পঞ্চমীর সকাল, আকাশ মোটামুটি পরিষ্কার, মাইকে ভোর ভোর মাতৃবন্দনা শুরু হয়ে গিয়েছে। মৃন্ময় সকাল সকাল উঠে সবে উঠে চায়ের পেয়ালা হাতে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, অমনি কলিংবেলের আওয়াজ-‘এত সকাল আবার কার আগমন!’। নীচে হতে মা ডাক দিলো-“ বাবা একটু নীচে আয় সুধাংশুবাবু এসেছেন”।

পাড়ার সুধাংশুবাবু অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, এখন অবসর সময়ে পত্রিকা, ম্যাগাজিন এসব প্রকাশের কাজে অনেকটা সময় কাটিয়ে থাকেন। মৃন্ময় চায়ের কাপ হাতে নীচে নেমে এল। “বসুন না, চা খেয়ে যান একটু”- হাসিমুখে বলল মৃন্ময়। “ না বাবা আমি সকালে চা খেয়েই বেড়িয়েছি, তা তুমি জানোই তো প্রতিবারের মতো এবারও আমাদের শারদীয়ার পত্রিকা বেরোচ্ছে, আর তাতে তুমি যদি একটা লেখা দিতে পারো, ওই জন্যই আসা আর কি!”- বললেন সুধাংশুবাবু।

মৃন্ময় কোলকাতায় সাংবাদিক লাইনে কাজ করে, পত্রিকাতে লেখালেখির হাতও ভালো, আর সেই সুবাদেই সুধাংশুবাবুর তার কাছে আসা।

“ হ্যাঁ, সে হয়তো দিতে পারি তবে সময় তো কম, মাত্র দিন সাতেক, তার উপরে আবার পূজার আড়ম্বরে লেখার বিষয় ভাবার সময় পাওয়াটাও মুশকিল”- একটু ইতস্তত করে বলল মৃন্ময়। কিন্তু সুধাংশুবাবুর নাছোড় মনোভাবের কাছে হার মেনে সে বলল-“ ঠিক আছে জেঠু আমি চেষ্টা করে কিছু একটা লেখা তোমার পত্রিকার জন্য বের করবই”। ভদ্রলোক আশ্বস্ত হয়ে “এখন তাহলে আসি” -বলে বেড়িয়ে গেলেন।

দুপুরের দিকে ফোন এলো বিনয়ের- “ ভাই… কাল ষষ্ঠী, আমরা দু তিনজন মিলে কোলকাতা যাব পূজা দেখতে, তুইও চল না !”।

মৃন্ময় সাধারণত পূজাতে বাড়িতেই সময় কাটায়, শেষ কোলকাতার পূজা দেখেছিলো বোধ হয় ৪-৫ বছর আগে, আসলে সারাটা বছর কম বেশি সে কোলকাতাতেই কাটায় তাই পূজাতে আর ওখানে থাকতে মন চায়না, তবুও বন্ধুদের জোরাজুরিতে হ্যাঁ করতেই হল।

পরদিন রওনা দিল তাঁরা কোলকাতার উদ্দেশ্যে। বিষ্ণুপুরে ৫ টা ৫০ এর শিরোমণি প্যাসেঞ্জার ১০ টা ১০ নাগাদ হাওড়াতে পৌঁছায়। মৃন্ময়ের সাথে তাঁর তিন বন্ধু বিনয়, সুজয় আর প্রকাশ। তাস খেলতে খেলতে আর কোথায় কোথায় ঘোরা হবে সেই পরিকল্পনায় এতক্ষণের পথ কিভাবে কেটে গেল তাঁরা বুঝতেও পারলো না। ট্রেন যথারীতি প্রায় সময়মত স্টেশনে ঢুকল। ট্রেন থেকে নামার কিছুক্ষণের মধ্যে পকেট থেকে কিছু একটা বের করতে গিয়ে খুঁজে পেলো না-“হ্যাঁ ঠিকই তো, মোবাইলটা কোথায় পড়ল- ট্রেনে কি…? না ট্রেন থেকে তো হাতে করে নিয়েই নেমেছি”- ভাবল মৃন্ময়।

বন্ধুদের ব্যাপারটা বলায় তাঁরা প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা দুই পুলিশকর্মীকে মোবাইল চুরির কথা বলল, ঠিক তখনই কোথা থেকে এক পুলিশ কনস্টেবল লাঠি হাতে বছর আটেকের মেয়েকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে এসে ওই দুই পুলিশকর্মীকে বলল-“ হাতে এতো দামী মোবাইল …, নিশ্চয় কারোর পকেট মেরেছে”। ছেঁড়া ধুলীমাখা লাল রঙের জামা পরা- উসকোখুসকো চুলের বাচ্ছা মেয়েটির কোলে একটি বাচ্ছা ছেলে, বয়স হয়তো খুববেশী হলে তিন কি চার, কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল-“ ম্যায় চোরি নেই কিয়া, ইয়ে তো পোলাটফরম মে পরা হুয়া থা স্যর…”।

“ পরা হুয়া থা…!!ইয়ার্কি ”- এই বলে কনস্টেবলটি চুলের মুঠি ধরে দিল এক চড়।

তখন পাশের পুলিশটি মৃন্ময়কে বলল-“দেখুন তো এটা আপনার মোবাইলটা নয় তো ?”।

মৃন্ময় হতবম্বো হয়ে মোবাইলটা নিয়ে বলল-“ হ্যাঁ, এটাই তো, এই দেখুন না পাসওয়ার্ড দিতেই খুলে গেল”।

পাশ থেকে সুজয় বলল-“ থ্যাঙ্ক ইউ স্যর, আপনাদের জন্যই হাওড়া স্টেশনে চোর ছ্যাঁচোড়ের সংখ্যাটা আজ বেশ কম, ভাবা যায় এইটুকু বাচ্ছারা আজ এইসব কাজে বেশি যুক্ত”। পুলিশটি আত্মসম্মানে কিছুটা সম্মানিত হয়ে কষে আরেকটি চড় লাগাল মেয়েটিকে, সাথে সাথে মেয়েটি আর কোলে থাকা বাচ্ছাটিও কেঁদে ঊঠলো একসাথে, আর একটা কথা আওড়াতে লাগলো-“ ইয়ে গিরা পরা থা, হাম চোরি নেহি কি…!”।

পুলিশটি আরেকটি চড় কষাতে যেতেই মৃন্ময় তাঁকে থামিয়ে বলল-“ স্যর মোবাইলটা তো পেয়ে গেছি তাই এদের আর মারামারি করতে হবে না, আমরা কোলকাতায় পূজা দেখতে এসেছি, এদের এখন ছেড়েই দিন”।

পুলিশটি তাঁর থামিয়ে দেওয়া চড়টি মেয়েটিকে কষিয়েই দিল, তারপর বলল-“ ভাগ শালা বদমাশ লেড়কি, ইস তল্লাট মে ফির কভি দিখা তো মারমারকে প্যাঁর তোড় দেঙ্গে”। ছাড়া পেতেই মেয়েটি বাচ্চাটিকে নিয়ে ঝড়ের বেগে অন্তর্নিহিত হল।                                                                                                                                                         বন্ধুদের পরামর্শে বাড়িতে একটা ফোন করে দামী মোবাইলটা পকেটে না রেখে ব্যাগে রাখাই শ্রেয় বলে মনে করল মৃন্ময়। বেলা প্রায় ১১ টা, অনেকটা দেরী হয়ে গেল, ঠিক হল প্রথমে কুমোরটুলির প্রতিমা দর্শন, তারপর সোজা শিয়ালদহ থেকে বালিগঞ্জ, গড়িয়ার পূজামণ্ডপ দর্শন তারপর ফেরার পথে মহম্মদআলী পার্ক সংলগ্ন প্রতিমা দেখে সোজা হাওড়ায় ৫ টা ৪৫ এর শিরোমণি ফার্স্ট প্যাসেঞ্জার ধরে ১০ টা নাগাদ বিষ্ণুপুরে পৌঁছে যাওয়া যাবে।

যেমন ভাবা তেমন কাজ, কোলকাতার পূজার আড়ম্বরতা, জাঁকজমকপূর্ণতায় আর পূজার বাঙালীয়ানা মেজাজে চার বন্ধুর মন থেকে সকালের ঘটনা অস্তমিত হল। দুপুর তখন প্রায় ২ টো ৩০, বালিগঞ্জ, গাড়িয়ার নামকরা মণ্ডপের প্রতিমা দর্শন প্রায় শেষ, কোল্ড ড্রিঙ্ক হাতে তাঁরা রাস্তার ধারের একটা দোকানের ছায়ায় বসে কিছুটা জুড়িয়ে নিচ্ছিল। আশ্বিনের রোদেও কোলকাতার মতো শহরে গরমটা বেশ ভালই বোঝা যায়।

একটা ছোট্ট বাচ্ছা মেয়ে কিছু খেলনা পুতুল নিয়ে চিৎকার করছে-“ দশ টাকা পিস দাদারা, ঘোড়া আছে, হাতি আছে… সব দশ টাকা…”। মেয়েটিকে দেখেই মৃন্ময়ের সকালে স্টেশনের মেয়েটি মনে হল, তারপর নিজের মনেই বলে উঠল-  ‘ না না, সে কি করে হয়, এমন কতো মেয়ে রয়েছে কোলকাতায়, তাছাড়া সেই বাচ্ছা ছেলেটিও তো নেই”। এমন সময় এক ভদ্রমহিলা মেয়েটির কাছ থেকে দুটি পুতুল কিনলেন আর বললেন-“ দুটোয় ষোলো টাকা দেবো…হবে ?” মেয়েটি সম্মতি জানিয়ে পুতুল দুটি তাঁকে দিয়ে টাকাটি ট্যাঁকের থলিতে রেখে একটা মিষ্টি হাসি হেসে আবার চিৎকার করতে লাগল –“ দশ টাকা পিস দাদা…, দশ টাকা…”।

মৃন্ময় যেন অস্ফুট স্বরেই বলে উঠল-“ সত্যি! এদের পূজার আনন্দ ওই পুতুলের সাজিতেই”।

কথাটা প্রকাশের কানে গেল, মেকি সুরে মৃন্ময়ের পিঠ চাপড়ে বলল-“ বাছা অতো দরদ ভালো না, এদেরই আনন্দ সকালে তোমার বিশ হাজার টাকার মোবাইল গায়েব করে দিচ্ছিল-আরেকটু হলেই”। সব বন্ধুরাই হেসে উঠল, মৃন্ময়ও একটা হাল্কা হাসি হাসলো। কোল্ডড্রিঙ্ক শেষ হলে মৃন্ময় টাকা দিতে গিয়ে দেখে পকেটে টাকা নেই -“ও তাহলে মানিব্যাগ থেকে বার করা হয়নি”- এই ভেবে সে পিঠের ব্যাগ থেকে মানিব্যাগটা বের করে টাকা মিটিয়ে কিছু টাকা পকেটে পুরে রওনা দিল সবার সাথে।

বিকেল তখন সাড়ে ৩ টে, মহম্মদআলী পার্ক সংলগ্ন চোখ জুড়ানো প্রতিমাগুলি দেখতে দেখতে পেটের টানে তাঁরা গিয়ে উঠল রাস্তার পাশের খাবারের দোকানে। খেতে খেতে মৃন্ময় দেখল এক বাচ্ছা মেয়ে সাথে এক বাচ্ছা ছেলে দোকানের বাইরে খেতে আসা লোকেদের মাঝে ভিক্ষা চাইছে।

“দেখ স্টেশনের ছেলে মেয়েটার মতো পুরো”- বন্ধুদের মাঝেই বলে উঠল মৃন্ময়। যেই বলা তেমনি বন্ধুদের মধ্যে ঠাট্টা হাসির রোল উঠল-“ আরে তুই নির্ভয়ে খা… ষ্টেশন থেকে ওরা তোর মোবাইল চুরি করতে আসেনি রে ভাই !”।  বেগতিক বুঝে মৃন্ময় চুপ মেরে গেল, আর কথা বললে এখন তাঁকে নিয়ে ভালই তামাশা চলবে।

বিকেল প্রায় সাড়ে ৪ টা, তাদের প্রতিমা দর্শন শেষ হল। কলেজস্ট্রীট থেকে বাস ধরে হাওড়া পৌঁছাতে ৫ টা ১০-১৫ বেজে গেল। ফেরার টিকিট কাটা নেই, তাই মৃন্ময় গেল টিকিট কাটতে। টাকার জন্য পকেটে হাত দিয়ে দেখল পকেট খালি-  “ না… সে তো শ চারেক টাকা খাবার সময় মানিব্যাগ থেকে ডান পকেটে রেখেছিল”- ভাবতে ভাবতে হাতটা পকেটের আর একটু ভিতরে চালনা করে দেখে, পকেটের ভেতরের কাপড়টা বেশ অনেকটাই ছেঁড়া- “ মা তো এই প্যান্ট টা সেলাইয়ের কথাই বলছিল কয়েকদিন ধরে, হ্যাঁ… এটা দিয়েই টাকাটা পড়েছে, না… শুধু কি টাকা, এটা দিয়ে তো আস্ত একটা মোবাইল ও পড়ে যেতে পারে”-

কথাটা ভাবার সাথে সাথে সকালের বাচ্ছা মেয়েটার গালে কষিয়ে পড়া চড় গুলি মৃন্ময় নিজের গালে অনুভব করল, চোখের সামনে ভেসে উঠল যেন বাচ্ছা মেয়েটির কোলে থাকা বছর চারেকের ছেলেটি তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসছে , আর বলছে-  “ বলা থা না স্যর… ম্যারা দিদি চোরি নাই কিয়া, ইয়ে প্লাটফর্ম মে পরা হুয়া থা!”। ক্ষণিকের জন্য সবকিছু পরিষ্কার হয়েও বড্ড ঝাপসা লাগল মৃন্ময়ের। ট্রেন যথাসময়ে রওনা দিল, বন্ধুরা সারাদিনের ধকলে ক্লান্ত হয়ে চোখ বুজেছে। মৃন্ময়ও চোখ মুদলো। চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল সারাদিনের দেখা সুন্দর সুন্দর দুর্গাপ্রতিমাগুলি, তবে পরনে তাদের ধূলীমাখা বেশ, হাতে অস্ত্র কিন্তু কোলে রয়েছে বছর চারেকের একটা করে ছোট্ট ছেলে।

মনে হল- সকাল সকাল সে জ্যান্ত দুর্গাকে চড় কষিয়ে সারাদিন অনেক মাটির প্রতিমা দেখে বেড়িয়েছে। “ না না তা কি করে হয়, এরা তো বস্তীতে থাকে, রাস্তার ধারেই রাত কাটায় কিন্তু আমার দুর্গা মা তো মণ্ডপে পূজা পায়”- পরক্ষণেই স্বপনের মধ্যে কার কণ্ঠ যেন বলে উঠল – “ এরাও পূজার সময় আমার মণ্ডপের সামনেই তো ঘোরাঘুরি করে রে…, তবে পূজা পাবার জন্য নয়, কিছু ভিক্ষা পাবার আশায়”।

ফিরতে প্রায় রাত ১০ টা বেজে গেল, পরেরদিন সপ্তমীর সকালে মৃন্ময়ের দেখা হল সুধাংশুবাবুর সাথে।

“ কি বাবা ! কেমন পূজা দেখলে কোলকাতায় ?” ,    “ আজ্ঞে ভালোই”-   উত্তর দিল মৃন্ময়।

“ তা তোমার লেখাটা কতদূর ?” , —   “ প্রবন্ধটার কি নাম দেবো ঠিক করে ফেলেছি, যদিও লেখাটা এখনো শুরু করিনি, তবে চিন্তা করবেননা জেঠু ঠিক সময়ে আপনাকে আমি লেখাটা দিয়ে দেবো”-  বলল মৃন্ময়। “

বাঃ তা বেশ তো, আপত্তি না থাকলে প্রবন্ধটির নামটি কি জানতে পারি ?”-জিজ্ঞাসা করল সুধাংশুবাবু।

“ জ্যান্ত দুর্গা”- আনমনা সুরে জবাব দিল মৃন্ময়।

 

~ জ্যান্ত দুর্গা ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleআবৃত্তি – মা
Next articleEVIDENCE OF 17th CENTURY– পেলিং
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments