কাল বেলা ঘুম থেকে উঠে সবে দাঁত মাজাটা শেষ করেছি, এমন সময় দরজায় দুম দাম ধাক্কার আওয়াজ ! কি হোলরে বাবা? তাড়া তাড়ি ছুটে এসে দরজাটা খুললাম ৷ বাইরে দেখি পিসেমশাই হতাশ মুখে দাঁড়িয়ে ৷  আমাকে দেখে ভেজা চোখে হাউ হাউ করে বলে উঠলেন “আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে রতন, কিছু আর বাকি নেই” ৷

সর্বনাশ হয়েছে ? কী সর্বনাশ হয়েছে ? পিসেমশাইয়ের একমাত্র ছেলে দেবাশীষ আমেরিকাতে থাকে, তার আবার কিছু হল না তো? ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করলাম “ কি হল? দেবাশীষ …” ৷ তাড়া তাড়ি হাত তুলে পিসেমশাই আমাকে থামিয়ে দিলেন “আরে বাবা সে ঠিক আছে, তার কথা নয় … কাল রাতে আমার বাড়িতে চুরি হয়ে গিয়েছে, আমার সেই সিন্দুকটা… সিন্দুকটা আর নেই” ৷

না, আপনাদের সব কথা খুলে না বললে ব্যাপারটা ঠিক বোঝানো যাবেনা ৷ আমি তখন কল্যানীর কাছের এই জায়গাটা থেকে ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করে কলকাতায় চাকরি করি ৷ তখনো বিয়ে করিনি ৷ পিসেমশাই সম্পর্কে আমার কেউ হন না ৷ পাড়ার সবাই তাঁকে “পিসেমশাই” বলে ডাকে বলে আমিও ওনাকে “পিসেমশাই” বলে ডাকতাম ৷ ওনার বৌ পিসিম৷কে আমি দেখিনি, অনেক বছর আগেই নাকি তিনি মারা গেছেন  ৷ পাড়ার পুরনো বাসিন্দারা ছাড়া তাঁকে কেউ বিশেষ দেখেনি ৷ যারা দেখেছে, তারা বলে তিনি নাকি ভারী সুন্দরী ছিলেন ৷ পাড়ার মেয়ে মহলে তাঁকে ছাড়া কোন কাজ নাকি হতে পারতো না ৷ পাড়ার সবাই পিসেমশাইকে চিনতো শুধু তাঁর বউএর জন্য ৷

পিসেমশাই মুখচোরা বলে নাম কিনে ছিলেন, কারো সঙ্গে বিশেষ মিশতেন না ৷ পাড়ায় ”কিপটে” বলে ওনার বেশ বদনামও ছিল ৷  সবাই বলত “বুড়োর অনেক টাকা, থাকেই সুধু গরীব সেজে ৷ নইলে ছেলেকে কেউ আমেরিকা পাঠাতে পারে” ? গুজব শোনা যায় পিসেমশাই নাকি জমিদার বাড়ির একমাত্র ছেলে ছিলেন ৷ তাঁর বাবা মারা যাওয়ার পর তিনি নাকি  তাঁর বাবার টাকা শেয়ারের ব্যাবসায় লাগিয়ে বিরাট বড়লোক হয়ে উঠে ছিলেন ৷

কিন্তু হঠাৎ শেয়ারের বাজারে ভয়ানক মন্দা হয়ে তাঁর সব টাকা নষ্ট হয়ে যায় ৷ এক দিনে দেউলিয়া হয়ে যান একেবারে ৷ ভিটে মাটি সব বিক্রি করেও ধার দেনা সব শোধ হয়নি ৷ শেষে কলকাতার এই  শহরতলির একতলা একটা এসবেসটাস চালের ছোট্ট ভাড়া বাড়িটাতে সামান্য ভাড়ায় থাকতে শুরু করেন। সঙ্গে জিনিস পত্র নাকি বিশেষ কিছু ছিল না, তবে একটা বিশাল বাদসাহি সিন্দুক ছিল সঙ্গে ৷ ওটা নাকি ওনাদের পুরুষানুক্রমিক সম্পত্তি ৷ ওর ভিতরে কি আছে কেউ জানতে পারেনি  ৷

বউ মারা যাওয়ার পর একমাত্র ছেলে দেবাশীষকে মানুষ করে তোলাই তাঁর স্বপ্ন হয়ে ওঠে ৷ দেবাশীষ ছিল ভারি মেধাবী ছাত্র, তাই পিসেমশায়ের স্বপ্ন সফল হল  ৷ দেবাশীষ দেশের পড়া শেষ করে আমেরিকাতে উচ্চ শিক্ষা করতে চলে যায় ৷ পড়া শেষ করে সেখানে সে ভাল চাকরিও পেয়েছে শুনি ৷ পিসেমশাইয়ের সঙ্গে আমার আলাপ পাড়ার চায়ের দোকানে ৷ দাবা খেলতে ভালবাসি শুনে ভারি খুশি হয়ে বলেছিলেন “আরে আমিওতো দাবা খেলতে খুব ভালবাসি ৷ সন্ধ্যেবেলা কাল চলে এসো আমার বাসাতে” ৷ পরের দিন ওনার বাড়িতে দাবা খেলতে গিয়ে বুঝতে পারলাম উনি একজন তুখোড় দাবা খেলোয়াড় ৷ হারানো তো দূর, আমি ওনার খেলার কোন নাগালই পাচ্ছিলাম না ৷

তার পর ওনার সঙ্গে রোজ সন্ধ্যায় দাবা খেলতে যেতাম খেলাটা ঠিক করে শিখতে ৷ স্বীকার করতে লজ্জা নেই  এক দুবার বারের বেশী জিততে পারিনি  ৷ তাও সে জিতেছি একটা চালাকি করে ৷ জটিল খেলার পরিস্থিতিতে ওনার ছেলে দেবাশীষের ব্যাপারে কোন কথা তুলে ওনাকে অন্যমনস্ক করে দিয়ে এক দুবার শুধু জিততে পেরেছিলাম৷ ওনার ঘরের কোনে, বাদশাহি সেই সিন্দুক আমি দেখে ছিলাম, কিন্তু ওটার ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করবার সাহস আমার হয়নি ৷

পাড়ার মোড়ের চা এর দোকানে তপন একবার বলেছিল আমাকে “ বুড়োর সঙ্গে দাবা খেলছেন খেলুন, কিন্তু ওই সিন্দুকটার ব্যাপারে কিছু জিগ্যেস করতে যাবেন না আবার ৷ আমি একবার জিগ্যেসা করতে গিয়ে প্রায় মার খেতে যাচ্ছিলাম আর কি ৷ বুড়ো এমন চটে গেল কি বলব ৷ আজ পর্যন্ত ভাল করে কথা বলেনা আমার সঙ্গে ৷” তার পর গলাটা একটু খাটো করে বললো “অনেক বাদশাহি মোহর লুকোন আছে ওই সিন্দুকে,  জমিদারী আমলের জিনিষ, বুড়ো কাউকে জানতে দিতে চায়না আর কি ৷ সারা রাততো বুড়ো ঘুমোয়না ৷ চোরে চুরি করবে কি করে? আর ডাকাত ? বুড়োর যা বাজখাই গলা, ফোনের দরকার হবেনা, থানা থেকে এমনই ওর চেঁচানি শুনতে পাবে ৷”

সেই সিন্দুক চুরি গিয়েছে ! ব্যাপারটা হল কেমন করে? পিসেমশাইকে প্রশ্ন করতে বললেন “ শীতের রাতে জানালা টানালা সব বন্ধ করে একটু চোখ বুজে ছিলাম, কখন জানালার ফোকর দিয়ে ঘুম পাড়ানি ধূপ কাঠি ঢুকিয়ে আমাকে বেঘোরে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে ৷ তার পর সিঁদ কেটে, …আরে চলোনা, নিজের চোখেই সব দেখবে ৷” আমাকে প্রায় টানতে টানতে নিয়ে চললেন ওনার বাড়িতে ৷ পৌঁছে দেখি বাড়ির সামনে বিরাট ভিড় ৷ পাড়ার নিতাই পুলিশের সাব ইনসপেকটার ৷ সে কাউকে বিশেষ কাছে ঘেঁসতে দিচ্ছে না ৷ “ আরে বাবা এভিডেনস নষ্ট হয়ে যাবে না ” ৷ পিসেমশাইকে দেখতে পেয়ে সে বলল “ আরে আপনাকেই তো খুঁজছিলাম , কোথায় ছিলেন মশাই ? কি কি খোয়া গেছে সব লিস্ট বানাতে হবে না ? “ পিসেমশাই ডুকরে উঠলেন “ আমার সব, সবই গিয়েছে বাবা” ৷ নিতাই হতাশ ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বলল “ কি মুস্কিল, নিন, সামলান এখন এই বুড়োকে “ ৷

চারি দিকে তাকিয়ে দেখি পিসেমশায়ের শোবার ঘরের দেওয়ালে একটা বিরাট গর্ত ৷ সিন্দুকটা সেই গর্ত দিয়েই বার করেছে ৷ নিতাই ফিস ফিস করে আমাকে বলল “ দুটো চোর ছিল, জুতোর ছাপ থেকে বুঝেছি ৷ অতো ভারী সিন্দুক নিয়ে বেশি দূর পালাতে তো পারবে না, গেল কোথায় ?” এই সব কথার মাঝেই হঠাৎ ভিড়ের মাঝে আওয়াজ উঠল “ পাওয়া গেছে, পাওয়া গেছে “ ৷ শুনলাম কাছের ফুটবল খেলার মাঠের ধারে এক ঝোপে সিন্দুকটা নাকি পড়ে আছে, একটা বাচ্চা ছেলে নাকি দেখেছে ৷ হৈ হৈ করে ভিড় ছুটল মাঠের দিকে ৷ নিতাই সবার আগে ছুটল চেঁচাতে চেঁচাতে “ কেউ সিন্দুকে হাত দেবেন না কিন্তু, পুলিশকে পুলিশের কাজ করতে দিন ৷”  পিসেমশাই যা ছুট দিলেন তা দেখে কে বলবে বুড়ো মানুষ ! পৌঁছে দেখি, না , সিন্দুকটাতো আছে ৷ তার বিশাল ভাঙা তালাটাও পাশেই পড়ে আছে ৷ নিতাই সবাইকে সরিয়ে দিয়ে বলল “ নিন দেখুনতো পিসেমশাই, কি কি খোয়া গেছে “ ৷

পিসেমশাই মাঠের মাঝে থেবড়ে বসে সিন্দুকের ডালা খুলে তার মধ্যে হাত চালিয়ে দিয়ে বার করে আনলেন কি একটা শাদা কাপড়ের মত ৷ “ এইতো এইতো, আছে আছে, খোয়া যায়নি “ ৷

অবাক হয়ে জিগ্যাসা করলাম “ ওটা কি পিসেমশাই ?”

“ খোকার প্রথম ন্যাপি, কততো টুকু, দেখো “ ৷

নিতাই বিরক্ত মুখে বলল “ আরে বুঝলাম  বুঝলাম, আর বাকি জিনিস গুলো একটু দেখুন তো” ৷

বলবার দরকার নেই, বাচ্চারা যেমন Christmas এর দিন মোজা থেকে  Santa Claus এর দেওয়া gift একটার পর একটা বার করে, পিসেমশাই  সেই রকম সিন্দুকের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একটার পর একটা জিনিষ বার করে খুশিতে আটখানা হয়ে যেতে লাগলেন “  এইতো খোকার দুধের ঝিনুক, এইতো খোকার ঝুমঝুমি, এইতো খোকার প্রথম আঁকা ছবি,  এইতো খোকার প্রথম সোয়েটার – ওর ঠামমা বানিয়ে ছিল…”

নিতাই আর বিরক্তি চাপতে না পেরে বলল “ আরে দূর মশাই, এসবের খবর চাইনি, আপনার ভ্যালুয়েবল কিছু গেছে কিনা তাই বলুন “ ৷

পিসেমশাই অবাক হয়ে বললেন “ কি বলছ বাবা, এসব ভ্যালুয়েবল নয় ? আমার খোকার ছেলে বেলার এইসব জিনিষ একবার হারালে আর পেতাম কখনো ? সারা জীবনের সঞ্চয় , সে নাকি ভ্যালুয়েবল…”

তপন আমায় বলল “ আরে ওভাবে হবে না, সরাসরি জিগ্যাসা করতে হবে “৷ তার পর পিসেমশাইয়ের দিকে ফিরে যতটা সম্ভব মোলায়েম স্বরে বলল “ আচ্ছা  পিসেমশাই, একবার ভাল করে দেখুন তো, আপনার সেই মোহর গুলো আছে নাকি“ ?

পিসেমশাই এবার বোকা বোকা একটা হাসি দিয়ে বললেন “ ও তুমি সেগুলোর কথা বলছ ? সে তো এর মধ্যে ছিল না, খোকার পড়া আর বিদেশে যাওয়ার খরচ৷ ওঠাতে সেতো কবেই খরচ হয়ে গিয়েছে ৷ সেসব নিয়ে চিন্তা কোর না তোমরা ৷ আমার কিছছুটি নেয়নি চোরেরা ৷ সুধু তালাটা …”৷

তপন মুখ বেঁকিয়ে বলল “ সত্যি কী কপাল আপনার, এত ভদ্র চোর আজকাল বিশেষ দেখা যায় না, কিছছুটি নেয়নি… “ ৷ তার পর গলা নামিয়ে আমাকে ফিস ফিস করে বলল “ আমার চোর গুলোর কথা ভেবে চোখে জল আসছে… একবার ভেবে দেখুন ! এই শীতের রাতে শালারা বুড়োকে ঘুম পাড়িয়েছে , দেয়ালে শাবল দিয়ে গর্ত খুঁড়েছে , ওই ভারী সিন্দুক টানতে টানতে অতটা দূর নিয়ে গেছে , ওই ভারী তালাটা ভেঙ্গেছে , আর তার পর টর্চ মেরে আঁতিপাঁতি করে সিন্দুক খুঁজে কি পেয়েছে? ন্যাপি আর অয়েলক্লথ…৷ মনের দুঃখে শেষে ঝোপের ধারে এক তাল হেগে ভোর রাতে বাড়ি ফিরে বৌয়ের বকুনি শুনেছে , আরে ছ্যা ছ্যা …৷ “

 

অনেক বছর কেটে গিয়েছে ৷ আমার ছেলেরাই এখন বড়ো হয়ে সব বিদেশে ৷ পুরোনো ছবির এলবামে তাদের শৈশবকে খুঁজে ফিরি ৷ পিসেমশায়ের ছবি ঝাপসা হয়ে গিয়েছে, ছবিতে ঝুলছে শুখনো মালা ৷ ছবিতে হাসিটা কিন্তু আর বোকা বোকা লাগেনা, কেমন যেন একটা ব্যাঙ্গের হাসি মনে হয় ।

 

~ বাদশাহি সিন্দুক ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleআজ তুইও আবেগি
Next articleএকটি মনগড়া গপ্পো
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments