রাঢ় অঞ্চলের এক বিস্তীর্ণ রুক্ষ প্রান্তরে আমার একক অবস্থান| সময়ের কালচক্র আমার পারিপার্শিক সবকিছুধংস করে দিয়েছে | পরিচিত যা কিছু ছিল , সব গ্রাস করে নিয়েছে, ফেলে রেখেছে শুধু আমাকে | সেদিনের আমি আর আজকের আমির মধ্যে বিস্তর ফারাক| আজ আমি বৃদ্ধ, ভগ্নপ্রায়, জ্বরাগ্রস্ত – মেঠো পথের ধারেপরে থাকা এক প্রকান্ড ধ্বংসস্তূপ | ফেলে আসা গৌরব আঁকড়ে বেঁচে আছি | অবসম্ভাবী মৃত্যুর পদধ্বনিউপেক্ষা করে আজো আমি দাঁড়িয়ে আছি জীবনের সন্ধানে |

একটা সময় ছিল যখন এ প্রান্তর রুক্ষ ছিল না | জীবনের কলশব্দে আলোড়িত ছিল এই প্রান্তর | আগাছায় ঘেরা যে মেঠোপথ আমার সিংহদ্বারে এসে শেষ হয়েছে , সে পথে একসময় মোরাম পড়তো | তুলসীমঞ্চে ধূপ জ্বলতো , প্রাঙ্গনে পড়তো ঝাট | আসার পথে ওই যেখানটায় উঁচু বেদীগুলো দেখতে পাও, সেখানটায় বাজার বসতো | আরেকটু দূরে, ওই মজে যাওয়া ঝিলের ধারে , একটা ছোট্ট গ্রাম ছিল | খুবই ছোট জনপদ | কয়েকঘর কৃষক আর মৈথিলী ব্রাহ্মণের বাস ছিল সে গ্রামে | রোজ সকালে পল্লীবধূরা আসতো ফুলের ডালি সাজিয়ে | তিনবার প্রদক্ষিণ করতো আমায় | তারপর গর্ভগৃহে ঢুকে দেবতার সামনে মেলে দিতো তাদের কামনার ডালি | সে কামনা, আজ আমার দেওয়ালে দেওয়ালে, গর্ভগৃহের কুলুঙ্গিতে , ভগ্নপ্রায় কড়িকাঠে মুখরিত হয় | বড়ো সরল সে আবেদন, ” সবাই ভালো থাক ” |

বছরে একবার উৎসব হতো | জন্মাষ্টমীর দিন | খুব বড়ো উৎসব | উৎসবের দিনথেকে বেশ কয়েকমাস আগে শুরু হতো উৎসবের ব্যবস্থাপনা | আশপাশের সব গ্রামের মাথারা একজোটহতো এই প্রাঙ্গনে | তাদের মধ্যে সবচেয়ে বৃদ্ধ যে , সে ওই গড়ুর মূর্তির বেদিতে ঠেসান দিয়ে বসে হুকোয় টান দিতো | উৎসবের আলোড়ন তার বলিরেখায় হারিয়ে যেত | চার কুড়ি পাঁচ বসন্ত দেখা হয়ে গেছিলো তার | আলোচনা কিছুই প্রায় শুনতো না | বেলাশেষের আলোর তেজটাও হারিয়ে ফেলেছিলো | তার জীবনে তখনগোধূলি পেরিয়ে সন্ধ্যা | আসন্ন রাত্রির অপেক্ষায়, চালসে পড়া চোখে নীরবে তাকিয়ে থাকতো আমার দিকে | সেই চোখের তারা আমাকে আজ ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই সন্ধ্যেবেলায় | সে চোখে কিছু প্রশ্ন ছিল | কোনো একসময় সেই সব প্রশ্নের উত্তর ছিল আমার কাছে; আজ প্রশ্ন উত্তর মিলে মিশে কেমন যেন অদ্ভূত একটা ধোঁয়াশা | তার চোখের চালসে আজ আমার চোখে, রাত্রির প্রহর গোনার পালা আজ আমার |

সেইদিন থেকে কয়েক শতাব্দী পরে, প্রাঙ্গনের ডান প্রান্তে বেড়ে উঠেছিল একটি বটগাছ | টেরাকোটার দেওয়ালের ফাঁক  দিয়ে যেদিন সে ছোট্ট মাথাটা বার করেছিল আলোর দিকে, সেদিনথেকে চিনতাম তাকে | উল্টানো জীবের মতো দুখানা সবুজ পাতা যেন সময়ের দূত | ইঁট, কাঠ, পাথর দিয়ে সময়কে ধরে রাখার যে চেষ্টা মানুষ করে এসেছে আজন্মকাল, সেই প্রচেষ্টার প্রতি প্রকৃতির বুড়োআঙ্গুল |ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছিল সে | টেরাকোটার সাজে সাজানো দেয়ালটার বুক চিরে সে ছড়িয়ে দিয়েছিলো তার শাখাপ্রশাখা  | মাটির গভীরে ছিল তার শিকড় আর আমার চূড়ার দিকে তাকিয়ে বেড়ে উঠেছিল সে | একসময়কে জানি তার গুঁড়িতে একটা লাল সুতো বেঁধেছিলো ; গিঁট দেওয়ার সময় করেছিল কোনো আব্দার দেবতার মুখ চেয়ে | নিয়তির নিয়মে হয়তো সে আব্দার পূরণ হয়েছিল | সে বার্তা ক্রমে ছড়িয়ে গেছিলো গ্রাম থেকেগ্রামে, জনপদ থেকে জনপদে , এমনকি শহরেও |

সেদিনের কথা মনে পরে, যেদিন সে বার্তা শুনে, গঙ্গাহৃদয় সাম্রাজ্যের পাটরানীহাজির হয়েছিল আমার প্রাঙ্গনে | সেদিন সকাল থেকে সাজ সাজ রব | সেদিন দক্ষিণের সিংহদুয়ার থেকেউত্তরের খিড়কি, কোথাও তিলধারণের জায়গা ছিল না | রানীমার পাল্কির অপেক্ষায় হাজার হাজার মানুষএকত্রিত হয়েছিল | রানীমা পাল্কিতে আসেননি , বহুদূরে পাল্কি থেকে নেমে, ঝিলের জলে স্নান করে, হলুদসুতো হাতে হেঁটে এসেছিলেন তিনি | পাত্র মিত্র পরিবেষ্টিত হয়ে ওই নাচ দরজা দিয়ে প্রবেশ করেছিলেন | কেউ তাঁকে বলেছিলো, হলুদ সুতো বাঁধতে | সাধারণ মানুষের লাল সুতোর ভিড়ে তার মানসিক যাতে হারিয়ে নাযায়, তাই হলুদ সুতো বেঁধেছিলেন তিনি | তিনি রানীমা, দেবতার দরবারে তাঁর অগ্রাধিকার |

পাটরানীর দম্ভতাঁকে দিয়ে ঘোষণা করিয়েছিলো উৎকোচ | মানসিক পূরণ হলে গর্ভগৃহ মুড়ে দেবেন মর্মরে | দেবতার দ্বারেচিরকালই সাম্যের জয়গান | সর্বশক্তিমান তিনি উৎকোচে ভোলেন না | তাই নিয়তির দরবারে , বেশকয়েকটি লাল সুতোর সাথে হারিয়ে গেছিলো হলুদ সুতোও |বহু অপূর্ণ মানসিকের বোঝা ঘাড়ে , বহুদিন নীরবে দাঁড়িয়ে ছিল সেই বটগাছ | তারও শতাব্দী দুয়েক পরে, এক ঝড়ের রাতে, আমাকে শেষ বিদায় জানিয়েছিল সে| অপূর্ণ মানসিকের  বোঝা ঘাড়ে কালের গহ্বরে তলিয়ে গিয়েছিলো | সে যাত্রায় কোনো আক্ষেপছিল না , ছিল অভিমান – এক অদ্ভুত চেতনা – নিয়তি মানসিকের ধার ধারে না, সে চলে আপন খেয়ালে | সর্বশক্তিমান দেবতাও তার কাছে অসহায় |

শুনেছিলাম দেবতা নাকি সচ্চিদানন্দ স্বরূপ | তার মৃন্ময় মূর্তির আবরণে লুকিয়ে থাকে তার অবিনশ্বর চিন্ময় রূপ | সে রূপে কোনো দুঃখ নেই, ক্লান্তি নেই | বিস্তীর্ণ সৃষ্টির বোঝা ঘাড়ে নিয়েও, তিনি আনন্দমুখর | সৃষ্টির বন্ধনে আবদ্ধ তিনি, চিরকাল মুক্তির দিকনির্দেশ করে থাকেন | সেই দেবতার মাথা নাড়া দেখেছিলাম আমি | সেদিন বিষন্ন চিত্তে নতমুখ তিনি , অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে ছিলেন সৃষ্টির দিকে | সে জিজ্ঞাসু চোখ সৃষ্টির মধ্য হতে একটাই প্রশ্নের উত্তর চেয়েছিলো | তিনি বারবার মাথা নেড়ে বুঝতে চাইছিলেন তাঁর ত্রুটি কোথায় | সৃষ্টির যে রূপ , কারণ সলিলে শায়িত তিনি কল্পনা করেছিলেন, সেরূপ সেদিন গিয়েছিলো হারিয়ে |

সেদিন পাগলিনী কমলা , সন্ধ্যার পর আশ্রয় নিয়েছিল মন্দির প্রাঙ্গনে | সেদিন সেরজস্বলা  | রক্তে ভেসে গিয়েছিলো তার সাদা খান , রক্তের ফোঁটা পড়েছিল আমার প্রাঙ্গনে | সে রাত্রে যন্ত্রনায়কাতর কমলা ছটফট করেছিল | ভোররাতে অবসন্ন দেহে নিমজ্জিত হয়েছিল গভীর ঘুমে | সকালে যখন তারঘুম ভাঙে , তাকে ঘিরে গভীর জটলা | গ্রামের পল্লীবধূরা সন্ত্রস্ত মুখে তাকিয়ে ছিল তার দিকে | তারপর পুরোহিত বিচার করলেন | তাৎক্ষণিক সে বিচারের  ফলও বেরোলো | কমলাকে টেনে হিঁচড়ে বার করে দেওয়া হয়েছিল প্রাঙ্গন থেকে | পল্লীবধূরাই করেছিল সে কাজ | দেবতা সেদিন ঘন ঘন মাথা নেড়ে বুঝিয়েছিলেন তাঁর অসম্মতি | রক্তের যে বিন্দু সৃষ্টির ভিত্তি বহন করে , সে রক্তে স্রষ্টা অপবিত্র হননা | হায়রেমানুষ, দেবতার দিকে সেদিন কেও ফিরেও তাকায়নি | তাকালে আমার মতোই দেখতে পেতো সে বিষন্ন মুখ |

গড়ুরের ডানা ঝাপ্টানির শব্দ শুনেছি আমি বহুবার | গ্রামে ইংরেজ সেনার ছাউনি পড়েছিল সেবার | যে পল্লীকিশোরী সে বছর যৌবন কে আলিঙ্গন করেছিল, সেই একাকী অপরাহ্নে দেখেছিলাম তার লঙ্ঘন | পৌরুষের দর্পে বলীয়ান সে উদ্ধত লিঙ্গ উপনীত হয়েছিল তার উপর | সে লিঙ্গসম্মতির ধার ধারেনি | সেইদিন শুনেছিলাম গড়ুরের ডানা ঝাপ্টানি | প্রস্তর মূর্তির ভিতর থেকে সে শব্দ দিকবিদিক ছড়িয়ে পড়েছিল | সেই ইংরেজ সিপাহী শোনেনি সে শব্দ | শুনলে হয়তো আগাম টের পেতো তারমৃত্যুর পদধ্বনি | ‘৫৭র বিপ্লবের আগুন ছারখার করে দিয়েছিলো সেই যুবক সিপাহীর জীবন | হয়তোবা মৃত্যুর ঠিক আগে সেই সিপাহী শুনেছিলো গড়ুরের ডানার শব্দ |

‘৪৩র মন্বন্তর | সে সময় আমার চোখ দিয়েও গড়িয়ে পড়েছিল জল | কঙ্কালসার মানুষের ঢল নেমেছিল আমার এ প্রাঙ্গনে | সে বছর কোনো উৎসব হয়নি | গ্রামের সবাই প্রায় দুমুঠো অন্নের সন্ধানে পারি দিয়েছিলো শহরের উদ্দেশ্যে | দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষগুলি কিছু সময় কাটিয়েছিলো আমার কাছে | দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তিতে অবসন্ন মানুষগুলি কিছুটা সময় জিরিয়েছিলো আমার প্রাঙ্গনে | সম্বল হীন হাত দুটিতুলে দেবতার কাছে প্রার্থনা করেছিল | কোনো উত্তর পায়নি তারা | সেই প্রথমবার, আমিও তাদের হয়ে প্রশ্ন করেছিলাম দেবতাকে | কোনো উত্তর পায়নি তারা, আমিও কোনো উত্তর পাইনি | দেবতার সে নীরবতার মর্ম আজও বুঝিনি |

দূর্বিসহ দুঃখের মাঝেও আজ আমি খুশি | আজ আর আশ্রয়ে দেবতার বিগ্রহ নেই | তাঁকে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে দূরের কোনো মন্দিরে | এই ভগ্নপ্রায় ইমারতে আজ আর মানুষের আনাগোনানেই | একাকী আমি দিন গুনি | এই সেদিন এক ষোড়শী কিশোরী এসেছিলো প্রদীপ হাতে | জ্যোৎস্না-স্নাতসন্ধ্যাবেলায় , প্রদীপ হাতে প্রদক্ষিণ করেছিল আমায় |  বিগ্রহ নেই, তবু হাতজোড় করে প্রণাম করেছিল দেবতার উদ্দেশ্যে | সে প্রনামে কোনো কামনা ছিল না | দেবতার কোনো মুখ্ ছিল না | নিরাকার সর্বশক্তিমানসে অবলোকনকারী ছিল তার মনের ভিতর | এইতো শুরু, দিন বদল হলো বলে | শেষের সে দিন হবে সুন্দর, নির্মল , শান্ত, স্বচ্ছ |

 

~ মন্দির ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleট্র্যাফিক
Next articleঅদ্ভুতুড়ে
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments