লিপির আজ খুব দুঃখ হচ্ছে। আজ ওর মা নতুন বিয়ে করে এসেছে৷ লজ্জায় ওর মাথা কাটা যায় আর কি। ও এই বছর কলেজ এ ভর্তি হবে। এতদিন পড়াশোনা নিয়ে এতোই ব্যস্ত ছিল যে ওর বাড়িতে কি চলছে ও কোন গুরুত্বই দেয় নি। আজ তার জন্য আফসোস হচ্ছে। দাদা মাঝে মাঝে চিৎকার করত। ও ভাবত দাদার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তার মা টিউশানি করে, সেলাই করে তাদের মানুষ করছে সেই মা এই বয়সে প্রেম করছে, এ তো ভাবাই যায় না। ওর তো ভাবলেই গা গুলিয়ে উঠছে যে ওই কারখানার মজদুরটাকে ও বাবা বলে ডাকবে। কক্ষনো ডাকবে না। কোথাও যাওয়ার ও তো জায়গা নেই। দাদা আর ও দুজনেই বেকার।

বাইরে বেরলে লোকে হাসাহাসি করছে। লিপির এসব একদম ভাল লাগছে না। কিন্তু মেনে নিতেই হবে। ও নিজেও আজকাল টিউশানি করে। যতটা পারে বাড়ির বাইরে থাকে। দাদাও সারাদিন কোথায় থাকে কে জানে। সংসারটা এখনও মা-ই চালায়। নতুন লোকটাও কিছু দেয়। তবে তা যৎসামান্য । একটা কথা মানতে হবে, তার মাকে গত এগার বছরে এত খুশি সে দেখে নি। এই ক বছরে তার মাকে শুধু যন্ত্রের মত কাজ করে যেতে দেখেছে। আজ তার মা হাসে, আনন্দ করে। সে আর তার দাদা তাদের মা কে কি কোন আনন্দ-ই দিতে পারেনি। যাই হোক সব কিছুই সয়ে যাচ্ছিল।

একদিন বাড়ি ফিরে লিপি দেখে মা আর দাদা তুমুল চিৎকার করছে। কি হয়েছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ শোনার পর বোঝা গেল, তার মা গর্ভবতী।

লিপিরও পা এর তলা থেকে মাটি সরে গেল যেন। এইটাই বাকি ছিল। মা কি ওদের কথা একদমই ভাবা ছেরে দিয়েছে? এই বয়সে তার ভাই বা বোন হবে। ধরণী দ্বিধা হও। হঠাৎ দেখে দাদা ব্যাগ গোছাচ্ছে। ও দৌড়ে দাদার কাছে গিয়ে বলল “ তুই কোথায় যাচ্ছিস দাদা?” ব্যাগ গোছাতে গোছাতেই দাদার উত্তর “এখানে আর থাকা সম্ভব নয়, আমাদের মানসম্মান বলে কিছু রইল না। থাক ও পরে ওর পিরিতের বরের সাথে।”

-“কিন্তু তুই যাবি কোথায়?”

-“ আমার বন্ধু আছে জামশেদপুর এ, ওর ওখানে ও চাকরি তে লাগাবে বলেছে।”

-“আমায় নিয়ে যাবি না দাদা?”

-“ ধুর! তোকে এখন কোথায় নিয়ে যাব? আমার নিজের-ই ঠিকানা নেই।”

বলেই দাদা ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে চলে গেল। ওর মা গুম হয়ে বসে রইল।

কয়েকমাস বাদে লিপির মা এর ছেলে হল। হ্যাঁ! এ শুধু ওর মা এর ছেলে, ওর সাথে এ শিশুর কোন সম্পর্ক নেই।

কিকরে জানি কলেজেও জানাজানি হয়ে গেল। শুভর সঙ্গে সম্পর্কটা শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে গেল। সবাই হাসাহাসি করে, টিটকিরি মারে। অদিতি সেদিন সবার সামনেই চিৎকার করে বলল “হ্যাঁ রে লিপি! তোর ভাই  তোকে মাসি বলে ডাকে না তো?” শুনে সবার কি হাসি। শুভ তো ওকে এড়িয়েই চলে। একদিন ডেকে জিগ্যেস করাতে মুখের ওপর বলেই দিল “ দ্যাখ লিপি তোর আর আমার ব্যাকগ্রাউন্ডটা ঠিক মেলে না। তাই সম্পর্কটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোন মানে হয় না। আমরা বন্ধু থাকতে পারি।” যদিও কিছু দিনের মধ্যেই  শুভ বুঝিয়ে দিল বন্ধুত্ব রাখারও কোন ইচ্ছা তার নেই। লিপি মা এর প্রতি রাগে অভিমানে গুমরাতে থাকল।

এইভাবে আরও সাতবছর কেটে গেল। লিপি এখন একটা কোচিং সেন্টার-এ রিসেপ্সনিস্টের চাকরি করে। মা ছেলের নাম রেখেছিল দীপক, ডাকনাম দীপু। লিপি যদিও পুরোপুরি এড়িয়েই চলত। কিন্তু একতলা বাড়ি, দুটোমাত্র ঘর। বাচ্ছা দুটো পা অত বাধা মানে না। খেলতে খেলতে প্রায়ই দিদির ঘরে ঢুকে পরত সে। আর তাকে দেখলেই মাথায় রক্ত চড়ে যেত লিপির। চিৎকার করে বলে উঠত “দূর হয়ে যা আমার চোখের সামনে থেকে, আপদ একটা।” অবোধ দুটো চোখ অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকত।

আজ সারাদিন থানা পুলিস করেই কেটে গেল লিপির। কাল রাতে ও তখন বাড়িতে ছিল না। মা এর সাথে ওর সৎ-বাপের খুব ঝগড়া হয়েছিল, রাগের চটে ভারী কিছু দিয়ে ওর মাকে মাথায় মেরেছে ওই লোকটা। সঙ্গে সঙ্গেই মারা গেছিল ওর মা। পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে লোকটাকে। ও গিয়ে ডায়রি করে এল।

ফেরার পথে হঠাৎ দাদার সাথে দেখা। এতদিন পরে দাদাকে দেখে ও প্রথমে বিশ্বাস করেনি। চেহারাও অনেক বদলে গেছে। দাদাই ডাকল প্রথমে-

-“  কিরে লিপি? চিনতে পা্রছিস না নাকি?”

-” দাদা! তুই কোথায়…..” আর বলতে পারল না। দাদাকে জরিয়ে ধরে খুব কাঁদল।

এতদিনের জমা কান্না। তারপর সামলে নিয়ে বলল “ তুই কিকরে খবর পেলি?”

-“আরে আমার কাছে সব খবরই যায়। পাড়ার পটা আমাকে ফোন করে বলল। এটাতো হবারই ছিল। বুড়ো বয়সে যদি কারো ভীমরতি হয়। যাকগে ছার! তুই আর এখানে থেকে কি করবি? তোর বৌদিও বলছিল তোকে নিয়ে যেতে আমার সাথে।”

-“ তুই বিয়ে করেছিস? আমায় একবার বলিসও নি?”

-“ সে অনেক কথা। পরে বলব। তুই যাবি তো?”

-” হ্যাঁ রে যাব। কিন্তু দীপুর কি হবে? ওকেও নিয়ে যাব?”

-” একদম না। ও পাপ আমি নিয়ে যাব না।”

-” তাহলে?”

-” তাহলে আমি কি জানি? এখানকার ঝামেলা মিটে গেলে তুই আর আমি চলে যাব। কিছুদিন বাদে এসে বাড়িটা বিক্রি করে চলে যাব। ও মরুক যেখানে ইচ্ছে।”

দুদিন হয়ে গেল মা এর সৎকার করা হয়ে গেছে। এই দুদিনে মা-এর জন্য খুব মন কেমন করেছে লিপির। যাই করুক একটা সময়ে মা খুব কষ্ট করে ওদের দুই ভাইবোন কে বড় করেছে, নিজে না খেয়ে ওদের খাইয়েছে। আজ মা নেই, তাই বড় বেশী মা এর কথা মনে পরছে। কত কথা, কত অভিমান মাকে জানানোর ছিল। এইসব ভাবতে ভাবতে লিপি ব্যাগ গোছাচ্ছিল। এমন সময় দরজার দিকে চোখ যেতে দেখে অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে ওর চিরশত্রু, সাত বছরের সৎভাই।

ওর দিকে চোখ যেতেই প্রথম অভিব্যক্তি “ এসে গেছে আপদটা।”

চোখ সরিয়ে নিয়ে ও আবার ব্যাগ গোছাতে লাগল। কিছুক্ষণ বাদে আবার দেখে ও একই ভাবে তাকিয়ে আছে। উফ্ অসহ্য। কি মনে হতে আর একটু ভাল ভাবে দেখল ওকে লিপি। আচ্ছা! ও কি কাঁদছে? হ্যাঁ ওর গাল বেয়ে জলের দাগ শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে। লিপি মানুক না মানুক ও তো একই মা এর সন্তান। ও তো মা হারিয়েছে। অন্য দিন হলে এতক্ষণে মা ওকে মুড়ি দিয়ে আলুসিদ্ধ মেখে দিত। আর ও মায়ের পাশে বসে খেতে খেতে পড়া বলত।

আচ্ছা! ও সকাল থেকে কিছু খেয়েছে? একি? এ কি ভাবছে লিপি? ও যে ওর চিরশত্রু। ওর খাওয়া নিয়ে ভাবছে কেন আজ? কিছুক্ষণের মধ্যেই দাদা এসে লিপিকে নিয়ে যাবে। তারপর তো আর কোনদিন এই আপদের মুখ দেখতে হবে না। এটাই কি ও চাইনি এতদিন?

তবে কেন এত দ্বিধা? আচ্ছা ও কি কিছু বুঝতে পারছে? কাল থেকে ওর কেউ থাকবে না। ওইটুকু মানুষটাকে একাই খাবার যোগার করতে হবে হয়ত। স্কুলে যাওয়া আর ওর হবে না। লিপির হাত থেমে গেল। এ কি করতে যাচ্ছে সে?

এখনও একই ভাবে দাড়িয়ে আছে ছেলেটা দরজার কাছে। কিছু বলছে না।

লিপি ডাকল ওকে, “ দীপু ! এদিকে আয় ” ও আস্তে আস্তে কাছে এল। ওকে কাছে টেনে জিগ্যেস করল “ কিছু বলবি তুই?”

-“ মা কোথায় গেছে গো দিদি? তুমি জান?”

চুপ করে আছে লিপি। “ মা কি মরে গেছে?” বলে উঠল দীপু। ওকে কাছে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরল লিপি। আহ্ কি শান্তি! এতদিনের এত অভিমান, ঘেন্না, সব মুহূর্তে মিলিয়ে গেল। এটা কেন পারেনি ও এতদিন?

বাইরে ট্যাক্সির আওয়াজ শোনা গেল। ওর দাদা দৌড়ে ঢুকল ঘরে।

-” আরে! তুই এখনও ওটাকে নিয়ে কি করছিস? তাড়াতাড়ি কর, বেরতে হবে তো”

-“ আমি যাব না দাদা। আমি এখানেই থাকব।”

-“ কি করবি এখানে থেকে তুই?”

-“ বড় করব দীপুকে, যেভাবে মা করেছিল আমাদের।”

 

~ আপদ ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleঅন্তর্হিত
Next articleপ্যাঁচ
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

3 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments