শিয়ালদা স্টেশানে ট্রেন এসে থামার কিছুক্ষন পর ট্রেন থেকে প্রথম প্ল্যাট ফর্মে পা রেখেই হক চকিয়ে যায় মহাদেশ, এত লোক এত ভীড় ভাট্টা তো ও সে বাপের কালে দেখেনিকো। কেউ হাঁটছে কেউ দৌড়চ্ছে তো কেউ বসে আছে। শুধু ওর চোখের সামনে যত লোক সে দেখতে পাচ্ছে অত লোক তো ওর গোটা গাঁয়েই নেই, “এতো মাইনষের ভীড়ের মধ্যে তার বাপরে সে খুঁজে পাবে কেমনে? তার ওপর এক্কেবারে একা সহায় সম্বল হীন ভাবে এসে উপ্সথিত হয়েছে সে এখেনে… এর আগে সে একলাটি কোতাও যায় নেকো। মা তো আসার আগে কত করে কয়েছিল ওরে খুকা যাস নে, শেষে তুর বাপের মত তোরেও গিলে খাবে উ শহুরটি। কিন্তু মায়ের কতা তখন মোটে কানে তুলে নি সে, এখন বুইঝছে এ হেথা তার বাপের মত একজন মানুষ রে খোঁজা সহজ ব্যাপ্পার লয় কো। কিন্তু বাপরে তো যে কুরেই হোক তারে খুঁজে লিয়ে যেতে হবে গায়ে। লয় তো মাটিকে যে সে বাঁচাতে পারবে নি গো। সেই পাঁইচ বচ্ছর আগে মা কে কাজ খুঁইজতে যাচ্ছে বলে এই হেথা শহুরে এয়েছিল বাপ্টি। তার পর থেকি আর কুন খবরটো লাই, এমন কি কুন টেকা পয়সাও পাঠায় লাই কুনো কালে। বাপের চিন্তাটি করে করেই তো মা আইজ অমন শরীল খারাপটি বাঁধায়েছে, মা মুখে যত-ই বলুক না কে যে তার কিচ্ছুটি হয় নেকো। কিন্তু সে খুব ভালো কইরেই জানে যে তার মায়ের শরীল টি মোটে ভালো লাই। সে তো আর ছুটো খুকাটি লাই, যে বুইতে পারবে নি, সে এখন বড়টি হয়েছে, এ আষঢ়ে পনেরোয় পরিছে সে। কাজেই… কিন্তু মনে মনে সে যতই নিজেকে বড় ভাবুক না কেন আদপে মহাদেশ সেদিন কিশোর এক বালক বই অন্য কিচ্ছু ছিল না, কাজেই বাবাকে খোজার জেদ নিয়ে সে এই প্রথম একা একা শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দিনেও এখানে এই স্টেশানে পা রাখার সাথে সাথেই ওর বুক টা ধড় পড় করতে শুরু করে, গলা শুকিয়ে যায়, কিছুতেই বুঝতে পারে না এখানে কিভাবে তার বাবাকে খুজবে সে?” কিন্তু বাবা কে যে খুঁজে বার করতেই হবে তাকে, গাঁয়ে অসুস্থ মা তিন বছরের বোন টাকে যে মুখ দেখাতে পারবে না সে। বাবা নিয়ে জাওয়াটা ওর খুব প্রয়োজন। কিন্তু এত বড় শহরে একটা মানুষ কে খুঁজতে তো সারা জম্ম লেগে যাবে অথচ্ ওকে যে দিন পনেরোর মধ্যেই যা করার করতে হবে, মা বোন কে গাঁয়ে পরের লোকের ঘাড়ে ফেলে রেখে তো আর বেশি ও এখানে বাবাকে খোজার নামে পরে থাকতে পারে না। নেহাত গায়ের মোড়ল কাকা ভালো মানুষ টেকা পয়সা আছে তাই মা বুনের দেয়িত্ব লিয়েছে, যদিও ভোলা মানে উ মোড়ল কার ছেলে ভোলা, ওর ছেলে বেলার বন্ধু, আরে বাপু ছেলে বেলা থেকেই পোলিও রোগে যার দুটি পা অকেজ। সেই ভোলা ছিল বলে এমনটি হয়েছে নয় তো ওর বাপ কে খুঁজতে আসাই হতো নেকো। মা বুন রে ছাড়াও আর এক জিনিস ফেলে এয়েছে সে তা হলো দারিদ্যতা, এক বেলা আধ পেটা খেয়ে এতদিন দিন কাটায়েছে মা বুনে, বাপ রে না ফিরাইলে সেটিও মিটবে লাই। উর তো ভারী ওই ছিমেন্ট গেঁথার কাজ, লামেই রাজ মিস্তি দশাটি ভিখিড়ীর ও অধম রে বাপু, গায়ে পেটের ভাত যোগার করতেই দিন কাবার বাড়ি ঘর আর কে গাঁথবে কও দিনি? কাজেই বাপ রে ফেরাতে তারে হবেই।। চ মদেশ আর ভয় করে কাজ লাই, লাজ, লজ্জা, আর ভয় গরীবদের উ তিনটে থাকতে লয়। নিজের মনকে এভাবে সান্তনা দিতে দিতে শিয়ালদা স্টেশানের আশে পাশে হাটতে থাকে মহাদেশ। গাঁ থেকে আসার সময় ভোলা বুদ্ধি করে মোড়ল কার থেকে লুক্কে ওর হাতে দু হাজার টেকা আর লিজের বাপের একটি ছবি এনেছিল জোয়ান কালেই মেলাটিতে তোলা,সেই দুইটি আছে বলে নেহাত এখনো ও হেটে চলে বেরাচ্ছে, বাপরে পাওয়ার আশাটি লিয়ে, লয় তো… কিন্তু এই শহুরে তো উ কটা টেকা নস্যে, কাজেই ওরে একটা কাজ ও করতি হবে, যাতে কিছুটেকা লিয়ে গাঁয়ে ফেরা যায়, এক্কেনে তো রাজ মিস্তির মেলা কাজ একটা আর তার জুটবেনি? গাঁয়ে তো উর গাথনির মেলা নামটি করে লুকে… সেই দিন টা এদিক সেদিক কাটিয়ে বাবার খোঁজ করতে থাকে মহাদেশ, স্টেশানের ট্যাক্সি ওলাদের কাছে জিঞ্জাস করলে তার কিছু বলতে পারে না ঠিকি কিন্তু ওদের এসোসিয়েশানের কাছে নিয়ে যায় তারা মহাদেশ কে। সেখান থেকেই বাবার ছবি সমেত পুলিশের কাছে যায় সে এবং পুলিশ বাবার ছবিটি রেখে বলে দেখে জানাবে? কিন্তু তার কতা কি আর পুলিশ ফুলিশ মান্যি করে রে বাপু? তবে এর মধ্যে একটা বোকামি করেছে সে, বাবার ছবিটি সে ওই থানাতেই রেখে এয়েছে, ভেবেছিল সে তো বাবা কে চেনেই কাজেই কোন অসুবিধা হবে না, কিন্তু এখন রাস্তায় বেরিয়ে বাবার খোঁজে ফের লাগতে গিয়ে সে বুইজঝছে, যে সে বাবা কে চিনলেও লোকদের কে সে বাপ রে চেনানো মোটেই সহজ নয়। অবশেষে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত পায়ে রাতের খাবার খেয়ে শিয়ালদা স্টেশানের কাছেই এক গলির ভেতর এক বাড়ির বাইরের রকে রাত কাটানোর জন্য মাথা রাখে ও। মাথার ওপরের রাতের আকাশের দিকে তাকাতেই তার মন ডুকরে কেঁদে উঠলো, এই একি আকাশ তাদের গাঁয়ে ও, একে একে গাঁয়ের, মায়ের, বুনের, ভোলার সকলের ছবি ফুটে উঠতে দেখলো সে আকাশের গায়ে। তার দু চোখ জকে ভিজে গেল, আসতে আসতে সেই চোখের পাতা ভারী হয়ে আসতেই সমস্ত ছবি সমেত মহাদেশ পাড়ি দিল ঘুমের দেশে…ওহহহ এমা দেখলেন কথায় কথায় তো মহাদেশের গাঁয়ের নামটাই বলা হয়নি, তার গাঁয়ের নামটি রঞ্জনা…
দেখতে দেখতে অনেক গুলো দিন, দিন থেকে সপ্তাহ কেটে সময় এখন মাস কাবার করতে যায়, কিন্তু মহাদেশ তার বাপের কোন খোঁজ পায় না, ওদিকে গাঁয়ে ফোন করলেই মা বার বার ওকে ফিরে আসার কথা বলে। কিন্তু ও মনে মনে জেদ ধরেছে বাবার হদিশ না নিয়ে ও কিছুতেই কোত্থাও যাবে না। এদিকে শহরে পা রাখার পর একের পর এক ঘটনার প্রবাহে সে এসে পড়েছে এখন বড় বাজারে, এখানে সে একটি কাজ ও জুটিয়েছে, তার সাথে জুটিয়েছে এক দোস্ত, নাম নান্টু রাস্তার ধারের ঝোপড়িতে তার ঘর সেখানেই থাকে ওরা দুজন। এই নান্টুর দৌলতেই সে এখানে বিল্ডিং তৈরির কাজটা পেয়েছে। এখন সে দিনে কাজ করে আর রাতে এদিক সেদিক ঘুরে বেরায় বাবার খোঁজে, এমন কোন পুলিশ থানা নেই, দোকান পাট নেই ও চত্তরে যেখানে সে বাবার খোঁজ করেনি কিন্তু সব জায়াগা থেকেই পেয়েছে হতাশা আর নিরাসা। সাধারণত ওদের কাজ সপ্তাহের ছয় দিন, আর রবি বার ছুটি। ওর কাজের সমস্ত সঙ্গি সাথীরা গোটা রবি বার জুড়ে আনন্দ ফুর্তি করে কাটালেও মহাদেশ রবিবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত খুঁজে চলতো ওর বাবা কে। কিন্তু এই রোব বার ওর রুটিনটাকে একটু পরিবর্তন করতে হয়েছিল মহাদেশ কে তা যদিও ওর সেই শহুরে বন্ধু নান্টুর জেদাজেদি তে। সে আজ প্রায় একপ্রকার জোর করেই মহাদেশ কে ধরে এনেছে চুনুদার চোলাই সেন্টারে। যদিও নান্টুর মহাদেশ কে এখানে আনার উদ্দেশ্যটা অন্য, আসলে নান্টু কথানুযায়ী মহাদেশ জেনেছে যে চুনুদার চুল্লুর ঠেক এই অঞ্চলের বিখ্যাত মালের দোকান, শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোক জন এখানে আসে মাল খেতে, ওর বিশ্বাস ছিল যে এখানে একবার মহাদেশ নিজের বাবার কথা পারলে ঠিক তাকে খুঁজে বার করা সম্ভব হবে মহাদেশের পক্ষে, নান্টুর বিশ্বাস যে সঠিক ছিল তা আচিরেই বোঝা গেল যখন মহাদেশের সাথে ফুটো মস্তানের আলাপ হল সেই চুনুদার চুল্লুঠেকে । সে হয়তো মহাদেশের বাবার খবর দিতে পারলো না কিন্তু মহাদেশের বাবার নামের সাথে মিল আছে এমন এক মানুষের সন্ধান দিল বইকি।
ফুটো মস্তানের কথা মতো যথা সময়ে যথা জায়গায় পৌঁছাল নান্টু এবং মহাদেশ, স্থান্টি কোলকাতার অন্যতম বিখ্যাত এবং কুখ্যার স্থান সোনাগাছী রেড লাইট এরিয়া। প্রথমে এরকম একটা জায়গায় বাবা কে পাওয়া বা তার খোঁজ পাওয়া যাবে না বলে চলেই যাচ্ছিল মহাদেশ কিন্তু পরে নান্টুই তাকে বোঝায় যে পরিস্থিতি আজ যেমন তাকে এ এলাকায় এনেছে তেমনি তার বাবাকেও তো পরিস্থিতি এখানে আনতে বাধ্য করতে পারে? কথাটা শুনে সেদিন আর ফিরে না গিয়ে নান্টু আর ফুটো মস্তানের সাথে পা মিলিয়েছিল মহাদেশ? ফুটো মস্তানের নির্দেশ অনুযায়ী এক একটা পা ফেলছে আর বিস্ময়ে ওদের চোখ ছানা বড়া হয়ে যাচ্ছে। প্রথমে ওরা একটা সরু ঘুপচি গলির মধ্যে দিয়ে এক পুরানো বাড়ির ভেতর গেল যেখানে দিন আর রাতের ফারাক বোঝা দায়, তার পর একটা পুরানো দিনের ভাঙা চোড়া সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠরে লাগলো, উঠেই ওদের চোখ গুলো গোল গোল হয়ে গেল, এরকম স্যাঁত স্যাঁতে ঘপচি অন্ধকার একটা বাড়ির দোতলা এক্কেবারে ওয়েল ফারনিশড ঝক ঝকে চক চকে, বাইরে থেকে বোঝার কোন উপায় নেই যে উপরের তলায় এরকম আরামে আয়েশে থাকার মত একটা ঘর ও থাকতে পারে। সেখানে দাঁড়িয়ে একটি লোক তাকে ফুটো মস্তান কানে কানে কিছু বলার সাথে সাথেই ওরা আবার চলতে শুরু করলো এবং নিয়ে গেল আরো একটা ঝক ঝকে তক তকে ঘরে,বাইরে থেকে কেউ ধরতেই পারবে না এ বাড়িটার এখানেও একটা ঘর থাকতে পারে এমন একটা জায়গায়, এরপর ওদের চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আরো একটি মানুষ যার পরনে সাদা জামা, সাদা প্যান্ট, উলটে চুল আচ্রানো একেবারে স্টাইলিশ কোন একজন ফোনে কারুর সাথে কথা বলছে। যার গলার স্বর শুনেই মহাদেশের মুখ চোখ পালটে যায়,তারপর সেই লোক্টা মহাদেশের দিকে ফিরলে দুজনেই যে যার স্থানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পরে। ওদের দুজনের মুখ দেখে নান্টু আর ফুটো মস্তান দুজনের বোঝে যে এই লোকটার সাথে মহাদেশের বাবার শুধু নামে নয় আত্মার ও মিল আছে। এই সে যাকে খুজতে ,মহাদেশের এত দিনে এত পরিশ্রম। এত দিনে মহাদেশ তার বাপ কে খুঁজে পেলেও প্রথমে বাবার বেশ ভূষা দেখে চিনতে পারে নি, তার গায়ের সেই খর্বাকার কালো রোগা চোয়ারে গালের বাবার যে এরূপ রাজকীয় পরিবর্তন হতে পারে তা ও স্বপ্নেও ভাবে নি। কাজেই কয়েক মিনিট নিজের চোখ কে বিশ্বাস হচ্ছিল না ওর, কিন্তু ধিরে ধিরে ও ওর বাবা কে চিনতে পারে, কিন্তু অদ্ভুত ভাবে মহাদেশ ওর বাবা কে ফিরে পেয়ে যতটা খুশি হয়েছিল মহাদেশের বাবা কিন্তু ততটাই মনক্ষুন্ন হয়েছিল ওখানে ওভাবে ছেলেকে দেখে। যদিও তার কারণ মহাদেশ জানে একটু পরেই যখন সে শোনে মহাদেশ এখানে তাকে গাঁয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যেতেই এসেছে, কিনতু তার বাবা আর গায়ে ফিরে জেতে চায় নি। কেন তা সত্যি মহাদেশ নিজেও জানে না, এমন কি জানে না নান্টু বা ফুটো মস্তান…

~ তার গ্রামের নামটি রঞ্জনা (Part 2)
Print Friendly, PDF & Email
Previous articleজীবনের রূপকথা
Next articleতার গ্রামের নামটি রঞ্জনা : শেষ পর্ব
PRIYAMBADA SAHA
আমি এক গৃহ বধু, বেশ কয়েক বছরের না না ছোট খাটো সাংসারিক অভিগত্যায় পরিপূর্ণ আমার এই সরল সাদা সিধা মগজ, কিন্তু এই আপাত দৃষ্টিতে দেখতে পাওয়া এক ঘেয়ে বোরিং একটা লাইফেও যে বেচে থাকার কত রসদ তা বোঝাতে এবং কিছুটা হলেও জীবনে একটু সৃজনশীল কিছুর বাতাস ভরতেই হাত পাখার কাছে হাত পাকাতে আসা... আসা করি আপনাদের সাথে আমার বেশ জমেও যাবে আলাপ্টা খুব তাড়াতাড়ি আমার লেখার মাধ্যমে... কেমন লাগলো, তা যদি দয়া করে জানান সকলে তাহলে সত্যি খুব ভালো লাগবে...
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments