।পাঁচ।

গৌরী একটা বড় শ্বাস ছাড়লেন, নাক দিয়ে একটা ফোঁৎ করে অনিচ্ছাকৃত আওয়াজ বার হোল। দু একবার মাথাটা নেড়ে আবার ফাইলে মন দেবার চেস্টা করলেন। আজ সকাল থেকে যা শুরু হয়েছে … সে কেয়ার সাথে ঝগড়া, মাছের বাজারে বিটকেল বলরামের জ্ঞান শোনা, ঘামতে ঘামতে রাস্তায় দশটা লোকের গালাগাল শুনে অফিসে ঢোকা, মাই গড … আর ঠিক যে সময়ে দেরি করে এসে লুকিয়ে লুকিয়ে নিজের সিটে বসে যাবেন ভাবছেন ঠিক সেই মুহুর্তে বসের সাথে চোখাচোখি হয়ে যাওয়া … এমন অকল্পনীয় বাজে দিন তো গৌরীর লাস্ট ছ মাসে এসেছে বলে মনে পড়ছে না। ছ্যাঃ … এই পঞ্চান্ন বছর বয়সে রাস্তায় লোকের বাজে কমেন্ট শোনা, অফিসে কলীগদের ঠাট্টার রসদ হওয়া … এসব একদম ভালো লাগে না। কোনদিন দুম করে না রিসাইন করে দেন এই সবই ভাবছিলেন, ঠিক এই সময় চোখের কোনা দিয়ে একটা ছায়া দেখতে পেলেন … শয়তান রমেন পোদ্দার এসে পাশে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়েছে। এক নম্বরের হারামজাদা, কাজ শুধু এর কথা ওর কানে আর ওর কথা এর কানে তোলা। এই করে অনেককে নাকাল করেছে। এর সাথে সাবধানে কথা বলতে হয়। গৌরী মুখ তুলে তাকালেন …

গৌরী। কি হে রমেন, এদিকে কি মনে করে?

রমেন। গৌরীদা, আপনি তো এই বয়সেও কামাল করে দিয়েছেন।

গৌরী। আমি আবার কি এমন করলাম হে, আমি তো চুনী গোস্বামীও নই, পি. কে. ব্যানার্জীও নই। কামালটা কি করলাম?

রমেন। উড়ি বাপরে … বসের চোখের সামনে দিয়ে এলেন কিন্তু বস একটা কথাও বললো না। মনে আছে গত পরশুর কথা, গোপাল বোধহয় আধ ঘন্টা দেরি করে এসেছিল, তাও ট্রেন লেট, তাকে কি ছ্যার ছ্যার করে শুনিয়ে দিল।

গৌরী। দাঁড়াও, দাঁড়াও … ভাই, এই তো সবে এসে বসেছি … প্রথম কাপে চুমুক মারছি, দেখ এর পরে কি হয়। একবার ডাক এলেই হোল। আরে ভাই, ঠান্ডা ঘরে তো সবাইকেই দু একবার যেতে হয়, আমাকে না হয় একটু বেশী বয়সেই যেতে হবে, তাতে আর হয়েছে-টা কি …।

অফিসের নতুন বসের ঘরে সর্বদাই ফুল এ.সি. চলে, ভেতরটা একেবারে কনকন করছে তাই ফ্লোরের ছেলে মেয়েরা মজা করে ঠান্ডা ঘর বলে, গৌরীও আজ বলে ফেললো।

রমেন কেমন যেন একটু রহস্যময় হাসলো – আরে যাবেন যাবেন … অত তাড়া কিসের। আর একদম ঘাবরাবেন না, বস একটু রাফ কিন্তু লোক ভালো।

গৌরী এবার একটু সাবধান হলো, বসের ব্যাপারে কথা, সাবধানে খেলতে হবে। চা-টা প্রায় ঠান্ডা হতে এসেছে, একটা লম্বা চুমুক মেরে আলতো করে বললেন – সে তো ভালো বটেই না হলে কি আর ঐ যায়গায় যায়। আমার থেকে কিছু না হোক বছর ছ-সাতের ছোট হবে … কিন্তু কোথায় উঠে বসেছে দ্যাখো। নিশ্চয়ই ভালো কাজের লোক।

রমেনের মুখটা দেখে মনে হোল একটু হতাশ হয়েছে, গৌরীর মুখ থেকে আজ একটু বাজী পটকা আশা করেছিলো … একে ঘামতে ঘামতে ঘরে ঢুকেছে তার ওপর বসের ঐ রাগী চোখের সামনে পরে গেছে, কিন্তু না … এই বুড়োটাকে আজ কিছুতেই রাগানো যাচ্ছে না। আর রাগানো না গেলে তো চেষ্টাটাই মাটি, লাঞ্চের সময় অল্পবয়সীদের সাথে খেতে খেতে এই সব কথা নিয়ে একটু আমোদ পাওয়া বা অন্য কারোর মাধ্যমে বসের কাছে কথাটা পৌঁছে দেওয়া যেত … তাতে আর কিছু না হোক এই বুড়োটা একটু নাস্তানাবুদ তো হোতই। যাক, বাদ দাও, এর বোধহয় রক্ত ঠান্ডা মেরে গেছে। রমেন একটু অন্য রাস্তা ধরল …

রমেন। তবে যাই বলুন গৌরীদা, ঠান্ডা ঘরের ভেতরটা ঠান্ডা কিন্তু বস রেগে গেলে কথাগুলো বেশ গুলির মতোই লাগে।

গৌরী আজকে একেবারে গাভাস্কারের মতো ঠান্ডা মাথায় আম্বানীদের ব্যাঙ্ক ব্যাল্যান্সের মতো বিশাল পেসেন্স নিয়ে খেলে যাচ্ছে। সে গম্ভীর গলায় বললো – ভাই, যে ওপরের চেয়ারে গিয়ে বসেছে তার তো যোগ্যতা আছেই। সে যে ভাবে যে পথে যেতে বলবে সেই ভাবেই তো যেতে হবে। এতে আর রাগের কি আছে।

রমেন ঘারটা ঘুরিয়ে মুখটা একটু বিকৃত করলো … যাঃ বুড়ো এটাও ডাক করে গেলো, কি ধড়িবাজ লোকরে ভাই, এতো আউট সুয়িং বল দিচ্ছি কিছুতেই বাইরের বল খেলছে না। স্লিপে লোক রাখাই বৃথা। আজ নির্ঘাত বৌদি সরষে দিয়ে ইলিশ মাছ খাইয়েছে না হলে এতো ঠান্ডা মাথা হয় কি করে। রমেনের হাতে আর একটা শেষ অস্ত্র আছে, সেটা ঝেড়ে দেখা যাক। সে গৌরীর কানের কাছে মুখ নিয়ে এলো …

রমেন। দাদা, শুনেছেন তো, সমীরের নাকি আবার প্রোমোশানের কথা হচ্ছে।

গৌরী একটু উদাস গলায় বললো – হতেই পারে। ওর হলে আর আমার কি …। ওর ফ্যামিলী একটু রুই কাতলার গাদা পেটি খেয়ে বাঁচবে … ভালোই তো।

রমেনের টেবিলের ওপর একটা ঘুষি মারতে ইচ্ছে করছে। রাগের চোটে হাতটা এমন করে নড়ছে যে গৌরীর গায়েই না ঘুষিটা লেগে যায়। একটুর জন্য খড়ের গাদায় আগুনটা লাগলো না। গাভাস্কার খোঁচা দিতে দিতে ব্যাটটা সরিয়ে নিল। কিন্তু রমেনের ধৈর্যের অভাব নেই।

রমেন। আরে দাদা, এটা কি বললেন … এই তো দু বছর আগে একটা পেল, আমাদের গ্রেডের সবার জুনিয়ার, বয়স সবার থেকে কম অথচ আমাদের ক্যাডারে ঢুকে গেল। এরপর আবার যদি হয় তো আমাদের টপকে ওপরে চলে যাবে। ওর না হয় ওপর মহলে কানেকশান আছে, কিন্তু তাই বলে অ্যাতো? আর আপনার তো বোধহয় আট কি ন-বছর একই ক্যাডারে হয়ে গেল, আর তো বছর চারেক বাদে রিটায়ারমেন্ট, খারাপ লাগছে না?

।ছয়।

গৌরী একটু নিস্তব্ধ হয়ে গেলেন … চারিদিকে ভ্যান ভ্যান করে মাছের বাজারের মতো কথার আওয়াজ, বেশ বড় এই ফ্লোরটা। পাশেই একটা পুরনো ফ্যান থেকে ক্রমান্যয়ে কেমন একটা খট খট শব্দ হয়েই চলেছে কিন্তু কথার বন্যায় তেমন শোনা যাচ্ছে না। পাশে দাঁড়ান রমেনকে উপেক্ষা করে গৌরী সামনের দিকে তাকালেন … সামনেই একটা পুরনো ব্রীটিশ আমলের বেশ ভাঙা, ঝুলে আর ধুলোয় ভর্তি একটা আলমারি যেখানে ডাঁই করে পুরনো ফাইলগুলো রাখা আছে। ঠিক তাঁর মুখের সামনেই একটা কাঁচ এখনো ভালো আর তাতে তার মুখখানা দেখা যাচ্ছে। গৌরী সেদিকেই তাকালেন। তাঁর মুখটা চাঁদের পানা তেমন কিছু নয়, কিন্তু অনেকদিন পরে রমেন তাঁর রিটায়ারমেন্টের কথা তুলতে আজ নিজের মুখের দিকেই একটু ভালোভাবে তাকালেন।

গৌরী নিজের দিকে তাকিয়ে একটু অবাকই হলেন। নিজের বাড়ীর আয়নায় রোজই চুল আচড়ান কিন্তু তাড়াহুড়োয় সেরকম নজর থাকে না, আজকে সত্যি সত্যিই নিজের দিকে ভালোভাবে তাকালেন। সামনের চুলটা প্রায় উঠে গেছে, সামান্য যা আছে তা ব্যাক ব্রাশ করার একটা ব্যার্থ প্রয়াস রয়েছে। কানের পাশে আর জুলপির চুল পেকে গেছে, গোঁফের রোঁয়াগুলোর অনেকটাই পাকা। সামনে নিচের দিকে একটা দাঁত বহুদিন আগেই গেছে, কষের একটা দাঁত হলহল করছে, যে কোন দিন মায়া কাটাতে পারে। চোখের পাশের হার বেশ উঁচু হয়ে আছে, গাল দুটো বসা। গৌরীর চোখের সামনে একজন বয়স্ক বুড়োটে লোক কেমন বিরক্ত রাগী চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। গৌরীর মনে পড়লো তাদের বেডরুমে তার নিজের বছর তিরিশের একটা ফটো আছে … হাসি খুশি একটা স্বাস্থ্যবান লোকের। জীবন থেকে কেমন হুড়ুৎ পঁচিশটা বছর বেরিয়ে গেল। গৌরী কি করবেন ভেবে না পেয়ে জিভ দিয়ে আলটাকরাটা একটু চুলকে নিলেন। রমেন উতগ্রীব চোখে গৌরীর দিকে তাকিয়ে আছে … এতক্ষণ বাদে মনে হচ্ছে ধোঁয়া উঠছে, আগুন লাগলো বলে। আনন্দের চোটে রমেন তার নাকটা একটু চুলকে নিল। গৌরী এতক্ষণ আলমারীর দিকে চেয়ে কি ভাবছিলেন, এই বার বাঁ দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে রমেনের দিকে তাকালেন। রমেন একটু সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে দেখলো গৌরীর মুখে কেমন একটা ফাজিলের হাঁসি। গৌরী তার এবরো খেবরো একটু কালচে মার্কা দাঁত বার করে হেসে বললেন …

গৌরী। ঠিকই বলেছো রমেন, আমার তো প্রায় সাড়ে আট বছর এই একই চেয়ারে হয়ে গেল। অনেক জুনিয়ারই প্রোমোশান নিয়ে আমার মাথার ওপর চলে গেছে। কিন্তু মজাটা কি জানো, সেই সব বড় বাবুরাই আবার ফাইলের বা অডিটের কিছু বুঝতে না পারলে আমার কাছে দৌড়ে আসে, দেখেছো তো? ওটাই আমার স্যাটিসফ্যাকশান, আমার কাজটা আমি ভালোই বুঝি।

এ কথা অমান্য করার উপায় নেই। অ্যাকাউন্টস বা অডিটিং-এর ব্যাপারে গৌরীদা এই ফ্লোরের সেরা। অনেক ওপর তলার বসেরা নানা ব্যাপারে গৌরীকে ডেকে পাঠায় কোন ব্যাপারে অসুবিধা হলেই। লোকটা একটু ঢিলেঢালা, সস্তার প্যান্ট সার্ট পরেই সারা জীবন কাটাল, মাঝে মাঝেই জামায় মাছের ঝোলের দাগ লেগে থাকে কিন্তু কাজের ব্যাপারে দারুণ ঝানু। শুধু কাজে পোক্তই নয়, গৌরীর সৎ হিসাবে সারা অফিসে সুনাম। রমেন বিরক্তিতে মাটিতে পা ঠুকলো, নাঃ এবারও খড়ে আগুন ধরলো না। ধুর … ধুর, যত্তসব, আজকের পুরো সকালটাই মাটি, কিছুই হলো না। “যাই গৌরীদা, একটা ফাইল আবার একটু তাড়াতাড়ি ছাড়তে হবে …” ইত্যাদি মিনমিন করে কি সব বলে রমেন কেটে পড়লো। গৌরী মনে মনে একটু মুচকি হাসলেন।

********

তারপর রোজকার মতো সেই একই ব্যাপার … ফ্লোরে কিছু লোক কাজ নিয়ে ব্যাস্ত হোল, বাকিরা কাজের ভান করতে করতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রইল। গৌরী তার ফাইল নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন, ফাইলটা প্রায় পনের দিন তার টেবিলেই পরে আছে … ভয়ানক গন্ডগোলের একটা পেনশান ফাইল। বেশ পুরনো কেস, প্রায় গোটা দশেক লোকের ব্যাপার। তারা অনেকে কেউ দশ বছর কেউ পনের কেউবা আবার আঠার বছর আগে রিটায়ার করেছে। কিন্তু নতুন পে কমিশানের নিয়ম অনুযায়ী সবারই পেনশান কিছু কিছু বারবে, সেই চেক গুলো এখন গৌরীর কাঁধে পড়েছে কারণ জটিল কেস, খুব সাবধানে ডিল করতে হবে, একবার ভুল করে অর্ডার বের হয়ে গেলে আবার কারেকশান করা খুব শক্ত।

সময় এগিয়ে চলছে, আজকেও একটা খুবই সাধারণ দিন। একটু একটু করে ঘড়ির কাঁটা দুপুর দেরটাকে স্পর্শ করে আর একটু এগিয়ে গেল। দোতলার অনেকেই উঠে অফিস ক্যান্টিনের দিকে চলে গেল … যতই কাজ থাক পেটেতো কিছু দিতেই হবে। শেষ কয়েকজন একটু গড়িমসি করছে, দু একজন তাদের বাড়ী থেকে আনা খাবার সিটে বসেই খেতে শুরু করেছে। গৌরী আসার আগে বাড়ী থেকে গত কালের মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়েই আসে, কাজেই তার বিশেষ কিছু খাবার দরকার পরে না, সে নিজের সিটে বসে একটা ফাইল টেবিলের ধারে টেনে নিয়ে চেয়ারে একটু হেলান দিয়ে নিল। এই লাঞ্চের সময় সে একটু আয়াস করে নেয়, অম্বুর সাথে তার কথাই আছে, আর একটু পরেই সে তার ফাটা কাপে আবার চা নিয়ে আসবে, সঙ্গে দুটো ব্রীটানিয়া থিন বিস্কুট, ব্লাড সুগারের ভয়ে গৌরী অন্য বিস্কুট খাওয়া ছেড়েই দিয়েছে।

এই সময়ে একটু অন্য রকম ব্যাপার ঘটলো। এই অফিসের অডিটিঙ-এর ইনচার্জ অমল ত্রিপাঠি হন্তদন্ত হয়ে এসে এই ফ্লোরের বস প্রদীপ বটব্যালের ঘরে ঢুকে গেলেন। যারা বসেছিল তারা একটু চকিত ঘাড় ঘুরিয়ে ব্যাপারটা দেখে নিল কিন্তু ততক্ষণে আবার বটব্যালের স্যুইং ডোর ঘুরে নিজের জায়গায় এসে গিয়েছে, ভিতরে কি হচ্ছে তা দেখার উপায় নেই। গৌরীও ব্যাপারটা দেখলেন … অমল তার থেকে বছর তিন চারের বড়, হয়ত আর বছর খানেকের মধ্যেই রিটায়ার করবে, আর বটব্যাল তো তার থেকে কম করে বছর ছয়েকের ছোট। কিন্তু তারা দুজনেই গৌরীর বস … গৌরী একটু নিরুৎসাহ ভরে তাকিয়ে আবার ফাইলে চোখ রাখলেন। আজকে কেন জানি বার বার সামনের ওই কাঁচটার দিকে চোখ যাচ্ছে … এটাই তাহলে মানুষের জীবন। এই তো কয়েক বছর আগে, সে কেয়াকে নিয়ে পুরী ঘুরে এলো … আনন্দে কেয়া কেমন ছেলে মানুষের মতো হয়ে গিয়েছিল, দুজনে সেই কলেজ জীবনের মতো আনন্দ করেছিল। আজ নিজের মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে বোধহয় অন্য লোক, তার মুখটাতো ঠিক এই রকম ছিল না। কিন্তু সে সব কত বছর আগের কথা? বছর পাঁচেক … নাঃ বোধহয় আরো বেশী, নির্ঘাত বছর দশেক বা তারও আগেকার …

কিন্তু তাই বলে এতো চেঞ্জ? পুরনো কলেজের বন্ধুরা তো তাকে দেখলে আজ আর চিনতেই পারবে না। যাচ্চলে, সেও তো এক বড় ফ্যাকরা, তাই না? দূর, বাদ দাও, সময় তো মানুষকে খুবলে খায়, সকলেই জানে, শুধু বোধহয় অভিনেত্রীরাই খুব একটা জানেন না। এর হাত থেকে পার নেই, গৌরী আবার ফাইলে মন দেবার চেস্টা করলেন। কিন্তু চোখটা গিয়ে পড়লো টেবিলের এক কোনে পরে থাকা একটা ঠোঙায়, কালকে বিকেলে অম্বুকে দিয়ে একটু ঝাল মুড়ি আনিয়ে খেয়েছিলেন … ফেলা হয়নি সেটাই এখনো পরে আছে। চোখ পরলো কয়েকটা বাংলা হরফের ওপর … বাংলায় আবার বিশাল ফাইনানশিয়াল স্ক্যাম, সুদিপ্ত সেন পুলিশ হেফাজতে। অনিচ্ছাভরে গৌরী ঠোঙাটা টেনে নিলেন … সামান্যই পড়া গেলো, কাগজটা তেলে মাখামাখি, তার ওপর আবার তলার দিকটা আঠা দিয়ে আটকানো। খবরগুলো অবশ্য সবারই জানা … আর এগুলো তো হয়েই থাকে। গত তিরিশ বা পঁয়ত্রিশ বছরে কবার হোল … সঞ্চয়িতা, চ্যাটার্জী পোক আরো কত, আর এখনকার এই সারদা স্ক্যাম। মানুষ বার বার ঠকে … কিন্তু গরিবী এমনই জিনিস যে আবার সেই ঠগের হাতেই নিজেকে সঁপে দেয়। এদের সাবধান করার মতো স্কীম এখনও সরকার তৈরী করে উঠতে পারেননি।

এই সব ভাবতে ভাবতে গৌরী সেই কলেজ জীবনে চলে গিয়েছিলেন। কলেজে তাঁদের স্টুডেন্ট ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ছিলো সরিৎ, সে আবার পাঁড় কমিউনিস্ট। সে অন্যান্য অনেকের সাথে গৌরীকেও নানা কথা বলতো … এই ভাবে নাকি আর চলবে না, কোন এক সময় বিপ্লব আসবে। তখন সবাই সমান হয়ে যাবে, তখন নাকি সবাই গ্রামে গিয়ে চাষ আবাদ করবে, এই রকম নাকি স্ট্যালীন সাহেব বলে গেছেন। সেই চে গুয়েভেরা, ফিডেল কাস্ত্রো, কাফকা, গোদার, মার্ক্স, এঙ্গেলস … এদের নিয়ে সেই সময়ে অনেক লড়ালড়ি হতো ইউনিয়ন রুমে। গৌরী সময় থাকলে পাশে বসে শুনতো। সব কিছু তখন বুঝতো না, কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষ ঝানু হয়। এখন গৌরী অনেক কিছুই বোঝে … সে বোঝে যে তখন যাদের সে বিরাট বিজ্ঞ্য বলে মনে করতো তারা কার্ল মার্ক্সের সেই বিখ্যাত গাবদা মার্কা “দাস ক্যাপিটাল” মোটেই পড়েনি … ছোট ছোট লক্ষ্মীর পাঁচালির মতো পাতলা চটি মার্কা মার্ক্সবাদ পড়ে আর খবরের কাগজের কাটিং পকেটে করে এনে বিশাল তর্ক করতো। আর তাও না হয় হোল, কিন্তু যেটা চোখের সামনে ঘটলো তা হোল এই ইউনিয়ান রুমের স্টার বিপ্লবিরা ডিগ্রি শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই কে কোথায় কেটে পড়লো। পরে সংবাদ এলো যে কেউ আসাম, কেউ কোচবিহারে গিয়ে নিশ্চিন্তে বিয়ে করে ভারতের নানা জায়গায় ভালো চাকরী নিয়ে আনন্দে সংসার জীবন যাপন করছে … সব কিছু তছনছ করে দেওয়া বিপ্লবের স্বপ্ন, জুট মিলের কর্মীর ওপর জুলুম বন্ধ করার সান্তনুর প্রতিজ্ঞা কখন মৃত ভ্রূণের মতো নিঃশ্বব্দে ঝড়ে গেছে তা ওরা নিজেরাও জানে না।

(To continue …)

~ খারাপ সকাল, ভালো দিন (তৃতীয় পর্ব)~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleযে পথে করে গমণ ….
Next articleOrrey Mon – Ritabhari Chakraborty & Ayushmann Khurrana
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments