অমরকণ্টক ।  মধ্যপ্রদেশ রাজ্যে মৈকাল পাহাড়ে অবস্থিত এই হিন্দুতীর্থ পুণ্যতোয়া নর্মদার তটভূমি । অমরকণ্টক একইসঙ্গে  নর্মদা নদী ও শোন নদের উৎস স্থল।  নিসর্গ আর ধর্মের সমাহার ঘটেছে প্রাচীন মুনি ঋষিদের এই সাধনা ক্ষেত্রে।   সাতপুরা ও বিন্ধ্য পর্বতের মিলনও ঘটেছে অমরকণ্টকে। পবিত্র এই তীর্থভূমি ভ্রমণের অভিলাষে আমরা নয়জন গত ৮ই অক্টোবর, ২০১৭ রবিবার শালিমার উদয়পুর সিটি এক্সপ্রেসে রওনা হলাম। খড়গপুর স্টেশন থেকে রাত ১০টা ১৫  মিনিটে ট্রেন ছাড়ল। পরের দিন সকাল সাড়ে ন’টায় আমরা পেন্ড্রা রোড স্টেশনে নামলাম। পেন্ড্রা রোড অমরকণ্টকের নিকটতম রেলস্টেশন।

স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটি হোটেলে দ্বিপ্রাহরিক আহার সেরে দুটি অটো করে যাত্রা শুরু করলাম। পেন্ড্রা রোড স্টেশন থেকে অমরকণ্টকের দূরত্ব ৩২ কিলোমিটার। সময় লাগে প্রায় ১ ঘণ্টা। তবে এই রাস্তায় শুধু অটো, টাটা সুমো জাতীয় গাড়ী চলে। বাস চলাচলের জন্য অন্য রাস্তা আছে। কিছুটা রাস্তা সমতলে যাওয়ার পর পাহাড়ী চড়াই পথের শুরু। পথে অমরকণ্টকের দুটি দ্রষ্টব্য স্থান অমরেশ্বর ও জালেশ্বর মহাদেবের দুটি মন্দির আছে। রাস্তার দুইপাশে ঘন জঙ্গলের শোভা সত্যিই মনোমুগ্ধকর।

প্রকৃতির সেই শোভা দেখতে দেখতে ঘণ্টা খানেকের মধ্যে আমরা পৌছে গেলাম  অমরকণ্টকে। অমরকণ্টকে ঢোকার মুখে নির্মীয়মাণ আদিনাথ জৈন মন্দিরের সন্নিকটে সর্বোদয় তীর্থে চারটি রুম ভাড়া নিলাম। এখানে আমরা দুইদিন ছিলাম। দুপুরে কয়েক ঘণ্টা বিশ্রাম নেওয়ার পর বিকেলে মেন মার্কেট বেড়িয়ে এলাম। পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ। মার্কেটে বেশ কয়েকটি খাবার হোটেল ও রেস্টুরেন্ট এবং ষ্টেশনারী দোকান আছে।

 

আদিনাথ জৈন মন্দির

পরের দিন অর্থাৎ ১০ই অক্টোবর সকালে ধর্মশালা থেকে বেরিয়ে পায়ে হেঁটে নির্মীয়মাণ আদিনাথ জৈন মন্দির দেখে এলাম। জৈন সম্প্রদায়ের পূজ্য আচার্য ১০৮ শ্রী শ্রী বিদ্যাসাগর মহারাজের প্রেরণায় বর্তমানে সুবিশাল মন্দিরটির নির্মাণকার্য চলছে। মন্দিরের গর্ভগৃহে আদিনাথ বা ঋষভদেবের অষ্টধাতুর বিগ্রহ আছে। রাজস্থানি বেলেপাথর দিয়ে তৈরি অসাধারণ কারুকার্যময় মন্দিরটির নির্মাণকার্য সম্পূর্ণ হলে তা অমরকণ্টকের অন্যতম দ্রষ্টব্য স্থান হিসেবে বিবেচিত হবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।

 

নর্মদা উদ্গম্ ও নর্মদা মন্দির

আদিনাথ জৈন মন্দির থেকে ফিরে একটি টাটা সুমো গাড়ি করে অমরকণ্টকের দ্রষ্টব্য স্থানগুলি দেখার জন্য সকাল নটায় বের হলাম। প্রথম গন্তব্য নর্মদা উদ্ গম্ ও নর্মদা মন্দির। মন্দিরের প্রবেশপথ দিয়ে মন্দির পরিসরে প্রবেশ করেই দেখতে পেলাম বিশাল প্রস্তরময় চত্বর। এখানেই আছে একাদশ কোন বিশিষ্ট কুণ্ড -নর্মদা উদ্গম্। নর্মদা নদীর উৎপত্তি স্থল। স্থির জল, বাধানো সিঁড়ি ধাপ। দেখে বিশ্বাস হয় না এখান থেকে নর্মদা নদীর সৃষ্টি। নর্মদা উদ্গমে অতীতে স্নান করা গেলেও বর্তমানে স্নান করা ও কাপড় কাচা নিষিদ্ধ।

এই কুণ্ডের জলই একটি নালা দিয়ে প্রায় ৫০-৬০ ফুট দূরে মন্দির চত্বরের বাইরে একটি কুণ্ডে জমা হচ্ছে। যার নাম কোটি তীর্থ। পাশেই আর একটি কুণ্ড – মহোদধি। দুটি কুণ্ডেই স্নান করা চলে।  কোটি তীর্থ থেকে নর্মদা আবার নালা দিয়ে তলায় কিছুটা প্রবাহিত হয়ে পুনরায় প্রকটিত হয়েছে। আমরা কোটি তীর্থে স্নান করে মন্দিরে প্রবেশ করলাম। বিশাল মন্দির পরিসরে মোট ২৭টি মন্দির আছে। মূল মন্দিরে মা নর্মদার কালো কষ্টি পাথরের মূর্তি। এর উল্টোদিকেই অমরকন্টকেশ্বর মহাদেবের মন্দির। নর্মদা মূর্তির সামনে একটি ছোট শ্বেত বর্ণের মূর্তি। মাকে গৌরীরূপে ওই মূর্তিতে পূজা করা হয়। পাশেই শঙকরাচার্য দ্বারা স্থাপিত ভৈরবীচক্র। নর্মদা উদ্গমের পাশে আর একটি কুণ্ড – রোহিণী কুণ্ড।

কথিত আছে এই কুণ্ডের জলে যে কোনো প্রকার চর্ম রোগ নিরাময় হয়। আমরা নর্মদা উদ্গম্ থেকে পবিত্র নর্মদার জল সংগ্রহ করলাম। মন্দিরের সামনেই একটি ছোট প্রস্তর নির্মিত হাতি। দেখলাম পুণ্যের পরীক্ষা দেওয়ার জন্য হাতির চার পায়ের সংকীর্ণ ফোকর দিয়ে অনেকে গলে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আমরা কেউই অবশ্য সে চেষ্টা করলাম না।

 

পাতালেশ্বর মহাদেবের মন্দির

মন্দির পরিসর থেকে বেরিয়ে প্রায় ১০০ মিটার দূরে পুরাতত্ত্ব বিভাগ দ্বারা সংরক্ষিত একগুচ্ছ প্রাচীন মন্দির। মন্দিরগুলি একাদশ শতাব্দীতে কলচুরী শাসকদের দ্বারা নির্মিত। এখানে রংমহল, কর্ণ মন্দির, বিষ্ণু মন্দির, মৎসেন্দ্রনাথ মন্দির ও পাতালেশ্বর মহাদেবের মন্দির আছে। পাতালেশ্বর মহাদেবের মন্দিরের প্রবেশদ্বার থেকে সিঁড়ি দিয়ে প্রায় ১০ ফুট নীচে নেমে দেখতে পেলাম আদি শঙ্করাচার্য দ্বারা পূজিত স্বয়ম্ভু শিবলিঙ্গ। স্থানীয় পুরোহিতের মুখে শোনা গেল শ্রাবণ মাসের একটি সোমবার কোন এক অজানা পথে জল এসে মন্দিরের গর্ভগৃহ সম্পূর্ণ ভরিয়ে দেয়। আবার কিছুক্ষণ পরে সমস্ত জল বেরিয়েও যায়। সম্ভবত নর্মদা কুণ্ডের সাথে এর কোন যোগাযোগ আছে। সবুজ ঘাসে মোড়া মন্দির চত্বর, স্থানে স্থানে বিভিন্ন রকমের পাতাবাহার গাছ ও একগুচ্ছ প্রাচীন মন্দিরের স্থাপত্য সত্যই নয়নাভিরাম।

 

মাই কি বাগিয়া

পাতালেশ্বর মহাদেবের মন্দির থেকে বেরিয়ে আবার গাড়ীতে  গেলাম প্রায় ১ কিমি দূরে অবস্থিত মাই কি বাগিয়াতে।  মাই কি বাগিয়া অর্থাৎ মায়ের বাগান। এই বাগানে বিভিন্ন প্রকারের বহু প্রাচীন বৃক্ষের সমারোহ দেখতে পেলাম। গুলাবকাউলি নামে এক ঔষধি গুল্ম শুধুমাত্র  এখানেই পাওয়া যায়। এর ফুলের নির্যাস চোখের রোগের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এখানে একটি জলের কুণ্ড আছে। নাম চরণোদক কুণ্ড।  পাশেই নর্মদা মায়ের মন্দির।

 

শোনমুড়া

এরপর আমরা গেলাম শোনমুড়া। মাই কি বাগিয়া থেকে প্রায় ১ কিমি দূরে। শোনমুড়া শোন নদের উৎসস্থল। এখানে হনুমানের খুব উপদ্রব। অবশ্য পুরো অমরকণ্টক জুড়েই প্রচুর হনুমান দেখতে পাওয়া যায়। গাড়ি থেকে নামতেই কয়েকজন হকার ঘিরে ধরল। তাদের কাছ থেকে চানা অর্থাৎ ছোলা কিনতে হবে হনুমানদের খাওয়াবার জন্য। এটা পুরী বেড়াতে গিয়ে উদয়গিরিতেও লক্ষ্য করেছিলাম। হকারদের কাছ থেকে চানা কেনামাত্রই হনুমানের দল ছোঁ মেরে কেড়ে নিল। চানা কাড়তে গিয়ে অনেককে দেখলাম নখ দিয়ে আঁচড়েও দিচ্ছে।

সিঁড়ি দিয়ে কিছুটা নেমে গিয়ে দেখলাম শোণ উদ্গম্ – শোণ নদের উৎস। পাশেই আর একটি কুণ্ড – ভদ্র নদের উৎসস্থল। উদ্গম কুণ্ডের কাছেই দেবী শোনাক্ষীর মন্দির। এটি ৫১ সতীপীঠের অন্যতম সতীপীঠ। এখানে দেবী সতীর বাম নিতম্ব পড়েছিল। শোণ ও ভদ্র দুই নদের জল মিলিত হয়ে শোণভদ্র নামে কিছু দূর যাওয়ার পর জলপ্রপাত রূপে গভীর খাদে পড়ছে। এখানে একটি ভিউ পয়েন্ট করে দেওয়া হয়েছে। ভিউ পয়েন্ট থেকে ঘন জঙ্গলে ঢাকা দূরের পাহাড়ের দৃশ্য অসাধারণ। আমরা এখানে বেশ কিছু ছবি তুললাম। তারপর গরম গরম পকোড়া ও চা খেয়ে যাত্রা শুরু করলাম। পরের গন্তব্য কপিলধারা ও দুধধারা।

 

কপিলধারা ও দুধধারা

বেশ কিছুক্ষণ গাড়ী চলার পর কপিলধারাতে এসে নামলাম। এখানে কয়েকটি খাবার হোটেল আছে। এখানেই লাঞ্চ করব। তাই আগে থেকে অর্ডার দিয়ে দিলাম। এরপর প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে কপিলধারাতে পৌঁছলাম। শান্ত নর্মদা হঠাৎ বিপুল শক্তি নিয়ে গর্জন করতে করতে প্রায় ৭০ -৮০ ফুট নীচে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এটি নর্মদার প্রথম জলপ্রপাত। এখানেও পর্যটকদের দেখার জন্য ভিউ পয়েন্ট করে দেওয়া হয়েছে। ডান দিকে একটি সেতু পেরিয়ে গিয়ে দেখলাম কপিলাশ্রম – কপিল মুনির সাধনার স্থান।

এরপর এখান থেকে ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে প্রায় ১ কিমি নেমে গিয়ে দেখলাম নর্মদার দ্বিতীয় জলপ্রপাত দুধধারা। হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু দুধধারার রূপ দেখে মনে হল কষ্ট সার্থক। এখানে জলপ্রপাতের উচ্চতা খুব বেশী নয়। দেখলাম জলপ্রপাতের জলে অনেকে স্নান করছে। দুধের মত সাদা জলের ধারা অবিরাম গতিতে পড়ে চলেছে। জল এতটাই স্বচ্ছ যে জলের তলায় থাকা নুড়ি পাথর গুলিকেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পাশেই দুর্বাসা গুহা। অন্ধকার গুহার মধ্যে প্রদীপের আলোয় দেখলাম ধ্যানরত দুর্বাসার প্রস্তরনির্মিত মূর্তি। কথিত আছে এখানে ঋষি দুর্বাসা তপস্যা করেছিলেন ।

 

কবীর চবুতরা

এর পরের গন্তব্য কবীর চবুতরা। ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পাহাড়ি রাস্তায় বেশ কিছুটা নেমে যাওয়ার পর অপার নির্জনতার মাঝে একটি অত্যন্ত সাধারণ টালির ছাউনি দেওয়া কুটির। নাম কবীর কুঠি। কথিত আছে এখানে বসেই সাধনা করেছিলেন সন্ত কবীর। অনেকের মতে কবীর এখানেই দেহত্যাগ করেন। এখানে কবীরের পাদুকা রাখা আছে। কবীর চবুতরায় দুটি ছোট জলের কুণ্ড আছে। প্রতিদিন সকালে কুণ্ডে দুধের প্রবাহ দেখতে পাওয়া যায় বলে প্রচলিত আছে।  অমরকণ্টকের দ্রষ্টব্য স্থানের মধ্যে হলেও এটি ছত্তিসগড় রাজ্যে অবস্থিত।

 

অমরেশ্বর ও জালেশ্বর মহাদেব

অমরকণ্টক থেকে পেন্ড্রারোডগামী রাস্তায় ডানদিকে অমরেশ্বর মহাদেবের মন্দির। মন্দিরের নির্মাণকার্য চলছে। মন্দিরে একটি বিশাল শিবলিঙ্গ। শিবলিঙ্গের দুইপাশে দুটি সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে উঠে জলের পাত্র থেকে জল নিয়ে শিবলিঙ্গের মাথায় জল ঢেলে আবার অন্য সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এলাম।

অমরেশ্বর মন্দির থেকে বেরিয়ে এসে মেন রাস্তায় আরো কিছুটা এগিয়ে গিয়ে রাস্তার বাঁ দিকে দেখলাম জালেশ্বর মহাদেবের মন্দির। মন্দিরের ভেতরে চ্যাপ্টা শিবলিঙ্গ – জালেশ্বর মহাদেব। মন্দিরের পাশেই একটি ছোট কুয়ো। এই কুয়োটি  জোহিলা নদীর উৎস। জালেশ্বর মহাদেবের মন্দির দেখে আমরা ফিরে এলাম । আপাতত অমরকণ্টক ভ্রমণ সমাপ্ত।

 

~ অমরকণ্টক ভ্রমণ ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleভোরের আলো
Next articleসুখ
Ardhendu Chowdhury
অর্ধেন্দু শেখর চৌধুরী। পেশা শিক্ষকতা। জন্ম পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায়। ইন্দিরা গান্ধী মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক।
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments