তুলামারিন থেকে মায়ামি হোটেলে গমন

ফ্লাইট দেরীর কারণে ইউনিভার্সিটি থেকে কেউ আমাদের রিসিভ করতে এয়ারপোর্ট আসবে না, এটা আগেই বুঝেছিলাম। এয়ারপোর্টে কেউ না আসলে যাতে নিজেরাই ঠিকঠাক ইউনিভার্সিটি নির্ধারিত মায়ামি হোটেলে উঠতে পারি এজন্য  মেলবোর্ন শহরের ম্যাপ ঢাকা থেকে প্রিন্ট করে এনেছি। ছোট বড় উভয় ধরনের ম্যাপই সাথে রয়েছে, আর বরাবরই ম্যাপ রিডার হিসেবে আমার রয়েছে সুখ্যাতি। যারা শহর কেন্দ্রিক বিশেষ করে  ঢাকাতে বড় হয়েছে তাদের অনেকেই ঠিকমতো দিক চিনতে পারে না। এর উত্তর দক্ষিণ গুলিয়ে ফেলে। ম্যাপ পড়ার জন্য দিক চেনা একটি আবশ্যিক বিষয়।
geelong4

 

ম্যাপে এর মধ্যেই নির্দিষ্ট করে নিয়েছি ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন স্থাপনা, বিশেষ করে ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট অফিস যেখানে আমাদেরকে প্রথমেই নাম রেজিস্ট্রি করতে হবে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভবন,  স্থাপনা এবং হোটেলের অবস্থান ম্যাপে গাড় লাল কালিতে চিহ্নিত করে ফেলেছি। এয়ারপোর্ট থেকে তড়িৎ হোটেলে যাওয়ার সম্ভাব্য উত্তম উপায় কি তা জানতে ইনফরমেশন ডেস্কের শরণাপন্ন হলাম। ডেস্ক থেকে জানানো হল আমরা দু’ভাবে শহরে যেতে পারি: স্কাই-বাস অথবা ট্যাক্সি। স্কাই-বাসে একেবারে হোটেলে নামানো হবে না বিধায় আমরা ট্যাক্সি নিলাম। ট্যাক্সি সারিবদ্ধভাবে দাড়িয়ে আছে। ডাকাডাকি বা টানাটানির কোন বালাই নেই। সারির প্রথম ট্যাক্সিকেই নিতে হবে, নিজের পছন্দমতো অন্য কাউকে ডাকা যাবে না। এখানে সকল ট্যাক্সিই মিটারে চলে। এদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ট্যাক্সি নিরাপদ; আমাদের দেশের মতো এখানে ট্যাক্সিচালক (সবাই নয়, গুটিকয়েক) ছিনতাইকারীর সাথে যোগসাজশ করে না।

বাংলাদেশে বিমান বন্দরের চিত্র ভিন্ন।  বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে ট্যাক্সি পাওয়া খুব মুশকিল। সাধারণ ট্যাক্সি ড্রাইভারের বিমান বন্দরের আগমন গেটে প্রবেশের সুযোগ নেই। এ প্রসঙ্গে ১৯৯৯ সালের একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। ঐ বছর মে মাসে শেষ দিকে আমি সিঙ্গাপুর থেকে  প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফেরত আসি। বিমান বন্দরে আমাকে নেবার জন্য অফিসের গাড়ী আসার কথা থাকলেও কোন এক কারণে  গাড়ী আসতে পারিনি। অগত্যা আমাকে ট্যাক্সি ভাড়া করতে হল। সাথে বড় বড় লাগেজ। প্রথমবার বিদেশ থেকে আসার অভিজ্ঞতা বিধায় আমার জানা ছিল না বাইরে কি ধরনের ঝামেলা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। প্রথমে গেলাম ট্যাক্সি ভাড়া করতে। দেখলাম সেখানে সাধারণ কোন ট্যাক্সি বা ট্যাক্সি ড্রাইভার নেই। একটি প্রতিষ্ঠান তার একমাত্র কাউন্টার থেকে আমার মতো অনন্যোপায় যাত্রীদের ট্যাক্সি গছিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমার বাসা রামপুরায়। বিমান থেকে রামপুরার ভাড়া ধরিয়ে দেয়া হল ৫০০ টাকা; আমার বাহন অর্ধ ভগ্ন একটি কালো ট্যাক্সি। অক্সিজেন নিয়ে বেচে আছে এমন অবস্থা ঐ ট্যাক্সির। মিটারে বিমান বন্দর থেকে রামপুরায় ভাড়া বড় জোর ১০০ থেকে ১৫০ টাকা হতে পারে। অথচ আমাকে অযথাই গুনতে হল প্রায় চার গুণ ভাড়া।

 

P6160006

 

বিপত্তি শুধু এখানেই শেষ হয়নি। ট্রলি থেকে লাগেজ নামাতে গিয়ে দেখি বিশ পঁচিশ বছরের এক যুবক আমার লাগেজটি হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে। তার বদান্যতায় মুগ্ধ হলাম। ১০০ টাকার ট্যাক্সি ভাড়া ৫০০ টাকা দিতে হবে বিধায় আমার মেজাজ এমনিতে খারাপ হয়ে ছিল। এসময় এ যুবকের উপকারী মনোভাব দেখে বেশ খানিকটা স্বস্তি পেলাম। ট্যাক্সি আসার সাথে সাথেই সে লাগেজটি ট্যাক্সির পিছনে তুলে দিলো। আমি তাকে ধন্যবাদ দিয়ে ট্যাক্সিতে উঠতে বকশিশ দাবী করলো। আমি তাকে জানালাম আমার কাছে কোন টাকা নেই। সে উত্তরে জানালো ডলার বা রিঙ্গিত হলেও চলবে। আমার তার সাহায্য বা সার্ভিস চাইনি। সে নিজ থেকে উপকার করেছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে জোর জবরদস্তি করে টাকা নিবে। শেষ শেষ নিজের মান সম্মানের কথা চিন্তা করে জলদি বাসায় তাগিদে ৫ সিঙ্গাপুর ডলার হাতে দিয়ে নিস্তার পেলাম। লাগেজ গাড়ীতে তোলার জন্য বকশিশ বাবদ গেল আরও ২০০ টাকা।

মেজাজ তিরিক্ষি থাকা সত্ত্বেও ট্যাক্সিতে উঠে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য ড্রাইভারের সাথে দু’চারটি কথা বলা শুরু করলাম। কথাবার্তা বলার এক পর্যায়ে সে আমার কাছে আরও ভাড়া দাবী করলো। তার আবদার সে দীর্ঘ দু’দিন পরে একটি ভাড়া ধরেছে। আর ঐ ৫০০ টাকার ২০০ টাকা কাউন্টারের লোকজন কমিশন হিসেবে রেখে দিয়েছে। আমি জানতে চাইলাম কাউন্টার ছাড়া ওরা ট্যাক্সি চালাতে পারে কিনা। জবাবে যা জানলাম তাহলো ঐ কাউন্টার একজন প্রভাবশালী লোক নিয়ন্ত্রণ করে এবং তার অবাধ্য হওয়ার কোন সুযোগ নেই। সঙ্গত কারণেই  আমি বাসায় এসে বাড়তি এক পয়সা পাবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়ে ড্রাইভার বিদায় দিলাম।

অবশ্য এখন আমাদের বিমান বন্দরের এ অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। দীর্ঘ বিমান ভ্রমণের পর একজন যাত্রীর দেশের মাটিতে পা দিয়েই এ ধরনের ঝামেলার মুখোমুখি হওয়াটা নিশ্চয় কারো কাম্য নয়। খুব সামান্য একটা ব্যাপার এটি; কর্তৃপক্ষের নির্লোভ উদ্যোগই সাধারণ যাত্রীদের জন্য ভীষণ উপকারে আসতে পারে। এছাড়া দেশের ভাবমূর্তিও বাড়ে এ ধরনের ঝুট ঝামেলা থেকে এয়ারপোর্ট মুক্ত রাখতে পারলে। বিদেশী নাগরিক বা পর্যটকরা যদি এরকম হয়রানির শিকার হয়, তাদের লাগেজ নিয়ে টানাটানি হয়, তাহলে তা দেশের মান সম্মানের জন্য লাভজনক কিছু বয়ে আনে না। দু’চার লোকের হীন স্বার্থ বা উচ্চাভিলাষের কারণে হাজার হাজার লোক ভুক্তভোগী ও  হয়রানির শিকার হোন যা আমরা সহজেই পরিহার করতে পারি।

মেলবোর্নের তুলামারিন বিমান বন্দরে এমন কিছু ঘটলো না, বা ঘটার কথাও নয়। আমরা নিয়মমাফিক সারির প্রথম ট্যাক্সিতে উঠে পড়লাম, ড্রাইভার নিজেই গাড়ীতে আমাদের লাগেজগুলো তুলে নিলো। ক্যাবে উঠেই আলাপ শুরু করলাম, জানলাম মেলবোর্নের এ ট্যাক্সি ড্রাইভার ভারতের গুজরাট প্রদেশের বাসিন্দা, নাম নীরব। ট্যাক্সিতে লাগেজ তুলতে তুলতেই তিনি আমাদের নিজ দেশের নাম জানার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। লাগেজ উঠাতে আমরাও হাত লাগালাম।

ট্যাক্সিতে বসে মেলবোর্নের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তার সাথে খোলামেলা আলাপ শুর হল। ড্রাইভারের নাম নীরব হলেও আসলে সে কথা বলার বিষয়ে বেশ সরব। ট্যাক্সির জানালা দিয়ে মেলবোর্নের দৃশ্য দেখতে লাগলাম। আশে পাশে ফাঁকা। ছোট খাট দু’চারটি ভবন ছাড়া আর কিছুই নজরে আসছে না। তবে সামনে বেশ দূরে দেখা গেল কতকগুলো উঁচু ভবন সগর্বে দাড়িয়ে আছে। এর মধ্যে আবার সবার সেরা হচ্ছে ইউরেকা টাওয়ার। পরে জানতে পারলাম এটি পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধের সবচেয়ে উঁচু আবাসিক ভবন। এর উপরে উঠতে গেলে ১৪ ডলার ব্যয় করতে হবে।

উঁচু ভবনগুলো যে এলাকায় অবস্থিত সেটি সিবিডি বা সেন্ট্রাল বিজনেস ডিসট্রিক্ট নামে পরিচিত, বলতে পারেন এটি আমাদের মতিঝিলের মতো একটি ব্যস্ত আর গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। এই সিবিডিতেই মেলবোর্নের সব বড় বড় স্থাপনা বা ভবনগুলোর অবস্থান। ট্যাক্সিতে মেলবোর্নে অভিবাসীদের সার্বিক হাল-হকিকত নিয়ে নীরব বাবুর সাথে বেশ আলাপ হল।  তিনি বলতে দ্বিধা করলেন না যে আইটি গ্রাজুয়েট হয়ে এখন নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই ট্যাক্সি চালাচ্ছেন। ট্যাক্সিতে আয় রোজগার বেশ ভাল হলেও তার মনে যে প্রশান্তি নেই সেটা বেশ বুঝা গেল। আলাপ করতে করতে আমরা সিবিডিতে চলে এসেছি। মায়ামি হোটেলের অবস্থান নিশ্চিত  হওয়ার জন্য তিনি মেলবোর্ন শহরের ম্যাপ (যা মেলওয়ে নামে পরিচিত) পরীক্ষা করে নিলেন।

 

হোটেল রিসিপশনে যখন এসে পৌঁছলাম তখন ৯ জানুয়ারির সকাল সাড়ে ন’টা। পঞ্চাশ ডলারের একটি নোট নীরব বাবুর হাতে ধরিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে তাকে বিদায় করলাম। হোটেলের অবস্থান সিবিডি’র পাশে প্রসিদ্ধ ভিক্টোরিয়া স্ট্রিটে হলেও এটি বেশ নিরিবিলি জায়গা। এখানে অবস্থানের জন্য প্রতিদিন আমাদেরকে চোখ বুজে ৭৭ ডলার গুনতে হবে। ভাড়া অনুযায়ী হোটেলের সুযোগ সুবিধা একেবারেই অপ্রতুল বলতে হবে। প্রথম হোঁচট খেলাম লাগেজ তুলতে গিয়ে। দোতলা হোটেলের দ্বিতীয় তলায় আমাদের ডাবল বেডের একটি কক্ষ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ছোট বড় মিলে দু’জনের ৫টি লাগেজ। ধারণা ছিল লিফটে বা এলিভেটরে লাগেজ নিয়ে উপরে যাব। রিসিপশনে লিফটের অবস্থান জানতে চাইলে বেশ বিনয়ের সাথে জানানো হলে এখানে কোন লিফট নেই, সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে যেতে হবে। আশে পাশে তাকিয়ে দেখলাম আমাদের সাহায্য করার মতোও বয় বেয়ারা কেউ নেই। অস্ট্রেলিয়ার সেল্প হেল্প নামক ডকট্রিন প্রাকটিস এখান থেকেই শুরু হয়ে গেল।

 

দ্বিতীয় হোঁচট খেলাম রুমের ঢোকার পর। রুমের সাইজ দেখে চোখ ছানাবড়া আমাদের। একে-তো গত তিন দিন আছি দৌড়ের উপর, তারপর এসে দেখলাম কবুতরের খোপের মতো একেবারেই সীমিত জায়গার হোটেল রুম। মেজাজ ঠিক রাখা কঠিন হয়ে গেল। রুমগুলো আকারে কবুতরের খোপ অথচ নাম মায়ামি। এটি মিসনোমার বা রসিকতা ছাড়া আর কিছু না। আর অবাক হয়ে দেখলাম রুমে এসি নেই। মেলবোর্নে জানুয়ারি মাসের তাপ-দাহে এক সেকেন্ডও থাকা যায় না। পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রী তাপমাত্রায় চামড়া সিদ্ধ হয়ে যাবার উপক্রম। আমি যাত্রার সময় মোটাসোটা জ্যাকেট পরে বাসা থেকে বের হয়েছিলাম। আমার একেবারেই মনে ছিল না আমাদের দেশের শীতকাল মানে অস্ট্রেলিয়ার গ্রীষ্মকাল। আমরা বিপরীত মেরুর দুই দেশ।

গরম থেকে পরিত্রাণ পেতে রুমে কেবলমাত্র  একটি ছোট আকারের টেবিল ফ্যান রাখা আছে। দু’জন বাসিন্দার জন্য  কোন রকমের মিনি সাইজের দুটো খাট দু’পাশে রাখা হয়েছে। মনে হল কিন্ডারগার্টেনের শিশুদের হোস্টেল রুম। রুমের মাঝখান দিয়ে একজন কোন রকম হাঁটতে পারে। ঢাকার সেরিনার সাথে তুলনায় করলে এটাকে বস্তি বলা যেতে পারে। অথচ ভাড়া একেবারেই কম নয়।

 

একটি টেবিল ফ্যান যে দুজনের গরম থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য পর্যাপ্ত নয় তা সাথে সাথে টের পেলাম। ঐ মুহূর্তে হোটেলের সীমাবদ্ধতার কথা ভুলে থাকতে বাধ্য হলাম। মনে মনে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারের কর্ত্রী লুসিয়ার চৌদ্দ-গুষ্ঠি উদ্ধার করলাম একটা বাজে হোটেল আমাদের জন্য বুকিং করার জন্য। ভাবলাম কোন এক সময় লুসিয়ার কাছে প্রসঙ্গটি তুলবো এবং ব্যাখ্যা চাইবো।

 

মাথায় যে চিন্তাটি ঐ সময় ঘুরপাক খাচ্ছিল তাহলো দ্রুত ইউনিভার্সিটি গিয়ে বেশ কতকগুলো ফর্মালিটি সম্পন্ন করা। পথে আমরা ইতোমধ্যেই এক দিন বেশি কাটিয়ে এসেছি। সুতরাং হোটেলে বসে সময় কাটানোর অবকাশ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে অন্যতম একটি বড় কাজ হল ব্যাঙ্ক একাউন্ট খোলা। মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল অফিস আমাদের দেখাশুনার দায়িত্বপ্রাপ্ত। এ অফিসের লুসিয়া ওং এবং এমি কং আমাদের কন্টাক্ট পারসন। ওং আর কং গং খুঁজে বের করে পরবর্তী কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। সেশন শুরু হওয়ার আগে অনেকগুলো বিষয় নিষ্পন্ন করার তাগিদ রয়েছে। লুসিয়া ওং ব্যাংক একাউন্ট খোলাসহ অন্যান্য কাজে আমাদের গাইড করবেন। এছাড়া মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো সময়ই ওং এবং কং এর শরণাপন্ন হতে হবে যে কোন বিষয়ে সুরাহা বা সমাধান পাওয়ার জন্য।

 

দীর্ঘ ভ্রমণ এবং মানসিক ক্লান্তি কাটানোর জন্য রুমে লাগেজ রাখার পর পরই দ্রুত শাওয়ার নেবার চিন্তা করলাম। হোটেলে এটাচড বাথরুম নেই। হোটেলের একদিকে কমন টয়লেট, যদিও পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে। তবে হোটেলের অন্যদিক যে গোসলের ব্যবস্থা রয়েছে তা নারী পুরুষ নির্বিশেষ সকলের জন্যই। মনে হল এখানে জেন্ডার ইকুইটি তৈরি করা হয়েছে। প্রথমদিকে বিষয়টি আমার কাছে বিব্রতকর মনে হলেও কয়েকদিন পর সয়ে গিয়েছিল। মায়ামি হোটেলে আমাদের মতো বিভিন্ন দেশ থেকে আরও বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী উঠেছিল। এদের সিংহভাগই মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী। হোটেলে অবস্থানকারী এদের অনেকেই আবার পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ ভাল বন্ধু হিসেবে পাই। এদের মধ্যে ফিজির লাভেনিয়া এবং পাপুয়া নিউগিনির  ডেইজি অন্যতম।

 

মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম দিন

 

আমরা দু’জনে ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই ইউনিভার্সিটি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলাম। পণ করলাম হোটেল থেকে পায়ে হেঁটে ইউনিভার্সিটি যাবো। পথ চেনার জন্য সাথে ম্যাপ নিয়ে নিলাম। হোটেল রিসিপশন ইউনিভার্সিটি যাওয়ার বিভিন্ন রাস্তা আমাদেরকে বলে দিলো। ট্রামে যেতে লাগবে পনের মিনিট, আর হেঁটে গেলে বিশ মিনিট। তবে সরাসরি ট্রাম নেই বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য, ভিক্টোরিয়া মার্কেটে নেমে সিটি থেকে আগত ট্রামে আবার উঠতে হবে এবং সে ট্রামটি পৌঁছে দিবে মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ট্রাম বদলানোর ঝামেলাতে আমরা গেলাম না। ম্যাপ হাতে নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। ক্ষুধার তাড়না থাকলেও হোটেলে খাবার এর জন্য অপেক্ষা করলাম না। ইউনিভার্সিটির ক্যাফেতে গিয়ে নাস্তা করতে হবে এটি আমাদের সিদ্ধান্ত। অপরদিকে বিমানে দু’জনের কারোই ভাল ঘুম হয়নি। তবে ঐ সময়ে হোটেলে হারাম করে ঘুমানোর অবকাশ নেই। রাস্তা পথেই দু’দিন অতিরিক্ত কাটিয়ে ফেলেছি। তাই ইউনিভার্সিটিতে রিপোর্ট করাই এখন প্রথম এবং প্রধান কাজ। ঐ মুহূর্তে হাজারো অসুবিধা থাকলে তা আমলে নিলাম না।

 

ম্যাপ ধরে হাটতে হাটতে পনের বিশ মিনিটের মধ্যেই ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে পৌঁছে গেলাম। রিসিপশনে আমাদের আগমনের কথা জানানো হলে সেন্টারের পরিচালক লুসিয়া এসে নিজেই স্বাগত জানালেন এবং আমাদের পরবর্তী পর্যায়ে কি কি করণীয় সে বিষয়ে একটি ব্রিফিং দিলেন। পরিচয়ে জানা গেলে লুসিয়ার অরিজিন হচ্ছে হংকং। তবে দীর্ঘদিন অস্ট্রেলিয়াতে বসবাস করলেও ইংরেজি উচ্চারণে তেমন উন্নতি হয়নি। ইংলিশের পরিবর্তী তার উচ্চারণ চেংলিশ অর্থাৎ ইংরেজি এবং চাইনিজের জগাখিচুড়ি বললেও অত্যুক্তি হবে না। মেলবোর্নে বসবাস শুরুর করার জন্য লুসিয়া আমাদের প্রত্যেককে পাঁচ হাজার ডলারের অর্থাৎ বাংলাদেশের মুদ্রায় প্রায় তিন লক্ষ টাকার একটি চেক ধরিয়ে দিলেন। আমরা ব্যাংকে গিয়ে পাসপোর্ট দেখিয়ে মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে একাউন্ট খুলে ফেললাম। এজন্য কোন ফরম পূরণ করতে হয়নি বা কারও সুপারিশের প্রয়োজনও হল না। আমাদের দেশে এখনও মনে হয় এত সহজে ব্যাংক একাউন্ট খোলা যাবে না।

মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে অস্ট্রেলিয়ার প্রধান দুটো ব্যাংক কমনওয়েলথ ব্যাংক এবং ন্যাশনাল অস্ট্রেলিয়ান ব্যাংক বা ন্যাব এর শাখা রয়েছে। আমরা দু’জনেই কমনওয়েলথ ব্যাংকে একাউন্ট খুললাম। কোন ব্যাংকে কোন সুবিধা বা অসুবিধা রয়েছে তা নিয়ে মাথা ঘামালাম না। সামনে কমনওয়েলথ ব্যাংক পড়ায় ঐ ব্যাংকটিই বেছে নিলাম। আমরা যে একাউন্ট করলাম সেটি স্ট্রিম লাইন একাউন্ট নামে পরিচিত। এ একাউন্টের সুবিধা হল আমরা ইন্টারন্যাশনাল ছাত্র বিধায় আমাদের কোন প্রকার ফি বা চার্জ ব্যাংককে দিতে হবে না। যতদিন ছাত্র আছি তত দিনই ফ্রি একাউন্ট চালানোর সুবিধা পেয়ে গেলাম।

আমি মেলবোর্নে যে সকল পাবলিক সার্ভিসের স্বাদ উপভোগ করেছি তার মধ্যে ব্যাংকিং সার্ভিস সত্যিই অনন্য। সব কিছুই কম্পিউটারের মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছে। লাইনে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকার কোন বালাই নেই। ফ্রি ডেবিট কার্ডের সাহায্যে শহরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাজারো এটিএম থেকে যে কোন সময়ে টাকা তোলা যাচ্ছে কিংবা দোকানে কেনা কাটা করে দাম পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে।

 

তবে সমস্যা হচ্ছে ডেবিট কার্ড পেতে হলে বাসার ঠিকানা থাকতে হয়। ঐ সময় আমাদের বাসা না থাকায় ডেবিট কার্ড পেতে সময় লেগেছিল। একাউন্ট খুলে চেক জমা দিয়ে আমরা ইউনিয়ন হাউজে নাস্তা খেতে হাজির হলাম, যদিও এরই মধ্যে দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেছে। ইউনিয়ন হাউজ বিশাল আকৃতির। এখানে মিছিল মিটিং নেই। নেই কোন দেওয়াল লিখন। কারো হাতে ছোরা কাঁচি বা পিস্তল নেই। সব কিছুই ভীষণ পরিচ্ছন্ন। সত্যিকার অর্থে প্রথম দিনেই ক্যাম্পাস আমাদের ভীষণ পছন্দ হয়ে গেল, ক্যাম্পাসের প্রেমে পড়ার মতো একটি বিষয়।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ আট বছর লেখাপড়া করলেও মধুর ক্যান্টিনে গিয়েছি সাকুল্যে মাত্র একবার, একটি সন্দেশ খেয়ে চলে এসেছি। ডাকসুর ক্যান্টিনে কখনও যাওয়া যায়নি। বলতেও পারবো না এর অবস্থান কোথায়। আমার কলা ভবনে বন্ধুরা এ নিয়ে অনেক সময় রসিকতা করে থাকে। সায়েন্স ফ্যাকাল্টির ছাত্র হিসেবে আমরা ক্যাম্পাস বলতে বুঝতাম কার্জন হল আর সায়েন্স এনেক্স ভবনকে। রেজিস্টার ভবনে গিয়েছি এক বা দু’বার, শুধু সনদ তোলার জন্য।

 

আমরা লক্ষ্য করলাম ইউনিয়ন হাউজে রয়েছে ছোট বড় বিভিন্ন আকারের পনের বিশটি খাবারের দোকান। এখানে চিকেন কারী থেকে শুরু করে টার্কিশ কাবাব, কফি, পিজ্জা, ইটালিয়ান পাস্তা সব কিছুই পাওয়া যায়। তখন সেমিস্টার অর্থাৎ ক্লাস চালু না থাকা সত্ত্বেও নতুন ইন্টারন্যাশনাল ছাত্র-ছাত্রীদের আনাগোনার কারণে ইউনিয়ন হাউস বেশ সরগরম। আমরা কাবাব রুটি দিয়ে প্রথম দিনে ক্যাম্পাসে নাস্তা কাম লাঞ্চ সেরে নিয়ে একটি লম্বা ঘুম দেয়ার জন্য হেঁটেই ভিক্টোরিয়া স্ট্রিট ধরে আবার হোটেলের দিকে রওনা দিলাম। আমরা যখন হাঁটছি তখন সূর্য বেশ তেজি। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থাপনা ঘুরে দেখার আনন্দে জানুয়ারি মাসের তীব্র রোদে ম্লান হয়ে গেছে। আমরা বিস্ময় ভরে দেখলাম রাস্তা ঘাট ছবির মতো পরিচ্ছন্ন, সব কিছু চলছে নিয়ম মতো। কোথাও নিয়মের ব্যত্যয় নেই। এ যেন আমাদের কাছে এক ভিন গ্রহ।

 

হোটেলে এসে আর বিলম্ব না করে ঘুমিয়ে গেলাম। দু’রাত না ঘুমানোর ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হবে। চোখ ভর করে রাজ্যির ঘুম এসে হাজির হল। হোটেল রুমের নানা সীমাবদ্ধতা আমাদের ঘুমের কাছে হার মানলেও।ঘুম যখন ভাঙ্গল তখন রাত ৯টা পার হয়ে গেছে। প্রায় ৫ ঘণ্টার মতো ঘুমিয়েছি। মারুফ তখনও ঘুমে। দীর্ঘ  ঘুমের পরও ক্লান্তি যায়নি; মনে হল পৃথিবীর সমস্ত ক্লান্তি যেন আমার উপর ভর করেছে। জানালা দিকে বাইরে তাকিয়ে দেখি তখন সূর্যের আলো পশ্চিম আকাশে দেখা যাচ্ছে। ডিসেম্বর জানুয়ারি মাসে মেলবোর্নে সূর্য সাড়ে নটা’র পর অস্ত যায়। রাতে কিছু খেতে হবে এটা চিন্তা করে মারুফকে ডাকতে হল।

 

মেলবোর্নে আমরা দু’জনেই নতুন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেয়া হাতে কড় কড়ে ডলার, তাই ভাল একটা ডিনার করতে বাঁধা নেই। তবে কোথায় কি ধরনের খাবার পাওয়া যাবে সে ব্যাপারে কোন ধারণা নেওয়া কঠিন হল। খাবারের রেষ্টুরান্ট খোঁজার পাশাপাশি আমাদের মোবাইল ফোনের সিম কার্ড কিনতে হবে। নিরাপদে সলি সালামতে মেলবোর্নে পৌঁছিয়েছি এটা দেশে জানানো প্রয়োজন। এছাড়া দেশের সাথে জরুরি যোগাযোগের জন্য একটা অস্ট্রেলিয়ান সিম একান্তই সাথে থাকতে হবে। দেশ থেকে আসার সময় নতুন কেনা নকিয়া সেটতো সাথেই আছে, শুধু সিম কার্ড হলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। একই সাথে আমাদের ফোন কার্ড কিনতে হবে সস্তায় ফোন বুথ থেকে দেশে ফোন করার জন্য। কিন্তু সিম কার্ড বা ফোন কার্ড কেনার আগে একটি রেষ্টুরান্ট খুঁজে বের করাই প্রধান এজেন্ডা হয়ে দাঁড়ালো ঐ মুহূর্তে।

 

আশে পাশে খোঁজ নিয়ে দেখি রাত সাড়ে ন’টায় সূর্য আলো ছড়ানো বন্ধ না করলেও রেষ্টুরান্ট এবং দোকানপাটের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। প্রায় আধাঘণ্টা খোঁজাখুঁজির পরও কোন রেষ্টুরান্ট পাওয়া গেল না। রাতে না খেয়ে থাকতে হবে এমনটি ধরে নিলাম। তবে আমাদের বেশিক্ষণ দুশ্চিন্তায় থাকতে হল না। এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে এক পর্যায়ে ৭/১১ নামক একটি  দোকানের সন্ধান পেলাম। দোকানটি আমাদের হোটেল থেকে ২০০ মিটার দক্ষিণে। ৭/১১ দোকানের এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এটি সকল দিন সকল সময় খোলা থাকে। দোকান পাওয়া গেলেও সুবিধাজনক কোন খাবারের আইটেম পাওয়া গেল না। পাওয়া গেল একটি মাত্র ভেজিট্যাবল স্যান্ডউইচ, তাও আবার দু’জনের জন্য। আরেকটি পরে দোকানটিতে আসলে হয়তো এটিও পাওয়া যেত না। দোকানে আরও যে স্যান্ডউইচ বা বার্গার পাওয়া গেল তাতে পর্ক এর উপাদান থাকায় কেনা সম্ভব হল না। শেষ পর্যন্ত একটি স্যান্ডউইচ এবং এক বোতল অরেঞ্জ জুস নিয়ে হোটেলে ফিরে আসলাম এবং তা দিয়েই ডিনার শুরু করলাম। পরে জানলাম আমাদের হোটেলের ঠিক উত্তর দিকেই মাত্র ১০০ মিটারের মধ্যেই ম্যাগডোনালস ও কেএফসি’র আউটলেট রয়েছে। কারো কাছ থেকে ঠিকমতো ইনফরমেশন না পাওয়াতেই মেলবোর্নের প্রথম রাতটি আমাদের অর্ধাহারে থাকতে হল।

 

পর দিন থেকেই আমাদের আইএপি বা ইন্ট্রোডাক্টরি একাডেমিক প্রোগ্রাম শুরু হবে। নয়’টার মধ্যে ক্লাসে যেতে হবে, এটা ভেবে আবার ঘুমানোর উদ্যোগ নিলাম। রুমে টেলিভিশন নেই বিধায় সময় কাটানোর অন্য কোন উপায় ছিল না। সিম বা ফোন কার্ড কিনতে না পারায় হোটেলের রুম থেকেই দু’জনেই সংক্ষিপ্ততম দুটো ফোন করলাম দেশে এবং আমাদের কুশলাদি জানালাম। ফোন না করে জানালে আত্মীয় স্বজনের টেনশন বহুগুণে বেড়ে যাবে এটা ভেবে দেশে কথা বলার কাজটি সেরে নিলাম। তবে একটিমাত্র স্যান্ডউইচ দু’জনে ভাগাভাগি করে খাওয়ার বিষয়টি চেপে গেলাম।

 

আগের দিনে সব মিলে আট-দশ কিলোমিটার হেটে দুজনেরই পায়ের অবস্থা বেশ বেহাল। হেঁটে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার পরিকল্পনা বাদ দিলাম। কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া যাবে এটা চিন্তা করতে করতেই হোটেল রিসিপশনে পরিচয় হল ফিজি’র লাভেনিয়া এবং পাপুয়া নিউগিনির ডেইজীর সাথে। ওদের পরামর্শ অনুযায়ী ট্রামের একটি ডে-লং টিকেট কিনলাম।অস্ট্রেলিয়ার প্রতিবেশী দেশের এ দু’জন শিক্ষার্থী এর আগে বেশ কয়েকবার মেলবোর্ন ঘুরে গেছে বিধায় মেলবোর্ন সম্পর্কে এদের বেশ পরিষ্কার ধারণা রয়েছে। ওদের কাছ থেকেই জানলাম মেলবোর্নে যোগাযোগ নেটওয়ার্ক বেশ উন্নতমানের। সকল শহর এবং উপ-শহর ট্রাম, বাস এবং ট্রেন নেটওয়ার্ক দ্বারা যুক্ত। মেলবোর্নে ঘুরে বেড়ানোর বড় সুবিধা হচ্ছে একটি মাত্র টিকেট কেটে তা বাস, ট্রাম এবং ট্রেনে ব্যবহার করা যায়। ট্রামে হোটেল থেকে ইউনিভার্সিটি যেতে মিনিট বিশেক সময় লাগলো। যথারীতি ইউনিভার্সিটি ক্যাফেতে গিয়েই নাস্তা সম্পন্ন করে সকালের ক্লাসে যোগ দিলাম।

 

প্রথমদিক মায়ামি হোটেল যাচ্ছেতাই মনে হলেও দু’এক দিন পর অনেকটা সয়ে গেল। তার কারণ হল আপাতত: বসবাসের আর কোন জায়গা নেই। বাসা যতদিন না পাই ততদিন এখানেই থাকতে হবে। আমাদের সাথে যোগ হল মাসুম। প্রথম দিনে কোন এক পরিচিত জনের বাসায় উঠলেও পরদিন সকালে সে হোটেলে এসে হাজির হল।

 

হোটেলের অবস্থানটি মূল সিটি বা সিবিডি’র খুব কাছাকাছি হলেও সন্ধ্যার পর আশ পাশ একেবারে নিঝুম হয়ে যায়। ছোট টিলার ঠিক উপরেই হোটেলের অবস্থান। এর চারপাশে যে দিকেই হাঁটা শুরু করবেন মনে হবে পাহাড় থেকে নামছেন। দক্ষিণে কিছুটা গেলেই পাওয়া যাবে ফিলিপ বে বা মেলবোর্ন ডক-ইয়ার্ড। এ ডকইয়ার্ডেই প্রথমে ব্রিটিশ শাসকেরা ভিক্টোরিয়া অঞ্চলে তাদের কলোনির গোড়াপত্তন করে ১৮১৪ সালের দিকে। প্রথমে তারা  স্থানীয় আদিবাসীদের কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে ৩ লক্ষ একর জমি কিনে মেলবোর্ন শহরটি গড়ে তুলে। এ জায়গাটি  বেছে নেবার অন্যতম কারণ হচ্ছে ইয়ারা নদীর মিঠা পানি। যে কোন শহরের গোড়াপত্তনে সুপেয় পানির উৎসটি সর্বাগ্রে বিবেচনা করা হতো ।

 

হোটেলের ঠিক উত্তর দিকে ভিক্টোরিয়া স্ট্রিটে আমরা দ্বিতীয় দিনেই একটি পাবলিক ফোন বুথ আবিষ্কার করে ফেলি। সারাদিন ব্যস্ততার পর সন্ধ্যার দিকে ঐ ফোনবুথ থেকে কার্ড ফোনের সাহায্যে দেশে স্ত্রী পরিজনের সাথে কথা বলতাম। হোটেলের সাথে লাগোয়া পার্কটি হয়ে উঠলো আমাদের অবসর কাটানোর একটি বড় মাধ্যম।  এ সময়ে আমাদের একদিকে যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রারম্ভিক ক্লাস বা আইএপি সামাল দিতে হতো, অন্যদিকে ক্লাসের অবসরে বাসা খুঁজতে হতো। একই সাথে আমরা মেলবোর্ন শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ঘুরে দেখার কাজটি বিপুল আনন্দে করতাম।

 

আইএপি এবং বাসার অন্বেষণ

 

আইএপি বা ইন্ট্রোডাক্টরি একাডেমিক প্রোগ্রামের ব্যাপ্তি ছিল সকাল ৯ টা থেকে টানা বিকেল ৫ টা পর্যন্ত। মাঝখানে এক ঘণ্টার দুপুরের খাবারের বিরতি। আইএপি’র মাধ্যমে আমাদের একটি ধারণা দেওয়া হয় কিভাবে মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির লেখাপড়ার সাথে নিজেদেরকে মানিয়ে নিতে হবে। মূল সেমিস্টারের একটি ডামি ভার্সন বা রিহার্সাল বলা যেতে পারে আইএপিকে। স্কলারশিপের শর্তানুযায়ী আইএপিতে ঠিকঠাক মতো পাশ করতে হবে, নইলে হাতে দেশে যাওয়ার রিটার্ন টিকেট ধরিয়ে দেয়া হবে। সুতরাং বহুকষ্টে পাওয়া স্কলারশিপ টিকেয়ে রাখা এবং একই সাথে নিজের ও  দেশের সম্মানের স্বার্থেই আইএপিকে বেশ গুরুত্বের সাথে নিতে হল।

 

আইএপির’র গুরু অর্থাৎ কো-অর্ডিনেটর হচ্ছে প্রফেসর পল গ্রুভার। পল যুক্তরাষ্ট্রের এলাবামা অঙ্গরাজ্যের মুল বাসিন্দা হলেও তিনি এখন মেলবোর্নে স্থায়ী, অস্ট্রেলিয়ান স্ত্রীর সুবাদে। প্রথম দিনেই গ্রুভার নিজের পরিচয় বেশ খোলাসা করেই বর্ণনা করলেন। বারো ক্লাস পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে না গিয়ে শুরু করলেন নিজ শহরে মাছের ব্যবসা। নিজের অতীত বর্ণনা করতে কখনও তাকে আমি সংকোচ করতে দেখিনি। ছোট খাট গড়নের এ অধ্যাপকের চমৎকার পড়ানোর কৌশলের পাশাপাশি রয়েছে অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। মাত্র দু’এক দিনের মধ্যেই প্রায় সকলেরই প্রিয়পাত্র বনে গেলেন প্রফেসর পল। অস্ট্রেলিয়ানরা নিজের প্রথম নাম ধরে ডাকতে অভ্যস্ত হলেও আমেরিকানরা সারনেম বা শেষ নামে পরিচিত হতে চান, যেমন ধরুন বুশ, ক্লিনটন বা ওবামা। সূচনা ক্লাসেই পল গ্রুভার তার এ ইচ্ছে আমাদেরকে জানিয়ে দিলেন।

 

একটি পর্যায়ে মাছের ব্যবসায় মন উঠে গেলে গ্রুভার ভর্তি হোন এলাবামা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। তখন তিনি আবিষ্কার করেন তার মধ্যে গবেষণা ও শিক্ষকতার প্রতিভা রয়েছে। শেষ পর্যন্ত ভাষাতত্বের ধ্বনিতত্ব বিষয়ে পিএইচডি করে জাপানে শিক্ষকতা শুরু করেন। জাপানে পরিচয় হয় বর্তমান স্ত্রী’র সাথে। স্ত্রীর অনুপ্রেরণাতে তিনি অস্ট্রেলিয়াতে চলে আসেন এবং মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজ শুরু করেন।

 

প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে টানা দেড় ঘণ্টা গ্রুভারের লেকচার চলতো। ক্লাসে দেরি করে আসা চলবে না-এ বিষয়ে আগেই সতর্কবাণী দেওয়াতে সবাই নির্ধারিত সময়ের আগেই ক্লাসে চলে আসতো। কোন একটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ে তিনি বক্তৃতা করতেন এবং একই সাথে চলতো পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন। অস্ট্রেলিয়ান কালচার থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষায় গবেষণা পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া তার লেকচারে স্থান পেত। আমাদের ক্লাস হতো এশিয়ান সেন্টারের আন্ডারগ্রাউন্ড লেকচার থিয়েটারে। মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শ্রেণীকক্ষই অতি সুসজ্জিত। ওভারহেড প্রজেক্টর থেকে শুরু করে ডিভিডি প্লেয়ার, টিভি সব ধরনেই ডিসপ্লে সুবিধা এখানে রয়েছে। লেকচারার তার সামনে থাকা কন্ট্রোল প্যানেল থেকে সহজেই প্রেজেন্টেশনের জন্য কম্পিউটার, ডিভিডি বা ভিডিও ক্যাসেট অপশন বেছে নিয়ে তা পর্দায় দেখাতে পারেন।

 

আইএপিতে আমরা একসাথে প্রায় দু’শ শিক্ষার্থী ক্লাস করতাম। এর মধ্যে ইন্দোনেশিয়ানরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। তালিকায় প্রায় আট দশ পাকিস্তানি শিক্ষার্থীদের নাম থাকলেও তাদের দেখা আমরা আইএপিতে পাইনি, কারণ ভিসা সংক্রান্ত ঝামেলার জন্য তারা নির্ধারিত সময়ে আমাদের সাথে যোগ দিতে পারেনি। এরা সবাই আইএপি শেষ হবার পর মেলবোর্নে আসে।

 

সুদীর্ঘ লেকচারের পরই পরই চলতো প্রশ্ন উত্তরের পালা। তবে এতে সকলেই অংশগ্রহণ করতো না। কেবলমাত্র গুটি কয়েক শিক্ষার্থী ক্লাসে প্রশ্ন করতে  স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন, অন্যরা নিশ্চুপ বসে শুনত। তবে যারা ক্লাসে কথা বলতো তাদেরকে সবাই চিনতো। সাড়ে দশটায় লেকচার শেষ হবার পর পরই আধা ঘণ্টা বিরতি। এ সময় আমাদের চা নাস্তা সরবরাহ করা হতো। সকাল এগারটা থেকে শুরু হতো টিউটোরিয়াল। একজন টিউটরের অধীনে ছিল ২৫ জন শিক্ষার্থী। লেকচারে যে বিষয়ে আলোচনা হতো তা নিয়েই টিউটোরিয়ালে বিস্তারিত পর্যালোচনা চলতো। এখানে সকলের আলোচনায় অংশগ্রহণ ছিল প্রায় বাধ্যতামূলক। টিউটররা ছিল পিএইচডি পর্যায়ের সিনিয়র ছাত্র-ছাত্রী।

 

আমাদের টিউটর ছিল আমান্দা বেলিস যাকে আমি মাঝেমধ্যে ইবলিস নামেও ডাকতাম। অনেকে আমাকে ফলো করতো। আমান্দা বেশ কঠোর টাইপের টিউটর তা প্রথম দিনেই বোঝা গেল। সিডনীর অধিবাসী আমান্দা পল গ্রুভারের অধীনেই ধ্বনিতত্ত্ব নিয়ে পিএইচডি করছে। ক্লাসের টেবিলে সাঁটানো নেম ট্যাগের কল্যাণে আমান্দা প্রথম ক্লাসেই আমাদের প্রায় সকলেরই নাম মুখস্থ করে ফেললো। তবে পুরো পঁচিশ জনের নাম মুখস্থ করতে আমার বেশ সময় লেগেছিল। সূচনা ক্লাসে আমান্দা ঠিক গ্রভারের মতোই তার নিজের এবং সংসারের খুঁটিনাটি বর্ণনা করলো। আমান্দার বর্ণনায় জানা গেল সিডনীর স্থায়ী বাসিন্দা হলেও উচ্চ শিক্ষার জন্যই সে মেলবোর্নে বসবাস করছে। প্রথম স্বামীর সাথে ডিভোর্স হবার পর সে একমাত্র মেয়েকে নিয়েই মেলবোর্ন আছে। তার পারিবারিক আলোচনা এতই ব্যাপক ছিল যে বিভিন্ন প্রসঙ্গে তার উনিশ বছরের মেয়ের বয়-ফ্রেন্ডের কর্মকাণ্ড বাদ পড়েনি।

 

টানা দু’ঘণ্টা টিউটোরিয়াল ক্লাস শেষ হতো এক টায়। এরপর লাঞ্চের এক ঘণ্টা বিরতি। লেকচার থিয়েটার থেকে ইউনিয়ন হাউজের রেস্টুরেন্টে যেতে আসতে প্রায় আধা-ঘণ্টা সময় চলে যেত বিধায় আমাদের তাড়াহুড়ো করতে হতো। লাঞ্চ বিরতির পর দুটো থেকে পাঁচটা পর্যন্ত চলতো একটানা আইটি বা কম্পিউটারের ক্লাস ভিন্ন টিউটরের অধীনে। কম্পিউটার ক্লাসের গুরুত্ব ছিল অসীম। কম্পিউটার না জানলে মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করা যাবে না- এটা প্রথম দিকেই বুঝে গেলাম। ভর্তি থেকে শুরু করে রেজাল্ট, সাবজেক্ট সিলেকশন, এসাইনমেন্ট জমা দেওয়া, রিডিং ম্যাটেরিয়াল সরবরাহ সব কিছুই কম্পিউটার তথা ইন্টারনেট নির্ভর ছিল। ওয়েব পোর্টাল, এলএমএস (লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম) মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির উল্লেখযোগ্য দুটো আইটি সার্ভিস। লাইব্রেরির ওয়েব সাইটের মাধ্যমে বিশ্বের যে কোন প্রান্ত থেকে কোন বই নিজের নামে বুকিং দেয়া  অথবা বই ফেরত দেওয়ার মেয়াদ বাড়ানো যেতো। সুতরাং এসব কিছু মাথায় রেখে আমাদেরকে কম্পিউটার ক্লাস বেশ গুরুত্বের সাথেই করতে হতো। কম্পিউটার সেশনের জন্য আমাদের টিউটর ছিল স্কট ড্রুমন্ড। স্কট জাতে ব্রিটিশ, আরও নির্দিষ্ট করে বললে সে উত্তর ইংল্যান্ডের ব্রাইটনের অধিবাসী। স্কট মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মিডিয়া এন্ড কমিউনিকেশনের উপর পিএইচডি করছে।

 

স্কটকে প্রথম দিনে ক্লাসে দেখে একটু অবাক হলাম। মনে হল ক্রিকেট প্রাকটিস শেষ করেই ক্লাসে ডুকে পড়েছে। গায়ে ইন্ডিয়ান ক্রিকেট টিমের জার্সি। অবাক হলাম যখন দেখলাম পুরো ছয় সপ্তাহে ঐ একই জার্সি পরে স্কট ক্লাসে আসছে। একদিন ক্লাসের এক ফাকে স্কট তার বিয়ের ছবি এবং ভিডিও দেখাচ্ছিল, দেখলাম একই জার্সি এবং জিন্স পরে সে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা পালন করেছে। তবে আমরা কেউই তার সারাক্ষণ ইন্ডিয়ান ক্রিকেট টিমের জার্সি পরে থাকার রহস্য জানতে চাইনি। আমরা স্কটের ক্লাস বেশ উপভোগ করতাম, যদিও পাঠ্য বিষয়ের চাইতে বিবিধ বিষয় বেশি আলোচিত হতো। আলোচনা প্রসঙ্গে স্কট জানালো সে তার হোম টাউন ব্রাইটনকে খুব মিস করে, যদিও সে মেলবোর্নে স্থায়ীভাবে বসবাসের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। স্কট শুধু একাই নয়, সে তার ছোট বোনকে এর মধ্যেই মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করিয়েছে। তার ইচ্ছে বোনও তার মতো অস্ট্রেলিয়াতে স্থায়ী হোক। স্কটকে দেখলে মনে হয় ওয়েস্টার্ন সোসাইটির পারিবারিক বন্ধন বেশ শক্ত।

 

কম্পিউটার ক্লাস বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত চলার কথা থাকলেও আমরা চারটার পরে স্কটের আর দেখা পেতাম না। এর নিয়ে অবশ্য আমাদের কোন মাথাব্যথাও ছিল না। আমরা নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে প্রাকটিস করতাম। স্কটের ক্লাসের একটি শর্ত ছিল চার জন মিলে একটি গ্রুপ এসাইনমেন্ট জমা দিতে হবে। প্রথমদিকে আমরা তিনজন মিলে গ্রুপের কাজ শুরু করলেও তিন সপ্তাহ পরে হাজির হয় ইন্দোনেশিয়ার ফরেন সার্ভিসের দিয়া কার্তিকা। দেরিতে আইএপিতে যোগ দেয়ার কারণে দিয়াকে পুরো বিষয়ের সাথে পরিচিত হতে বেশ কষ্ট করতে হয়েছিল। আমাদের গ্রুপের অন্যতম সদস্য ছিল মালদ্বীপের ইউনুছ সুবাহ। ইউনুস কানাডাতে এর আগে লেখাপড়া করেছে বিধায় সে ওয়েস্টার্ন শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে ভালীরে পরিচিত ছিল, বিশেষ করে একাডেমিক রাইটিং ওর দক্ষতা ছিল প্রশংসনীয়। এ কারণে ইউনুছ গ্রুপ এসাইনমেন্টে বিশেষ ভূমিকা পালন করতো।

 

দিয়া ছিল ঠিক উল্টোটা। কাজে ফাঁকি দেয়ার ব্যাপারে ও ছিল এক নাম্বার উস্তাদ। গ্রুপ ওয়ার্কে দিয়া আসতো সবার পরে এবং এসেই একটি  অজুহাত জুড়ে দিত। অন্যান্য গ্রুপ সদস্যের কল্যাণে দিয়া গ্রুপ এসাইনমেন্টে পার পেয়ে গেলেও সে নিজস্ব এসাইমেন্টে বেকায়দায় পড়েছিল। দিয়ার টিউটর আমিরকে দেখতাম  এসাইনমেন্ট সময়মত এবং যথাযথভাবে শেষ করতে বিভিন্ন ছবক দিতে। পরে জানা গেল টিউটরদের মধ্যে আমিরই নাকি সবচেয়ে কড়া ছিল। আমির জাতিতে পাকিস্তানি এবং মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পিএইচডি স্টুডেন্ট। দিয়ার ভাষ্যমতে সে আমিরের মতো পারফেকশনিস্ট জীবনে দ্বিতীয়টি দেখেনি। আমির দিয়াকে কড়া শাসনের মধ্যে রাখলেও সে আমিরের প্রশংসায় ছিল পঞ্চমুখ। আমাদের গ্রুপ এসাইনমেন্ট কাজে নাসরিনকে খুব একটা পেতাম না, কারণ ওর থাকার সমস্যা ছিল। তাই ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে সে বাসার খোঁজা কাজটি করতো। সুতরাং পুরো গ্রুপ এসাইনমেন্টটি আমাকে এবং ইউনুছকে দায়িত্ব নিয়ে সম্পন্ন করতে হল।

 

আমি ও মারুফ হোটেলের চিপা রুমে থাকতে থাকতে এরমধ্যেই হাফিয়ে উঠেছি। তাই আমরাও নাসরিনকে অনুসরণ করে বাসার অন্বেষণ শুরু করলাম। মেলবোর্নে আমাদের কারোরই কোন পরিচিত বন্ধু বান্ধব বা আত্মীয় স্বজন ছিল না, যার বাসায় থেকে আইএপি’র দিনগুলো স্বস্তিতে কাটাবো। মেলবোর্নে কোন ব্যক্তি বা পরিচিত জনের মাধ্যমে বাসা ভাড়া নেওয়া যায় না, বাসা ভাড়া নেবার জন্য কোন না কোন রিয়েল স্টেট এজেন্টের শরণাপন্ন হতে হবে আপনাকে। সমস্যা হল রিয়েল এস্টেট বিকেল পাঁচটায় বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের ক্লাস শেষ করে বাসার অন্বেষণে রিয়েল এস্টেট এজেন্টের অফিসে যাবার সুযোগ থাকতো না। তাই বাধ্য হয়ে টিউটরকে বিষয়টি জানালাম। আমান্দা আমাদের হোটেলে থাকার করুন বর্ণনা শুনে সদয় হল। হোটেলে যতটা না সমস্যা ছিল তার থেকে বহুগুণ বাড়িয়ে বললাম, ওর মন গলানোর জন্য। এদিকে স্কটের বৈকালিক ক্লাসে মাঝে মধ্যে ফাঁকি দিয়ে বাসার খোঁজার কাজে বের হবার একটি অলিখিত অনুমোদনও পেয়ে গেলাম।

 

অস্ট্রেলিয়াতে রিয়েল এস্টেট এজেন্ট (এদেরকে বাড়ীর দালালও বলতে পারেন) ছাড়া বাড়ী ভাড়া যে পাওয়া যায় না—আমান্দা তা আমাদের মনে করিয়ে দিলো। জানলাম এখানকার প্রত্যেক বাড়ীর মালিক কোন না কোন এজেন্টের কাছে বাড়ীর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দিয়ে থাকে। এজেন্টই ভাড়াটিয়া নির্বাচন করা, ভাড়া গ্রহণ, বাড়ী মেরামত থেকে শুরু করে বিক্রি করা পর্যন্ত সব দায়িত্ব পালন করে। মালিক শুধু মাস শেষে ভাড়া পেয়ে থাকেন, আর এজেন্টের পকেটেও ভাড়ার একাটি বড় অংশ ব্যবস্থাপনা ফি হিসেবে চলে আসে।

 

মেলবোর্নে বাড়ি বিক্রির প্রক্রিয়াটিও বেশ মজার। মালিক বাড়ি বিক্রির সিদ্ধান্ত নিলে এজেন্ট ঐ বাড়ির সামনে বিশাল আকারের একটি অকশন বা সেল বিজ্ঞপ্তি টানিয়ে দিবে। অকশনের ব্যাপক প্রচারের জন্য পত্র পত্রিকায় আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন ছাপানো হয় এবং বেশি লোকজনের সমাগম হয় এমন জায়গাতেও পোস্টার টানিয়ে দেওয়া হয়। শনিবার অথবা বা রবিবার অকশনের জন্য ধার্য করা হয় যাতে বেশী করে ক্রেতা অকশনে অংশ নিতে পারে। অকশন শুরু হয় ১ ডলার থেকে, তারপর ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। মোটামুটিভাবে ২ বেডরুমের একটি বাড়ীর দাম প্রায় ৩ থেকে ৪ লাখ ডলারের মতো। তবে এ দাম শহরের এলাকা ভেদে কম বেশী হতে পারে।

 

আমি দু’একটি অকশনে নিজে অংশ নিয়েছি। দাম ও হাঁকিয়েছি বেশ কয়েকবার, তবে খুব বেশি দূর উঠেনি। ভুয়া ক্রেতা হিসেবে নিজেকে সংযত রেখেছি। নিলামে ডাকাডাকি হাকাহাকি বেশ লম্বা সময় ধরে হতো। আমার বাসার কাছে নিলাম হলে প্লাস্টিকের একটি টুল সাথে নিয়ে যেতাম। টুলে বসে নিলামে অংশ নিতাম, রোদ থাকলে নিজের মাথায় নিজেই ছাতা ধরতাম। খানিকটা জমিদার জমিদার ফিলিংস পাওয়া যেত। মারুফ আমার এ কাজটি নিছক পাগলামি মনে করতো। ওকে কখনই আমি বাড়ী নিলামের আসরে শরীক করাতে পারিনি ।

 

এজেন্টের কাছে গিয়ে বাড়ি ভাড়ার আবেদন করার অভিজ্ঞতাও বেশ মজার। আবেদনের জন্য একটি ছাপানো ফরম আছে। প্রায় প্রতিদিন এজেন্টের অফিসে হালনাগাদ খালি বাড়ীর একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়। তালিকায় বাড়ীর একটি সংক্ষিপ্ত প্রোফাইল থাকে যাতে বাড়ীর আকার (যেমন বেডরুমের সংখ্যা), চুলা গ্যাসের না ইলেকট্রিকের, বিড়াল বা কুকুর পালা যাবে কিনা, সপ্তাহে ভাড়া কত দিতে হবে এসব বলা থাকে। সম্ভাব্য ভাড়াটিয়ারা তালিকা থেকে তাদের পছন্দমতো বাড়ীর জন্য ফরমে আবেদন করে। আবেদনপত্রের সাথে জমা দিতে হয় পাসপোর্টের কপি (স্থানীয়দের জন্য যে কোন ফটো আইডি) আয়ের উৎস, ড্রাইভিং লাইসেন্সের কপি, ছাত্র হলে স্টুডেন্ট আইডি, পূর্বের বাড়ীর বিদ্যুৎ বা পানি বিলের কপি, ইত্যাদি। এর প্রতিটির ডকুমেন্টের জন্য ভিন্ন ভিন্ন নম্বর বা পয়েন্ট ধরা আছে। যার পয়েন্ট সবচেয়ে বেশী সে-ই বাড়ী ভাড়া পাবে। একটি বাড়ির জন্য একাধিক আবেদন জমা হয় বিধায় এ ব্যবস্থা। আবেদন করার আগে প্রার্থীদেরকে আবশ্যিকভাবে বাড়ী পরিদর্শন করতে হবে। পরিদর্শনের জন্য আইডি কার্ড এবং ৫০ ডলার সিকিউরিটি মানি জমা রাখতে হয়। সময় দেয়া হয় মাত্র এক ঘণ্টা। এজেন্ট অফিস থেকে বাড়ী বেশ দূরে হলে এবং আবেদনকারীর নিজস্ব গাড়ী না থাকলে ঐ এক ঘণ্টা সময়ের মধ্যে পরিদর্শন শেষ করা মুশকিল হয়ে পড়ে। আমরা এটি টের পেয়েছিলাম হাড়ে হাড়ে।

 

আমি আর মারুফ ঠিক করলাম দুজনে মিলে দুই বেড রুমের একটি বাড়ী বা এপার্টমেন্ট ভাড়া নিবো। মেন্টর নগের কাছে পরামর্শ চাইলাম কোন এলাকায় বাড়ী সহজে পাওয়া যাবে সে বিষয়ে। তাছাড়া আবেদনপত্র তৈরিতে ওর সাহায্যের প্রয়োজন বলে মনে হল। নগের পরামর্শে আমার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি ব্রাঞ্জউইক এলাকায় বাড়ীর খোঁজার অভিযানে নামলাম। আমাদের সাথে যুক্ত হল মাসুমও। ওর বাড়ী আগে প্রয়োজন, কারণ সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকে নিয়ে হোটেলে ছোটে রুমে বেশিদিন থাকাটা ওর কাছে অস্বস্তিকর মনে হচ্ছে। আমরা প্রথমে যে এজেন্টের কাছে গেলাম তার নাম আলেকজান্ডার নেলসন। দুই বিপরীত মেরুর দু’জনের নাম একত্রে রাখা হয়েছে এ এজেন্টের নাম। এ যেন দুই পরম শত্রুকে এক ছাদের নীচে রাখার একটি প্রয়াস।

 

খালি বাসার তালিকা থেকে আমরা কহোনা (ইংরেজি হলেও নামটির মধ্যে হিন্দি হিন্দি একটি স্মেইল রয়েছে) স্ট্রিটের বাসাটি দেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। সাথে নগ রয়েছে। নগের উপর ভরসা করতে না পেরে এজেন্ট অফিস থেকে একটি ম্যাপ সাথে নিলাম। আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল দীর্ঘ তিন বছর মেলবোর্নে বসবাস করলেও নগ রাস্তাঘাট খুব একটা ভাল চেনে না। ফকফকে ফর্সা গোল আলু চেহারার এই মেন্টরকে আমার বেয়াকুব কেছেমের মানুষ বলে মনে হয়েছে। নিজে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, সব কিছু আমাদের উপর ছেড়ে দিতে পারলেই মনে হয় বাঁচে। আমার ধারণা এই মেয়ে নিজের বয়ফেন্ড নির্বাচন করতে পারবে না, কারো সাহায্য ওকে নিতে হবে।

 

প্রথমে ট্রাম ও পরে বাসে আমরা কহোনা স্ট্রিটের ৩১ নম্বর বাসায় গিয়ে হাজির হলাম। বাসা দেখে আমাদের পছন্দ হল। পাহাড়ের উপরে ছিমছাম একটি তিন তলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় বাসার অবস্থান। বাসার বেলকনিতে দাঁড়িয়ে মুনিপন্ড রেসকোর্স ময়দান দেখা যায়। আশে পাশে সবুজ শ্যামল ভ্যালীর দৃশ্যও বেশ মনোরম লাগে বাসার বেলকনি থেকে। বাসার দরজাতেই ট্রাম ও বাস স্ট্যান্ড। বাসার ভাড়া কিছুটা বেশী হওয়াতে মাসুম আগ্রহ হারিয়ে ফেললো। আমি আর মারুফ ঠিক করলাম যৌথভাবে বাসাটি ভাড়া নেব। বাসার জন্য প্রতি মাসে গুনতে হবে ৮০০ ডলার, বিদ্যুৎ আর পানির বিল আলাদা দিতে হবে।

 

সন্ধ্যায় হোটেলে মারুফের এক আত্মীয় অপূর্ব এসে হাজির একেবারে হঠাৎ করেই। অপূর্বের কথা মারুফের কাছে শুনেছি বেশ কয়েকবার। কথা ছিল অপূর্ব মারুফকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করবে। বিভিন্ন কারণে তা হয়ে উঠেনি। এছাড়া আরও কথা ছিল মারুফ মেলবোর্নের প্রাথমিক দিনগুলো অপূর্বের বাসাতেই থাকবে। অনেকটা আমার কারণেই মারুফ তার এই আইডিয়া বাদ দেয়। অপূর্ব সাথে নিয়ে এসেছে ওর আরেক বন্ধু লেলিনকে। আলাপ প্রসঙ্গে অপূর্বকে কহোনা স্ট্রিটে বাসার জন্য আবেদন করার বিষয়টি জানালাম। কহোনা স্ট্রিটের পরিবর্তে অপূর্ব আমাদের পরামর্শ দিল ফুটস্ক্রেতে বাসা নেবার জন্য।অপূর্ব নিজেও ফুটস্ক্রের নিকটবর্তী এলাকা ইয়ারাভিলে বসবাস করে ভাড়া বাড়ীতে। মেলবোর্নের পশ্চিম অঞ্চলের এই উপ-শহর সম্পর্কে ঢাকা থেকেই শুনেছিলাম। মাইগ্রেন্টদের এলাকা ফুটস্ক্রে। স্থানীয় অস্ট্রেলিয়ানরা এখানে সংখ্যালঘু। ফুটস্ক্রেতে সবচেয়ে বেশী বাস করে ভিয়েতনামিজ, তারপর চাইনিজ, ভারতীয় আর বাংলাদেশীদের সংখ্যা ৪র্থ। অপূর্ব  আরও জানালো মাইগ্রেন্ট অধ্যুষিত এ উপশহরে বাংলাদেশী বেশ কিছু দোকান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও রেষ্টুরান্ট রয়েছে। ওর বক্তব্য ফুটস্ক্রে একটি মিনি বাংলাদেশ। আর এ মিনি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ মীনা বাজার নামের দোকানটি।

 

অপূর্ব’র সাথে সলা-পরামর্শের পরদিনই ফুটস্ক্রে উপ-শহরের প্রাণকেন্দ্র পিকেট স্ট্রিটে দুই রুমের একটি খালি বাসা পাওয়া গেল। ভাড়া মাসে ৭৮০ ডলার, বিদ্যুৎ ও পানির বিল বাদে। এসব বাবদ বিল দিতে হবে মাসে প্রায় ১৫০ ডলারের মতো। সব দিক বিবেচনা করে আমি আর মারুফ বাসাটির জন্য আবেদন করার সিদ্ধান্ত নিলাম। মনে মনে ভয়ও কাজ করছিল যে আবেদন করলেইতো বাসা পাওয়া যাবে না। আমারা যখন বাসা পরিদর্শন করছিলাম তখন আরও দু’জন অজি দম্পতি বাসাটি দেখছিল। সুতরাং বাসা পাওয়া যে খুব সহজ হবে তা কিন্তু ভাবতে পারছিলাম না। আমাদের আবেদন জোরদার করার জন্য যাবতীয় কাগজপত্র যুক্ত করলাম, সাথে লুসিয়ার দেওয়া সুপারিশপত্রতো আছেই। এ সুপারিশ পত্র তুরুপ হিসেবে কাজ করতে পারে এমনটি ভেবে আত্মতৃপ্ত হলাম।

এর মধ্যেই মায়ামি হোটেলে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। মধ্য জানুয়ারির প্রচণ্ড গরমে স্বস্তি পাওয়ার জন্য একটি মাত্র টেবিল ফ্যান যথেষ্ট নয়। সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ক্লাস, তারপরে আবার ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করার ব্যবস্থা নেই। আশে পাশে আমাদের দেশী খাবারের কোন রেষ্টুরান্ট নেই যেখানে তৃপ্তি মতো এক বেলা খাওয়া যাবে। হোটেলের নিকটবর্তী এরোল স্ট্রিটের একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্ট ছিল আমাদের একমাত্র ভরসা। এ হোটেলে আমরা মূলত ভাত (স্টিকি), সবজী এবং চিংড়ি মেনু হিসেবে বেছে নিতাম। তবে এ চাইনিজ রেষ্টুরান্ট বাংলাদেশী চাইনিজ রেষ্টুরান্ট এর সাথে তুলনা করা যাবে না। এখানকার তরকারী ভাল করে সিদ্ধ করা হয় না। আমাদের বিশেষ অনুরোধে তরকারিগুলো ভাল করে রান্না করা হতো। খাওয়ার শুরুতেই আমরা বলে দিতাম, কারি স্যুড বি ডিপ ফ্রাইড। পর পর সাত আট দিন ঐ রেস্টুরেন্টে যাবার পর ম্যানেজারের সাথে আমাদের এক ধরনের সখ্যতা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং মাঝে মধ্যে একটু বাড়তি আবদার করলে তা সে রক্ষা করতো। এখানে খাবার সময় কেবলই মনে হতো কবে যে নিজেদের বাসায় উঠে বাঙ্গালী খাবারের স্বাদ গ্রহণের সুযোগ হবে।

 

আমরা বাঙ্গালী মানেই ভাতের পাগল। ভাত আর মাছের ঝোল না খেতে পারলে মনে হয় সবই বৃথা। কারণ অনুসন্ধান শুরু করলাম। যতটুকু জানা যায় বাঙ্গালীর ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতা, সমাজ বা রাষ্ট্র গঠন ও প্রসার, ব্যবসা বাণিজ্য সব কিছুর শুরুই ধান চাষের উন্নয়নের মাধ্যমে। খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে সময়ে বঙ্গ অঞ্চলে ধান চাষের গোড়া পত্তন হয়। প্রাথমিক দিকে এ অঞ্চলের লোকজন অস্থায়ী ভিত্তিতে শুকনো জমিতে ধান চাষ শুরু করে, যা শিফ্টিং  এগ্রিকালচার নামে পরিচিত ছিল। এটি অনেকটা পাহাড়ি এলাকায় জুম চাষের মতো। এরিয়ানরা বঙ্গ অঞ্চলে আসার পর ধান চাষের ধরন বদলে যায়। তারা উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে পানির ব্যবহার করে চাষাবাদ শুরু করে, যা পরিচিত পায় ওয়েট রাইস কাল্টিভিশন নামে। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারে ধানের উৎপাদন বহুগুণ বেড়ে যায়। পর্যায়ক্রমে এরিয়ানরা বিহার, গৌড় হয়ে বাংলার দিকে আসতে থাকে। তারা স্থানীয় আদি বাসিন্দাদের দিয়ে বন পরিষ্কার করে পূর্ব দিকে ধান চাষের প্রসার ঘটাতে থাকে।

 

চাহিদার অতিরিক্ত উৎপাদিত ধান ক্রয় বিক্রয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে বাজার, গঞ্জ। চাষিরা স্থায়ীভাবে নির্দিষ্ট এলাকায় বসবাস শুরু করে। তৈরি হয় সমাজ, ক্রমান্বয়ে যা রূপ পায় রাষ্ট্রে। রাষ্ট্রের সুরক্ষায় গঠিত হয় সুরক্ষা ব্যবস্থা, তারপর খাজনা আদায়ের জন্য তৈরি হয় রাজস্ব আদায় বা কালেক্টরের পদ, এরপর অপরাধীদের বিচারের জন্য সৃষ্টি হয় বিচার ব্যবস্থা। এভাবে ধান চাষ কেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থা পূর্ণ রাষ্ট্রে রূপ লাভ করে। তাই আমাদের সকলের শিকর গ্রথিত ধানচাষী কৃষক শ্রেণীতে । সেই শুরু থেকেই ভাতই আমাদের প্রধান খাদ্য। এ বৃত্ত থেকে বাঙ্গালী কখনও বের হয় আসতে পারবে না বলে আমার বিশ্বাস।

 

আমাদের খুব বেশী অপেক্ষা করতে হল না।  দুটো এজেন্টের নিকট বাসার জন্য আমরা আবেদন করেছিলাম, উভয় থেকে ডাক পেলাম। আমরা ঠিক করলাম ফুটস্ক্রের পিকেট স্ট্রিটের বাসায় গিয়ে উঠবো। তার কারণ হল প্রথমত: ফুটস্ক্রেতে বাংলাদেশি অভিবাসীদের সংখ্যা বেশী, দেশীয় একটি আমেজ এ এলাকায় রয়েছে। দ্বিতীয়ত: কহোনা স্ট্রিটের তুলনায় পিকেট স্ট্রিটের বাসা পরিসরে অনেক বড়। রিয়েল এস্টেট থেকে সুসংবাদ শোনা মাত্রই আমরা বাসায় উঠার জন্য ব্যাকুল হয়ে গেলাম।

 

আমরা পরদিনই রিয়েল এস্টেট সুইনির অফিসে চলে আসলাম। আগেই কন্ট্রাক্ট ডকুমেন্ট প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। আমরা কন্ট্রাক্টের প্রতিটি শর্ত ভাল করে পড়ে স্বাক্ষর করলাম। এক মাসের অগ্রিম ভাড়া আর এক মাসের ভাড়ার সমপরিমাণ ডলার সিকিউরিটি বন্ড হিসেবে জমা দিয়ে বাসার চাবি নিলাম। ঠিক করলাম পরদিন বাসায় উঠবো। কিন্তু হোটেলে গিয়ে দম বন্ধ হওয়া পরিবেশ দেখে মত পাল্টালাম। ঐদিন সন্ধ্যায়ই লাগেজ নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। যে করেই হোক বাসায় উঠতে হবে। একদিকে যেমন হোটেলের বদ্ধ পরিবেশ থেকে মুক্তির ব্যাকুলতা, অন্যদিকে প্রতিদিন আশি ডলার খরচের হাত থেকে রেহাই এ দুটো তাগিদই আমাদের নতুন ভাড়া করা বাসাতে উঠার পিছনে ড্রাইভিং ফোর্স হিসেবে কাজ করছিল।

 

জানুয়ারি মাসের ১৯ তারিখে বাসায় যখন দু’জনে লাগেজসহ পৌঁছলাম তখন প্রায় ৮.০০ টা বাজে। সন্ধ্যা তখনও হয়নি। মেলবোর্নে জানুয়ারি মাসে সন্ধ্যা নামে রাত সাড়ে ন’টার পর। বাসায় উঠেই মাথায় ভূত চাপলও রান্না করার জন্য। এর মধ্যেই পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। রান্নার জন্য প্রাথমিক বাসনপত্র আমাদের সাথেই ছিল। দ্রুত চলে গেলাম বাংলাদেশী দোকান মিনা বাজারে। প্রথম দিনের মেন্যু ভাত, ডিমভাজা, আলু ভর্তা, আর ডাল। মিনা বাজারে এ আয়োজনের জন্য যা যা লাগবে তা পাওয়া গেল। রান্না বান্না করার বিষয়ে আমার স্বল্প পরিমাণ অভিজ্ঞতা থাকলেও মারুফ এ জগতে একেবারেই নতুন। ডিম ভাঙ্গতে মারুফের শঙ্কা দেখে তা বুঝা গেল। রান্নার সময় দেখা গেল আলু আনা হয়েছে তো পিঁয়াজ আনা হয়নি। এরপর দেখা গেল তেল নেই। আমরা পালা করে তিন চার বার মিনাবাজারে গিয়ে এগুলো কিনে আনলাম। বাসা থেকে মাত্র দশ মিনিটের পথ হওয়ার কারণে বার বার দোকানে যেতে আমাদের খুব একটা বেগ পেতে হল না।   (চলবে)…..

 

 

~ ক্যাঙ্গারু কোয়ালার দেশে: মজার সব অভিজ্ঞতা (১ম পর্ব) ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleমন খারাপের বৃষ্টি
Next articleজীবন – বেলুন
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments