের কাগজটা দেখছিলাম বিছানায় বসে।

মোনালিসা। ভালো … সবে তো কলেজ থেকে এসেছেন, বেশী বিরক্ত করবো না। এই শনিবার বিকেল পাঁচটা নাগাদ লেস্টার স্কোয়ারে চলে আসবেন। নতুন একটা বই এসেছে … স্পটলাইট … শুনেছি খুব ভালো হয়েছে, অস্কারের জন্য নমিনেটেড, দুজনে দেখতে যাব। টিকিট কাটাই থাকবে।

সৌগত। খুব ভালো, আসবো। কিন্তু টিকিটের দামটা আপনাকে নিতে হবে, প্রত্যেকবার আপনি দেবেন তা হবে না, সে আপনার বর যতই বড় চাকরী করুক।

ফোনের ওদিক থেকে সুরেলা একটা হাসি শোনা গেল – বেশ বেশ, ভালোই … আমারই তো কিছু টাকা বেচে গেল। ঠিক আছে তাহলে ওই কথাই রইল … শনিবার বিকেল পাঁচটা, লেস্টার স্কোয়ার।

সৌগত। ও.কে. … বাই।

 

… to be continued

~ মোনালিসা , শুধু তোমার জন্য (তৃতীয় পর্ব) ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleটাকার ভাঙানি
Next articleফিট্‌বিট্‌ (প্রথম পর্ব)
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments