।এক।

সারাদিনটা যা খাটনি গেছে, মি. ডালমিয়া, মানে দামোদর ডালমিয়া আর দাঁড়াতে পারছেন না। এবার ঘরে গিয়ে নরম সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে হুইস্কির বোতলটা না খুললে আর চলছে না। মুম্বাইয়ের দাদার এলাকায় নতুন একটা স্টুডিওতে স্যুটিং চলছে তাঁর নতুন মুভি – “ইয়ে হ্যায় মোহব্বত” ছবির। অনেক টাকা লোন নিয়ে, নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে এই ছবিতে ঢালছেন ডালমিয়া, ছবি হিট হওয়া চাই। বাজারে তাঁর বেশ কিছু ধার আছে, এই একটা ছবি হিট হলে এক কিস্তিতে সব সুদে আসলে মিটিয়ে দেবেন, এই উদ্দেশ্যেই নেমেছেন।

মুম্বাইয়ের এই মুভি জগতে তাঁর প্রায় বছর পঁচিশ হয়ে গেল … সেই বাবার হাত ধরে প্রথম এসেছিলেন … তাও কত বছর আগে। প্রথম প্রথম এই ছোট খাট কাজ, ক্যামেরাম্যানকে হেল্প করা, এডিটিং, ফ্লোর ম্যানেজার, এই সব কাজ করতে হোত। বেশ কয়েক বছর এই রকম ভাবে যাবার পর একজন দয়া করে অ্যাসিস্টেন্ট ডাইরেক্টরের একটা কাজ দিয়েছিলেন। সেটাও অবশ্য ডাইরেক্টিং-এর কাজ নয় … এই নায়ক নায়িকাকে খুশি রাখা, দরকার মতো তাদের হাতে সিগারেট কোল্ডড্রিঙ্কস গুঁজে দেওয়া, ফ্লোরের লাইটিং তদারকি, স্যুটিং-এর সিকোয়েন্স ঠিকঠাক রাখা, এই সব।

সেসব দিন অবশ্য পেরিয়ে গেছে, আজ তাঁর নাম এই ইন্ডাস্ট্রিতে মোটামুটি সবাই জানে, বেশ কয়েকটা মেগা হিট দিয়েছেন উনি। ইদানিং অবশ্য বাজার একটু মন্দা যাচ্ছে দামোদরের, পর পর দুটো বই বক্স অফিসে ফ্লপ করলো, ব্যাস তাতেই বাজারে হুর হুর করে দেনা বেড়ে গেল।

 

তবে এবার বেশ কোমর বেঁধে নেমেছেন ডালমিয়া, দেদার পয়সা ছড়িয়েছেন, ডাইরেকশান আর প্রোডিউসিং দুটোই একসাথে করছেন, “ডালমিয়া টকিজ”-এর ব্যানারে। স্ক্রিপ্ট কিনেছেন মুম্বাইয়ের মুভি ইন্ডাস্ট্রিতে বিখ্যাত আলিম খানের কাছ থেকে, নায়ক হচ্ছে এক নম্বর স্টার কমলেশ খান্না। নায়িকার জন্য অবশ্য সেরকম পয়সা খরচ করতে হয়নি, নায়িকা হৈমন্তী শুধুমাত্র তাঁর ডাইরেকশানের বইতেই অভিনয় করে।

সেটাও অবশ্য দামোদরের পাকা মাথার খেলা, এই বুড়ো বয়সেও নানা ভাবে পটিয়ে পাটিয়ে বিস্তর খরচ আর অনেক ভালো ভালো প্রতিস্রুতি দিয়ে এই বছর দেরেক হোল হৈমন্তীকে বিয়েই করে ফেলেছেন উনি। বিয়ের একটা প্রধান শর্ত অবশ্য যে হৈমন্তি দামোদর ছাড়া আর কারোর ছবিতে অভিনয় করতে পারবে না। এই ছবির সুরকারও বিখ্যাত বিপুল দেববর্মন, যার নামেই গান হিট হয়ে যায়।

সেই দামোদর একটু খুটিনাটি দেখতে ভালোবসেন। তাই কাজ হয়ে গেলে যাতে অযথা কোথাও লাইট বা ফ্যান না জ্বলে তার জন্য নিজে ফ্লোরের ঘরে ঘরে গিয়ে দেখে আসেন। আজও সে রকম স্যুটিং শেষ হয়ে যাবার পর এ ঘর ও ঘর করতে করতে গ্রীন রুমে এসে থামলেন, দরজাটা খোলা, ভেতরে অবশ্য অন্ধকার। বাইরে থেকেই দরাম করে দরজাটা বন্ধ করে দেবেন কিনা ভাবতে ভাবতে ঘরের ভেতরে কেমন খস খস একটা শব্দ শুনলেন … কি রে ভাই, বেড়াল টেরাল নয়তো। পকেট থেকে জোড়াল পেন্সিল টর্চ বার করে ঘরের মধ্যে ফেললেন। না ফেললেই বোধহয় ভালো হোত …।

গ্রীন রুমটা বেশী বড় নয় কিন্তু একটু লম্বা টাইপের, ভেতরে নানা সাইজের সোফা, আয়না আর কাঠের টেবিল কসমেটিক শিশি বোতলে ভরতি। টর্চের আলোটা একটু ঘোরাতেই দুজন মানুষের ছায়া কেঁপে উঠলো। এই অন্ধকারে কারা রাত প্রায় সাড়ে আটটার সময়? চোর টোর নয়তো?

দামোদর বাজখাই গলায় চিৎকার করে উঠলেন – অ্যায় … কৌন হ্যায় তুম? বাহার আইয়ে …।

ছায়ামূর্তি দুজন দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। আহা মরিমরি, দামোদর উত্তেজনায় নিজের বুকের ওপর হাত রাখলেন। আর কে, তার ছবির সাকসেসের গ্যারান্টি, হৈমন্তি আর কমলেশ। কমলেশের হাত তখনও হৈমন্তির হাত ধরে রয়েছে, দুজনের হাতেই আধ খাওয়া দুটো কিংফিশার বিয়ার। হৈমন্তির মুখের মেকআপও তোলার সময় হয়নি।

দামোদরের মাথায় যেন দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো। ওদের দুজনের গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর সেটে অনেকবারই দেখেছেন, সেরকম পাত্তা দেননি। অনেক গসিপ ম্যাগাজিনে ওদের দুজনকে নিয়ে হাল্কা স্টোরী বেরিয়েছে, দামোদর হৈমন্তির সাথে হুইস্কি টানতে টানতে মজা করেছেন। কিন্তু আজ তো একেবারে হাতেনাতে …।

দামোদর আর রাগ সামলাতে পারলেন না, চিৎকার করে উঠলেন – স্কাউন্ড্রেল, এই করতে তোমাদের আমি পয়সা দিচ্ছি? এই বয়সে সারাদিন খাটতে খাটতে আমার মুখে রক্ত উঠে গেল আর তোমরা ফুর্তি করছো? আমার পয়সায় তোমাদের ক্যারিয়ার তৈরী হচ্ছে আর তোমরাই আমাকে বিট্রে করলে?

কমলেশ এক পা এগিয়ে এলো – কাম ডাউন দামোদর, এতো উত্তেজিত হয়ো না, এটাকে এতো সিরিয়াসলি নেবার কিছু নেই।

দামোদর মুখটা ঘেন্নায় বিকৃত করলেন – শাট আপ। তোমার সাথে আমার পরে কথা হবে।

হৈমন্তি এগিয়ে এসে দামোদরের পিঠে হাত রাখলো – চিল দামোদর, উই আর জাস্ট এনজয়িং আ বিয়ার, দ্যাটস অল।

দামোদর হাতটা সরিয়ে দিল – ইউ জাস্ট কাম উইথ মি, রাইট নাউ। উই নিড টু টক।

দামোদরের চিৎকারে ততক্ষণে দুজন সিকিউরিটি দোতলার লাউঞ্জে পৌঁছে গেছে কিন্তু মুভি ওয়ার্ল্ডের বিগ বস যখন কথা বলছেন তখন ওরা একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে, এটাই এখানকার দস্তুর বা সহবৎ।

দামোদর আর কোন কথা বললেন না, হাত দিয়ে সিকিউরিটিকে সব বন্ধ করতে বলে দামি জুতোর মস মস আওয়াজ তুলে নিচের আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং লটের দিকে চলে গেলেন, পেছনে হাই হিলের খট মট আওয়াজ তুলে হৈমন্তি। কমলেশ নিঃশব্দে পাশের সোফা থেকে তার চামরার জ্যাকেটটা তুলে নিয়ে কাঁধের ওপর চাপিয়ে সিকিউরিটি দুজনের দিকে হাত নেরে ক্ষিপ্র শার্দুলের মতো দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল।

 

********

বাড়ী ফিরে জামা কাপড় না ছেড়েই দামোদর হুইস্কির বোতল নিয়ে লাউঞ্জের টেবিলে এসে বসলো। হৈমন্তি টয়লেট থেকে বেরিয়েই চট করে দোতলায় চলে যাবার চেস্টা করছিল, দামোদর টেবিল থেকেই চিৎকার করে উঠলো – হোয়াট দি হেল ইউ থিঙ্ক ইউ আর ডুইং? আমার মুভির সেটে তুমি কমলেশের সাথে প্রেম করছো? অ্যান্ড আই নিড টু অ্যাকসেপ্ট দ্যাট?

হৈমন্তিও ফোঁস করে উঠল – তুমি তিল কে তাল করছো দামু। আমি আর কমলেশ ভালো বন্ধু, আমরা কাজের শেষে জাস্ট একটু ফ্রি টাইম এনজয় করছিলাম। তুমি এসেই তো বারোটা বাজালে।

– আই সি। ওই অন্ধকার ঘরে ফ্রি টাইম এনজয় করছিলে?

– তোমার চোখ খারাপ দামু। লাউঞ্জের আলোয় আমরা দুজনেই বেশ ক্লিয়ার দেখতে পারছিলাম।

দামোদর গম্ভীর ভাবে জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিলেন, হৈমন্তি যখন সিঁড়ির প্রায় মাঝামাঝি, তখন বেশ নাটকীয় ভাবে বললেন – আই রিমাইন্ড ইউ হৈমন্তি, তোমার ক্যারিয়ার আমার হাতে। তোমাকে ভালো লেগেছিল বলে তুলে এনেছিলাম, আজকে আবার তোমায় রাস্তায় নামিয়ে দিতে পারি।

হৈমন্তি সিঁড়ির ওপর থেকে ঝাঁঝিয়ে বললো – দামু, আমাকে ব্ল্যাকমেল কোরো না, লাভ হবে না। আমি মুম্বাইতে তিনটে হিট দিয়েছি তোমার সাথে কাজ করার আগে, ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই আমাকে চেনে। তুমি ছেড়ে দিলে অনেকেই আমাকে কাজ দেবে।

দামোদর রেগে কাঁই হয়ে সোফায় বসে রইলেন, হৈমন্তি পায়ের হাই হিলের খট খট শব্দ তুলে নিজের ঘরে ঢুকে দুম করে দরজা বন্ধ করে দিল। দামোদর আর কি করেন, আরো কিছুক্ষণ হুইস্কি টেনে বেশ একটু নেশা হয়ে গেলে আস্তে আস্তে উঠে নিজের আলাদা ঘরে গিয়ে শুয়ে পরলেন, কালকে আবার সারাদিন স্যুটিং আছে।

 

*******

পরের দিন ঘুম ভাঙতেই দামোদর বেশ খিদে অনুভব করলেন। ধড়মড় করে বিছানা ছেরে উঠে বাথরুমের কাজকর্ম সেরে সোজা খাবার টেবিলে এসে বসলেন। রান্নার লোক ততোক্ষণে টেবিল সাজিয়ে ফেলেছে … ডাবল ডিমের পোচ, বাটার টোস্ট আর ধোঁয়া ওঠা কফি, সঙ্গে কিছু স্যালাট। হৈমন্তি এখন আসেনি কিন্তু ওর জন্য অপেক্ষা না করে দামোদর নিজেই শুরু করে দিলেন, আর খেতে খেতে ভাবতে লাগলেন কমলেশ আর হৈমন্তির ব্যাপারটা কি ভাবে ট্যাকল করা যায়।

খাওয়ার পর আর সময় বেশি নেই, দামোদর আর হৈমন্তি গাড়ীতে এসে বসতেই ড্রাইভার গাড়ী চালাতে শুরু করলো। আজকে আবার একটা ছোট আউটডোর স্যুটিং আছে … মুম্বাই সিটি থেকে মাইল পনের দূরে, ওরা আজ সোজা ওখানেই যাচ্ছে, ইউনিটের আর সবার সেখানেই মিট করার কথা।

ওখানে আগে থেকেই লোকেশান ঠিক করা ছিল। ফাঁকা জায়গায় একটা পুরনো বাড়ীতে স্যুটিং হবে, আসে পাশে কিছু নকল ঝুপড়ি তৈরী করাই আছে, আর আছে কিছু এক্সট্রা। ছোট ছোট কিছু সিন, একটা সিনে দুস্থ কমলেশ অসুস্থ্য হয়ে একটা ছোট্ট ঘরে একলা শুয়ে আছে আর কিছু লোক ডাক্তারকে খবর দিয়েছে, হৈমন্তি ডাক্তার হয়ে ঘরে প্রবেশ করবে … পরে বোঝা যাবে যে কলেজ জীবনে ওরা দুজনকে চিনতো, ছবিতে সেখান থেকেই প্রেমের শুরু।

ক্যামেরার পিছনে থাকলেও আজ দামোদর সজাগ, সে মনোযোগ দিয়ে কমলেশ আর হৈমন্তির হাবভাব লক্ষ্য করে যাচ্ছে। সকালের দিকে দামোদর তার ইউনিটের কয়েকজনকে ফোন করে কিছু ইন্সট্রাকশান দিয়েছিলেন, কাজেই তারাও রেডি। হৈমন্তী বা কমলেশের অবশ্য কিছুতেই যেন হুঁশ নেই, তারা গভীর কনসেন্ট্রেশানে অভিনয় করে যাচ্ছে। সব ঠিকই চলছিল, দামোদরের মনটাও একটু একটু করে শান্ত হয়ে আসছিল, বাধ সাধল বৃষ্টি।

লাঞ্চের পর সেকেন্ড হাফের স্যুটিং, সিনটা হচ্ছে কমলেশের শরীর একটু ভালো হয়েছে, ডাক্তার হৈমন্তী তাকে নিয়ে কাছেই একটা গ্রামের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে বার হবে। গ্রামের ব্যাপার বলে কাছেই একটা সত্যিকারের গাছপালা ভর্তি মাটির রাস্তায় স্যুটিং শুরু হয়েছিল। কোথাও কিছু নেই হঠাৎ দুবার মেঘ ডেকেই বেশ জোরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। ওরা দুজনে হাঁটতে শুরু করতেই ক্যামেরা পিছু পিছু যাচ্ছিল, কিন্তু একচুয়াল সিনেমায় তো বৃষ্টি নেই, কাজেই থামাতে হোল।

কাদা আর জলে দামোদরের দামি স্যুট নস্ট, তাড়াতাড়ি বড় ছাতা এনে ব্যাপারটা ম্যানেজ করলেও প্রায় জনা পঁচিশেক লোক সেখান থেকে আবার পড়িমরি করে সেই বাড়ীর মধ্য ফিরে এলো। সবাই কম বেশী ভেজা, কাজেই চা আর বিস্কুট এলো, কিন্তু বৃষ্টি না থামায় স্যুটিং আজকের মতো শেষ। কেউ খেয়াল করেনি যে হৈমন্তী আর কমলেশ ভিড়ের মধ্যে নেই, সেই বৃষ্টি শুরু হবার পর থেকেই ওরা দুজনে নিখোঁজ।

চা স্ন্যাকস শেষ, বৃষ্টিও ধরে এসেছে, সবাই প্যাক আপ করে আবার মুম্বাই সিটির দিকে ফিরে যাবার জন্য রেডি এমন সময় কমলেশ আর হৈমন্তী আবার সেই জলকাদা ভর্তি গ্রামের রাস্তার দিক থেকেই ফিরে এলো, জলে ভিজে জবজব করছে, জামা কাপড়ে কাদা কিন্তু মুখে অনাবিল খুশির হাঁসি।

সবাই একবার আড় চোখে দামোদরের দিকে তাকাল, গত কালকের ব্যাপারটা এর মধ্যে সবাই শুনেছে। বোমা বোধহয় ফাটলো … কিন্তু দামোদর আজকে একদম চুপ। তার চোয়াল শক্ত, চোখের দৃস্টিতে খুনের লিপ্সা কিন্তু মুখে কোন শব্দ নেই। শুধু নিজের পাতলা হয়ে আসা চুলের মধ্যে হাত বুলিয়ে সবাইকে কালকের স্যুটিং-এর কথা বলে একটা ছোট একটা হন্ডা গাড়ী নিয়ে দামোদর শহরের দিকে চলে গেলেন, তার কিছু নিজস্ব কাজ আছে।

 

to be continued……

~ প্যাঁচ ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleআপদ
Next articleপ্যাঁচ (শেষ পর্ব)
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments