অন্যান্য দিনের মত আজকেও কোনমতে ল্যাপটপ আর চার্জারটা ব্যাগে ঢুকিয়ে প্রায় উসেন বোল্‌ট এর স্পিডে অফিসের চার তলা থেকে নিচে পার্কিং স্পেসে গিয়ে যখন পৌঁছালাম তখন ক্যাব ড্রাইভার আমার দিকে একটা জলন্ত দৃষ্টি হেনে খেঁকিয়ে উঠল;

– ইয়েন সার ? তুম্বা লেটা ? ( বাংলা করলে যার মানে দাঁড়ায় “ কি স্যার? এত লেট?”)

– সরি ভাইয়া ! মিটিং থা , আগে সে নাহি হোগা । আপ চালো ।

বললাম বটে কিন্তু মনে হল আমরা দুজনেই জানি এই সময়ের আগে আমার অফিস থেকে বেরোন হবে না । আসলে ড্রাইভার এর আর দোষ কি, আমার জন্যে বেচারাকে রাত্রি ১-২ অব্দি অপেক্ষা করে বসে থাকতে হয়। ১১ টায় লাস্ট ট্রিপ টা মেরে এসে রোজই হয়ত ভাবে আজ বাড়ি তাড়াতাড়ি ঢুকব, কিন্তু আমার জন্যে সে আশা তার পূর্ণ হবার নয় । আমাকে একদিন বলেই ফেলেছিল, স্যার আপনি কি কাজ করেন বলুন তো? গোটা অফিস টা ১১ টায় খালি হয়ে যায়, আপনি কি এমন করেন যে ১-২ র আগে বেরোন ই না ? আমি শুধু হেসেছিলাম, কারণ আমার কাজটা আমি নিজেই আজ অব্দি বুঝে উঠলাম না তো আমার ড্রাইভার কে আর কি বোঝাব । সে যাইহোক এভাবেই চলে আসছে এবং চলবে যতক্ষণ না আমাদের মধ্যে কেউ একজন পাতা ফেলছি । ওহ ভালো কথা এই অব্দি পড়ে অনেকেই ভাবতে পারে আমি নিশ্চয়ই বিশাল হনু গোছের একটা চাকরি করি, যার জন্যে নিজের আলাদা একটা ক্যাব পাই । আজ্ঞে না, সম্পূর্ণ ভুল ভাবছেন, আমি আলাদা ক্যাব পাই কারণ গোড়ার দিকে আমার এই বিচ্ছিরি শিফট টাইমিং দেখে আমি প্রায় একটা ছোটখাট আন্দলন ই করে ফেলেছিলাম, আর তাইতেই আমার জন্যে এই সুব্যাবস্থা ( যদিও মাসে মাসে আমার মাইনে থেকে ২০০০ টাকা করে কেটে নেওয়া হয় ক্যাব বাবদ । সে নিকগে, একটা পার্মানেন্ট ব্যাবস্থা তো আছে যাতায়াত এর ) ।

আজও ভেঙ্কট (আমার ড্রাইভার) এর মাথা বেশ গরম হয়েই আছে । আমি বেশি পাত্তা না দিয়ে গাড়িতে উঠে ল্যাপটপ টা আবার অন করে আদ্ধেক করে রাখা কাজ টা শেষ করায় মন দিলাম। ভেঙ্কট জোরে একটা তামিল গান চালিয়েছে অডিও প্লেয়ার এ । মালটা নাকি তামিল, তেলেগু , কান্নাড় ,মালায়ালি এই চারটে ভাষাই বলতে ও লিখতে পারে । যদিও আমার কাছে এগুল সবই সমান । যাইহোক এই জোরে সাউথ ইন্ডিয়ান গান চালিয়েই সে নিজের রাগ জাহির করে থাকে । আমি একবার বললামও

– ভাইয়া থোড়া ভলিউম কাম কার দো !

– ডন ডন ডনে……গন গন গনে ( আরও জোরে বেজে উঠল )

বুঝলাম আজ বাড়ি পৌঁছানো অব্দি এটাই সঝ্য করতে হবে । বাংলায় দুটো কাঁচা খিস্তি করে কাজ এ মন দিলাম । আজকে (যদিও গতকাল হয়ে গেছে সেটা, কারণ এখন ১৭ মে,২০১৬ রাত ২ টো ) আমার জন্মদিন কিন্তু আজ সকাল থেকেই দিনটা খারাপ যাচ্ছে , দিনের শুরুতেই বসের কাছে একটা ভুলভাল কারণে ঝাড় খেয়েছি , তার উপর দুপুরে খাওয়ার টাইমও হয়নি কাজের চাপে । এখনও কাজগুলো শেষ করে উঠতে পারলাম না । আর এখন এই দুর্বোধ্য তামিল লারেলাপ্পা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত এর ঠেলায় মনে হচ্ছে মাথাটাই খুলে পড়ে যাবে । কি আর করা যাবে, কোনমতে কাজ এ মন দিলাম । এমন সুন্দর জন্মদিন আর কারও ভাগ্যে জুটেছে বলে মনে হয়না । গাড়ি ততক্ষণে হসুর রোড ফ্লাইওভার নিয়েছে আর প্রায় উড়ে চলেছে । এই সময় এমনিতেই রাস্তায় গাড়ি কম থাকে তারউপর ফ্লাইওভার এ সিগনাল এর চাপ নেই । আর ভেঙ্কট এর বউ মনে হয় বলেই দিয়েছে যে দেরি করলে আজ আর তার ঘরে ঢোকা হবে না । তাই পারলে মনে হচ্ছে আলোর স্পিড এ উড়িয়ে নিয়ে যাবে । নাহ আজ মনে হয় বাড়ি পৌঁছে তারপর আবার কাজ নিয়ে বসতে হবে । এই অবস্থায় কাজ করা প্রায় অসম্ভব । একদিকে কানফাটানো গান আর অন্য দিক এ এস্কেপ ভেলসিটি নিয়ে চলা ভেঙ্কট এর ইন্ডীকা । ল্যাপটপ টা ব্যাগে ঢোকাতে যাব হঠাৎ জোরালো একটা আওয়াজ আর আমার মাথাটা গিয়ে ধাক্কা খেল গাড়ির ছাদে , তারপর সব অন্ধকার ।।

জ্ঞান যখন ফিরল তখন দেখি আমি ফ্লাইওভার এর একদম রেলিং এর কাছাকাছি পড়ে আছি । কিছুটা সময় লাগল পুরো ব্যাপারটা বুঝে উঠতে । ঐরকম স্পিডে রং সাইড দিয়ে অন্য একটা গাড়িকে ওভারটেক করতে গিয়ে সোজা রেলিং এ ধাক্কা মারে আমাদের গাড়ি আর তাতেই আমার মাথায় লাগা আর জ্ঞান হারানো । উল্টোদিক এ মুখ করে পড়েছিলাম বলে বুঝতে পারিনি গাড়িটা বা ড্রাইভার এর কি অবস্থা । উঠে বসার চেষ্টা করতে গিয়ে বুঝলাম মাথার পেছন দিকটায় বেশ জোরেই লেগেছে । এতটাই জোরে যে ঘাড় কাত করতে গেলেও মনে হচ্ছে মারা যাব । যাইহোক কোনমতে উঠে দেখি দুটো পুলিশ এর ভ্যান আর একটা বাইক দাঁড়িয়ে আছে । আর আমাদের উল্টে যাওয়া গাড়িটার মধ্যে ত্থেকে কাউকে একটা বের করার চেষ্টা করছে । কাছে গিয়ে বুঝলাম সেটা ভেঙ্কট । পাশে দাঁড়ান পুলিশটাকে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলাম

– স্যার আমি এই ক্যাব টায় ছিলাম, ঐ লোকটা আমার ড্রাইভার । বেঁচে আছে তো?

পুলিশটা কোন উত্তর না দিয়ে একটু হাসলো । আমি একটু বিরক্ত হয়েই আবার জিজ্ঞেস করলাম

– স্যার আমার ড্রাইভার বেঁচে আছে তো ?
আমায় অবাক করে দিয়ে পুলিশটা পরিষ্কার বাংলায় বলে উঠল

– হ্যাঁ , বেঁচে আছে কিন্তু জ্ঞান নেই ।
– আপনি বাঙালি?
– ইয়েস স্যার ।
– ব্যাঙ্গালোর এ বাঙালি পুলিশ? ভাবা যায় ?
– চিনতে পারলি না তো পদু ?

জায়গাটা এত অন্ধকার যে পুলিশটার মুখ ঠিক করে দেখতে পাচ্ছিলাম না । এবার মুখটা ভালো করে দেখব বলে পকেট থেকে মোবাইল টা বের করতে গিয়ে দেখি ওটা সেখানে নেই । আমি হন্যে হয়ে কিছু একটা খুঁজছি দেখে আমার মনের কথা প্রায় বুঝে ফেলে সে নিজেই তার মোবাইল টা বের করে নিজের মুখের সামনে ধরে বলল

– এবার চিনতে পারলি ?

– কেমন চেনা চেনা লাগছে কিন্তু ঠিক…………

– ডি ভি বয়েজ , বি সেক্সন , লাস্ট বেঞ্চ , দা রক , এবার মনে পড়ল?

– আরে লম্বু তুই? কিন্তু তুই পুলিশ এর চাকরি তে তাও আবার ব্যাঙ্গালোরে? প্রায় দশবছর পর দেখা অ্যাঁ ? এও কি সম্ভব ? কেমন যেন সব গুলিয়ে যাচ্ছে ভাই ।

– বলছি সব বলছি কিন্তু তুই আগে বল তুই বাইরে পড়লি কেমন করে? দরজা গুলো তো সব অক্ষত ।

– কি জানি ভাই , অ্যাক্সিডেন্টের ইমপ্যাক্ট এ মনে হয় পেছনের বাঁ দিকের দরজা টা কোনভাবে খুলে যায় আর তাতেই আমি বাইরে পড়ি । আর তারপর উল্টে যাওয়ার দরুন দরজাটা আবার কোনভাবে বন্ধ হয়ে গেছে । ঠিক বলতে পারবনা । মাথায় চোট লেগে অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম তাই কিছু মনে নেই, সবটাই অনুমান ।

লম্বু মানে রমেন আমার স্কুল এর বন্ধু , আমরা একসাথে স্কুল টিম এ ক্রিকেট খেলতাম । রমেন বরাবরই খেলাধুলোয় ভালো , চেহারা পত্তরও বেশ তাগড়াই , যেকারণে আমরা ওকে ‘দা রক’ বলে ডাকতাম । কিন্তু মাধ্যমিক এর পরে আর দেখাসাক্ষাৎ হয়নি , এমনকি কোন যোগাযোগ ই ছিল না । আজ এতদিন পর এভাবে দেখা হওয়ায় আমি রীতিমত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছি।

– কি রে কি ভাবছিস?

– হুম? নাহ কিছু না, কই বললি না তো তুই এখানে কিভাবে?

– আমি আইপিএস পাস করে পুলিশ জয়েন করেছি ৬ বছর আগে । তারপর এখান সেখান ঘুরে ব্যাঙ্গালোরে এসে হাজির হলাম ২ বছর আগে ।

– হুম , বুঝলাম । এতদিন পর যে এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি । ভাই আমার মোবাইলটা কোথাও পড়ে গেছে, একটু হেল্প করবি খুঁজে বের করতে ।

– ও পেয়ে যাবি , চাপ নিস না। এতদিন পর দেখা হল চল একটু গল্প করি ।

– কিন্তু এই অবস্থায় ? তোর তো এদিক টা দেখতেও হবে , অ্যাকসিডেন্ট বলে কথা । তুই এক কাজ কর , তুই এদিকটা সামলে নে , আমার ফোন নাম্বার টা রাখ । পরে একদিন সময়মত দেখা করা যাক । আমার ফোনটা দেখে নি আগে কোথায় গেল…

বলতে বলতে দেখলাম আমার ফোনটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে একটু দূরে পড়ে আছে । তুলে নিতে নিতে বললাম,

– যাক পাওয়া গেছে । কিন্তু দোকানে দিতে হবে ফের চালু করতে গেলে । তুই আমায় একটা ক্যাব ডেকে দিবি বা তোর লোকজনদের বলবি একটু আমায় বাড়ি পৌঁছে দিতে ।

– তার দরকার নেই , তুই আয় আমার সাথে , তোকে তোর জায়গায় পৌঁছে দেবো ।

– ওহ হ্যাঁ তোর তো বাইক আছে……

– নাহ ওটা আমার নয়। ওটা ওদেরই একজনের ।

– তাহলে কি তোদের ভ্যানে ?

– নাহ হেঁটেই পৌঁছে দেবো তোকে ( বলতে বলতে একটু মিচকি হাসল লম্বু )

এবার আমার মাথাটা গরম হতে শুরু করেছে । সকাল থেকে এম্নিতেই দিনটা ভালো যাচ্ছে না তার উপর এত কিছু ঘটে গেল আর এখন লম্বুর ইয়ার্কি । নাহ আর জাস্ট নেওয়া যাচ্ছে না । একটু রেগেই বললাম ,

– দ্যাখ ভাই আজ একদম ইয়ার্কির মুডে নেই । তুই না পারলে বল আমি নিজেই ব্যাবস্থা করে নেব ।

– বললাম তো হেঁটেই যেতে পারবি , চল আমি এগিয়ে দিচ্ছি ।

এবার আমি চটে গিয়ে এগোতে যাব পেছন থেকে লম্বু বলে উঠল

– প্রথম টায় এই ভুল টা আমারও হয়েছিল । আসলে এই সময়টা খুব ক্রিটিকাল । লাইনটা দেখেও দেখা যায়না ।

আমি পাত্তা না দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি হঠাৎ চোখ গেল উল্টে যাওয়া গাড়িটার দিকে । পিছনের সিট থেকে ওটা কাকে বের করে আনছে ওরা ? এই মুখটা আমি আয়নায় আর প্রোফাইল পিকচারে বহুবার দেখেছি । কিন্তু ও কি মাথার পিছনটা ওরকম ত্যাবড়ান ক্যান ? আন্মনেই নিজের মাথায় হাত দিতেই চমকে উঠলাম ।

একী ? এরকম থকথকে লাগছে ক্যানো? তাহলে কি আমি ? মানে ? কিন্তু লম্বু?

মনে পড়ল একবছর আগের একটা হেডলাইন , “ মাঝরাতে বাড়ি ফেরার পথে বে-আইনি মালবাহী ট্রাকের তলায় চাপা পড়ে নিহত বাঙালি আইপিএস অফিসার রমেন ঘোষ” । কিন্তু সেসময় অত গুরুত্ব দিয়ে কাগজটা পড়িনি ।

কিন্তু আমি ? তার মানে আত্মাও কি গল্প…… নাহ ক্যামন যেন সব ঘেঁটে যাচ্ছে । পায়ে একটা শক্ত মত কিছু লাগতে, নিচু হয়ে দেখতে গিয়ে যেটা হাতে ঠেকল সেটা আর কিছুই না…

আমার SKULL !!!

ধড়ফড় করে উঠে বসলাম । মাথায় হাত দিয়ে বুঝলাম মাথা অক্ষত আর আমিও নিজের বিছানায় । উফফ বাঁচলাম । এটা তাহলে স্বপ্ন ছিল । মোবাইলে ঘড়ি তে দেখলাম রাত ২ টো বাজে। পাশে রাখা বোতল থেকে একটু জল খেয়ে মোবাইলের আলোটা নেভাতে যাব, হঠাৎ চোখ গেল ডেট টার দিকে । মাথায় বাজ পড়লেও এতটা অবাক হতাম না, যতটা একটা ডেট দেখে হলাম । কারন মোবাইল বলছে, আজ

16th May,2016 , 2:00 AM … !!!

 

~ অদ্ভুতুড়ে ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleমন্দির
Next articleThe Bings of Binigurhi
Debraj Patra
I am an analytics professional.Writing is my hobby. Besides writing I do Photography, I love cooking and travelling.
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments